৩০১৫ সালের এপ্রিল মাসের আগুন ঝরা রোদের মাঝে চার ঘণ্টা ধরে বাসের টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে, তবুও ক্লান্তি অনুভব করছি না। মনের মাঝে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।
চার দিন পর পৃথিবী একাদশ বনাম টাইটান গ্রহ একাদশের ক্রিকেট ম্যাচ। খেলা হবে মঙ্গল গ্রহের “সাকিব আল হাসান মহাজাগতিক ক্রিকেট গ্রাউন্ডে”।
২ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বাসের টিকেট পেলাম।
পরদিন মঙ্গলে যাবার জন্য রেডি হয়ে বাসে চড়ে বসলাম। ছোট ফুপির বিয়ে হয়েছে মঙ্গলের সামরিক বাহিনী কমান্ডো অফিসারের সাথে। আমার সেখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমার পাশের সিটে বসেছে মানবিক আবেগসম্পন্ন সপ্তম প্রজাতির ভ২ টাইপ রোবট। সপ্তম প্রজাতির রোবটদের মানুষের সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আমি নিঃশব্দে বাসে বসে রইলাম। মিনিট খানেকের মধ্যে ঘণ্টায় ১০০০০০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন বাসটি সাঁই-সাঁই করে মঙ্গলের দিকে উড়ে চলল। পৃথিবী থেকে মঙ্গলে যেতে এখন এক মাসের প্রয়োজন নেই। মাত্র ১৪ ঘণ্টায় যাওয়া যায়। নৌকায় গেলে অবশ্য ১০ ঘণ্টাও লাগে না। ১৪ ঘণ্টার আগেই মঙ্গলে গিয়ে পৌঁছলাম।
শহরে ঢুকে খানিকটা উত্তেজনা অনুভব করলাম। শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে অসংখ্য মানুষ, রোবট আর এলিয়েন। এলিয়েনেরা টাইটান গ্রহে বাস করে। উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচটি দেখার জন্য অসংখ্য এলিয়েন মঙ্গলে এসেছে। দুই গ্রহের ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করে শহরকে নতুন রূপে সাজানো হয়েছে। বড় বড় ইলেকট্রিক বিলবোর্ডে দুই গ্রহের তারকাদের ছবি। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ফুপির বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে কুমিরের সুপ খেয়ে একটা ঘুম দিলাম।

২.
লাখ দশেক দর্শকের পদচারণায় মুখরিত সাকিব আল হাসান মহাজাগতিক ক্রিকেট গ্রাউন্ড। দর্শকেরা একটু পর পর আনন্দ ধ্বনি করছে। প্রচ- শব্দে কান ফেটে যাবার আগে কানের ভলিউম কমিয়ে নিলাম। এখন সবকিছু স্বাভাবিক লাগছে। অল্পক্ষণের মধ্যে শুরু হবে দুই গ্রহের ক্রিকেট লড়াই। মধ্যমাঠ থেকে কেউ একজন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই সবাই চুপ হয়ে গেল। চতুর্মাত্রিক স্ক্রিনে তার ছবি ভেসে উঠেছে। উত্তেজিত গলায় তিনি বলতে শুরু করলেন,
‘আজ ক্রিকেটের জন্য বিশেষ একটি দিন। এই বিশেষ দিনে আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন মহামান্য সাকিব আল হাসান। সুপ্রিয় ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন মাঠে প্রবেশ করবেন হাজার বছর আগের ক্রিকেটার, মহামান্য সাকিব আল হাসান।’
আনন্দ ধ্বনিতে পুরো স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে তুলল দশ লক্ষ দর্শক।
উড়ন্ত রিক্সায় চড়ে মহামান্য সাকিব স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন। সবার সাথে আমিও আমার ইলেকট্রিক চোখ রিক্সার কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি দু’চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছেন। ওনার নামে স্টেডিয়ামের নাম দেখে হয়ত অবাক হয়েছেন। এমন একজনকে দেখতে পাব সেটা মঙ্গলে আসার আগে কল্পনাও করতে পারিনি।
প্রাচীনকালের মানুষ আর বর্তমানের মানুষের মাঝে বিস্তর তফাত। এই যেমন মহামান্য সাকিব আল হাসানের মাত্র দু’টি চোখ। আমাদের মত ইলেকট্রিক চোখ নেই। তিনি ইচ্ছা করলেই আমাদের মত কোটর থেকে তৃতীয় চোখ বের করে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারেন না।
কিছুক্ষণ পর মহামান্য সাকিব ভেতরে চলে গেলেন।
মধ্য মাঠ থেকে আবারো ঘোষণা শুরু হলো,
Ñ ‘আমরা এখন ক্রিকেট থেকে অতীতের একটি কালো অধ্যায় মুছে ফেলতে চাই। আপনাদের সামনে এমন এক ঘৃণিত ব্যক্তিকে হাজির করব যে কিনা হাজার বছর আগে নানা ভাবে ক্রিকেটকে অপমানিত করেছে। সে ক্রিকেটে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। ক্রিকেটকে একটা জুয়ার আসরে পরিণত করে ফেলেছিল সে। ক্রিকেটের সেই দুঃস্বপ্নের নাম নারায়ণ স্বামী শ্রীনিবাসন। অতীত থেকে এই নরাধমকে ধরে আনা হয়েছে।’
দু’টি দ্বিতীয় প্রজাতির ভলান্টিয়ার রোবট শ্রীনিবাসনকে টেনে হিঁচড়ে মাঠে নিয়ে এসে বাউন্ডারি লাইনের এক পাশে বেঁধে রাখল।
Ñ ‘কোন ব্যাটসম্যান যদি এই দুষ্টুর গায়ে বল লাগাতে পারে দ্বিগুণ রান পাবে। আর কারো বল লেগে যদি তার প্রাণ চলে যায় তবে ঐ বলে ৫০ রান যোগ হবে।’

নির্ধারিত সময়ে খেলা শুরু হল।
টসে জিতