ঋতুর পালাবদলে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে নতুন আমেজ নিয়ে শীত ঋতুর আবির্ভাব ঘটে অনেকটা আনন্দময় ও মজাদার পরিবেশ নিয়ে। অত্যন্ত সাবলীলভাবে শীত আমাদের জানান দেয় বন্ধুরা, আমি এসে গেছি, আমাকে উপভোগ করো, আমার সমস্ত মায়াবী উপহার তোমাদের তরে বিলিয়ে দিলাম, তোমরা যে যার মতো তা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করো। ভালোবাসায় সোহাগভরা শীতের এই আহবান অত্যন্ত যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য। কারণ এ সময়টা থাকে, বছরের শেষ সময়। বার্ষিক পরীক্ষার ঝুট-ঝামেলা শেষ করে অনেকটা অবসর সময় অতিবাহিত হয়। ডানা মেলে স্বাধীনভাবে চলার এক মোক্ষম সময় এটি। এ সময়ে থাকে না গ্রীষ্মের মাঠ-ঘাট ফাটা প্রখর তাপ, বর্ষায় নূপুরের শব্দে অবিরল বারিধারা। এ সময় ছন্নছাড়া সাদা মেঘের ভেলা আনমনে ঘুরে বেড়ায় সারা আসমান জুড়ে আর বিকেলে নানা রঙের শিল্প এঁকে নিলীমা ভেদ করে পশ্চিমাকাশে ডুব দেয় দিনের সূর্য। কাশবনের শন শন শব্দ আর পাখ-পাখালির কিচির-মিচিরে মুখর থাকে পাশের বাঁশবন। জনপদে বিরাজ করে অঘোষিত এক স্থবিরতা। পরানে তীব্র শিস দেয় প্রকৃতির মায়াবী টান আর আকুলতায় ব্যাকুল হয় অজানা এক ভালোবাসায়। এ সময় গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় মাছ ধরার মহোৎসব। রাখাল ছেলের পাগল করা বাঁশির সুর। কুয়াশায় আচ্ছন্ন হিমেল বাতাসে শীতের হাড়কাঁপানো ঠা-া, সাথে থাকে নতুন ধানের পিঠা-পায়েস আর সকালের মিঠে রোদ্দুরে পিঠ ঠেকিয়ে রসনা তৃপ্তি। এ যেন শীতের সেই রকম এক অনুভূতি। শুধু কি তাই, খেজুরের মিষ্টি রসের হাঁড়িতে পাটকাঠি ডুবিয়ে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের চুকচুক করে রস খাওয়ার সেই দৃশ্য অন্য রকম এক শিহরণ তুলে মনে। সে সবের মজাই আলাদা। বন্ধুরা, ঠিক এরকম এক সময় আজ আমাদের প্রকৃতিতে বিরাজমান। অর্থাৎ হাজারো মজার মজার পসরা নিয়ে শীতঋতু আমাদের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, ঝরঝরে প্রকৃতি, কাদামাটি নেই কোথাও, সবুজ মাঠে পাকা ধান, শির শির ঠা-া বাতাস, ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব, টাটকা শাক-সবজি, পিঠা পায়েস, বনভোজন- এ সবই আমরা উপভোগ করবো বেশ মজা করে। শীতের এ উপহার আমরা মোটেও হেলায় নষ্ট করবো না।
বছরের শেষ পরীক্ষা অর্থাৎ বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। চারদিকে মায়াবী শুকনো ঝরঝরে প্রকৃতি। কোথাও কাদামাটির ছিটেফুটোও নেই। ঠা-া হিম বাতাসে ভর করেছে কুয়াশা নামে সাদা মেঘের আবরণ, সবুজ প্রকৃতিকে ঘিরে ধরেছে মধুর মমতা দিয়ে। এ সময়টাতে মজা নেয়ার উত্তম জায়গা নানার বাড়ি ছাড়া আর কি হতে পারে? উ:! গ্রামের সে কী দৃশ্য! ভোর সকালে মামার সাথে গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে হাঁটার মজাই আলাদা। চোখ জুড়ানো পাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধ আর শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের কোমল স্পর্শ মনকে শীতল করে তুলে। কুয়াশার আবরণ ভেদ করে গরুর পাল নিয়ে মাঠে ছুটে রাখাল ছেলে। কুয়াশা ভেজা ক’টা পাখির ওড়াউড়ি। হাঁটু পানি খালে অথবা জলাশয়ে দাঁড়কানা মাছ শিকারে ব্যস্ত সাদা সারসের দল। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এমন মজা শীতঋতু না এলে কী পেতাম? সে কারণেই এ ঋতুতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়ানোর মাহেন্দ্র সময় হিসাবে গণ্য করা হয়। তাই তো দেশের পর্যটন এলাকাগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে ছেলে বুড়ো সহ নানা রঙ ও বর্ণের মানুষের হৈ-হুল্লোড়ে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার হয়ে ওঠে তখন জনসমুদ্র। এ ছাড়াও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত কিংবা সুন্দরবনে বেড়ানোর সাধ নিতে শীতকালই হচ্ছে একটি মোক্ষম সময়। তা ছাড়া বগুড়ার মাহস্থানগড়, সিলেটের জাফলং, তামাবিল, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, লালাখাল, শ্রীপুর, সুনামগঞ্জের টাংগুয়ার হাওর, হাছন রাজা জাদুঘর, মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি ও কাউয়াদিঘি হাওরের মনলোভা দৃশ্য, পাখির অভয়াশ্রম বাইক্কাবিল, হামহাম ও মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া সর্বোপরি চা-বাগানের অপরূপ দৃশ্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান বা রাঙ্গামাটিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়ানোর জন্য সুন্দর সময় এই শীতকাল। শীতের এ মজাকে মানুষ ষোলো আনা নিজের করে উপভোগ করে নানা রঙে ও নানা ঢঙে। শুধু তাই নয়, অগ্রহায়ণের ফসল ঘরে তুলে গায়ের বধূরা বাবার বাড়িতে নাইয়র আসে। শীতের মজা ভাগাভাগি করে নেয় মা-বাবা ভাই-বোনদের সাথে। মা-বাবারও আনন্দের শেষ থাকে না। ‘এত দিন পর মেয়ে বাড়ি এলো’ সেটা উপলক্ষ করে তাদের কত কি আয়োজন সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে! সাচ্চা কথা, শীতের এই সময়টাতে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে অন্য সময়ের চেয়ে খানিকটা সচ্ছল থাকার কারণে গ্রামে গ্রামে চলে পিঠা-পুলির বিশাল আয়োজন। এ উৎসবে মতে ওঠে গোটা এলাকার মানুষ। ধুম পড়ে ঘরে ঘরে। আহ্! কী আনন্দ, কী মজা। আবার বাড়িতে বাড়িতে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের চড়ুইভাতির অনুষ্ঠান। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মেয়েদের দল রান্নায় ব্যস্ত আর ছেলেদের হাতে এটা-ওটা কাজ আর কাজ। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এক রত্তি সময় নেই কারো সাথে কথা বলার। মা-বাবারাও তাদের ছেলে মেয়েদের চড়ুইভাতির এ অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন প্রাণভরে। প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। টুকটাক নানা পরামর্শ দিচ্ছেন মন খুলে। এ সবই শীতের বাড়তি আয়োজন ও নিখুঁত মজা ছাড়া আর কিছু নয়। যা বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে যোগ করে এক নতুন মাত্রা। তা ছাড়া শীতের মজা নিতে সন্ধ্যা হতেই দাদুর সাথে লেপ মুড়িয়ে কিচ্ছা শুনার বায়না সহজে কি ভুলা যায়। দাদুর মুখে ডালিম কুমার আর সোনালি দিনের কিচ্ছা মনকে ভওে তোলে অনেক উচ্চতায়। স্বপ্নগুলো তখন উঁকি মারে সোনালি দিনের সেই বীর খালিদ বিন ওয়ালিদ, ওমর বিন খাত্তাবের মতো যুগশ্রেষ্ঠ মানুষ হবার। দাদুর মুখের কিচ্ছা শুনতে শুনতে কখন যে ঘুম এসে চোখে চুমো খেত টেরই পাওয়া যেত না। সকালবেলা খাবার টেবিলে রকমারি পিঠা-পুলির প্রদর্শনী। দাদুর সে রকম আদর মেশানো বুলি-‘বুঝলে দাদু, ‘শীতের আসল মজাটাই হলো খেজুরের রস’ কত কি যে তৈরি হয় এ রস দিয়ে, তুই কি জানিস? যেমন খেজুরের রস দিয়ে গুড় ও পাটালি বানানো হয়। তৈরি করা হয় নানান রকমের পিঠা। রসে ভিজিয়ে তৈরি করা হয় ভিজোই পিঠা। খেজুরের পাটালি ও গুড় দিয়ে বানানো হয় ভাপাপিঠা, রস দিয়ে রান্না করা হয় শিরনি বা পায়েস আর রসের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে বানানো হয় রসের পিঠা। এ সব-ই আমাদের বাঙালির শখের খাদ্য তালিকায় শীর্ষে। এ সব পিঠা-পুলি শুধু স্বাদে নয়, গন্ধেও অতুলনীয়। এগুলো আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বটে। পিঠার খাঁজে খাঁজে ফুটে ওঠে নিবিড় শিল্পনৈপুণ্য। নানা সাজে সজ্জিত এসব পিঠার নামেরও বাহার আছে বৈকি, যেমন- পাটিসাপটা, দুধপুলি, ভাজাকলি, নারিকেলি, ভাপা, চিতই, নকশিপিঠা, দুধচিতই, বড়াপিঠা, ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি, চিতলপিঠা ইত্যাদি। এসব পিঠা শীতের বিশেষ উপহার বললেও অত্যুক্তি হবে না। বন্ধুরা, এ-তো গেলো মজাদার পিঠে-পায়েসের গল্প অন্য দিকে শাকসবজির বাজারেও যে শীত আমাদের জন্য টাটকা সবজির বাহার নিয়ে বসে আছে, তা কি খেয়াল করেছো। গ্রামের বিস্তীর্ণ জমিতে শীতকালীন শাকসবজি ক্ষেতের দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। বছরের অন্যান্য সময় বাজারে টাটকা সবজি কম পাওয়া গেলেও শীতকালে তা দ্বিগুণভাবে বাজারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, গাজর, শিম, ঢেঁড়স, বেগুন, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, আলু, বরবটি, শসাসহ নানা রকম সবজিতে ভরপুর থাকে বাজার। এ ছাড়া পালংশাক, মুলাশাক, লালশাক, লাইশাক, ধনেপাতা পেঁয়াজ পাতাসহ নানা জাতের টাটকা শাকও পাওয়া যায় বাজারে। শীতকালে যেসব সবজি পাওয়া যায়, তার বাজারমূল্য তুলনামূলকভাবে সামান্য বেশি হলেও ভোজনরসিকদের তাতে কিছু যায় আসে না। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এসব সবজির সাথে টমেটো সালাদ না হলেই নয়। আর এ দিকে শীতের আরেক মজাদার খাদ্য মটরশুঁটির নাম তোমরা কি ভুলে গেছো? কী আমেজ, আহ! কী মজা! মটরশুঁটির গরম গরম কচুরি খেতে কার না ইচ্ছে হয়, তা শুধু খেতে স্বাদ-ই নয়, এ সবজির খাদ্যগুণও অপরিসীম। শীতের এসব বাহারি সবজি খেতে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করে, যার তুলনা করা নিতান্তই দুষ্কর। এ ছাড়া শীতের সত্যিকারের আরো মজা দেখতে হলে হাঁটতে হবে গাঁয়ের আরো গভীরে। যেখানে আছে মাথার ওপর ঘন কুয়াশার ছাউনি, শিশির ভেজা মেঠোপথের দু’ধারে বিস্তীর্ণ সরষে ফুলের চোখ জুড়ানো বাগান। এ যেনো মখমলের হলুদ কার্পেট বিছানো এক রাজকীয় বিছানা, দেখলেই মন ভরে উঠবে মুহূর্তে। আহা, সরষে ফুলের সৌরভে কী আশ্চর্য মাদকতা! সে মাদকতার টানেই মৌমাছিদের ভিড়। আর বকপাখিদের আনাগোনা। এ দৃশ্য যেন কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা রঙের ছড়াছড়ি। শুধু তাই নয়, শীতে রয়েছে অনেক রকমের ফল। যার মধ্যে বরই, আমড়া, কমলা, আঙ্গুর, আপেল, চেরিসহ আরও রয়েছে নানা করমের ফলমূল। এগুলো শীত ঋতুতে আমাদের জন্য আলাদা এক মজা নিয়ে হাজির হয়, যা খেতে খুবই সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর।
শীতের মজার মধ্যে বাঙালির আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হচ্ছে বাউল মেলা। এ সময় সুফি ও বাউল ভাব দর্শনে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী মেতে ওঠে নানা অনুষ্ঠানে। বিরাট শামিয়ানা বেঁধে রাতব্যাপী চলতে থাকে পালা গানের মহোৎসব। কার্তিকের মরা মঙ্গাকে অতিক্রম করে কৃষকেরা গোলায় ধান ভরে অবসর এ সময়ে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। শত শত দর্শকের উপস্থিতিতে দু-তিন গাঁয়ের ছেলে, বুড়ো, কিশোর মেতে ওঠে পরম আনন্দে। আবার এদিকে গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিজেদের বিশ্বাস, ঈমান ও আকিদার খুঁতগুলোকে ঝালাই করার উদ্দেশ্যে ওয়াজ মাহফিল ও তাফসিরুল কুরআনের আয়োজন করে থাকেন। হাজার হাজার শ্রোতা এসব মাহফিলে অংশ নিয়ে নিজেকে স্রষ্টার করুণা ভিক্ষায় সঁপে দেন। দেশসেরা আলেমগণ, কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন গড়ায় নসিহতমূলক বক্তব্য তুলে ধরেন জনসম্মুখে। এ সবই যে শীতের বাড়তি আকর্ষণ বা মজা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এত কিছুর পরও শীত কখনো কখনো আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাঝে মধ্যে শৈত্যপ্রবাহ জনজীবনে ডেকে আনে চরম দুর্ভোগ। এ সময় ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকে প্রকৃতি। তুমুল শৈত্যপ্রবাহ মানুষের জীবনে বয়ে আনে অসহনীয় যন্ত্রণা। আমাদের দেশে শীত মৌসুমে শৈত্যপ্রবাহের সময় সূর্যমামা লুকিয়ে থাকে আকাশের গায়ে, টানা কয়েকদিন, সে সময় তার দেখাই পাওয়া যায় না। সড়কে গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ঘন কুয়াশার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। মাঘ মাসের তীব্র শীতের দিনগুলোতে সাধারণত এসব দৃশ্য চোখে পড়ে। এ সময় তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে কমে যায়। রাতে সড়কের বাতিগুলোর আলোও কুয়াশায় দেখা যায় না। মাত্রাতিরিক্ত ঠা-ার কারণে অসহায় সম্বলহীন মানুষ একটি গরম কাপড়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে। অসুস্থ মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না। বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধ বয়সের লোক কাবু হয় শীতের কাছে খুব সহজে। তারপরও শীত আমাদের প্রকৃতির বিশেষ উপাদান। সীমাহীন উৎসব। বাঁধভাঙা আনন্দ আর গভীর ভালোবাসার অনন্য মজা।

Share.

মন্তব্য করুন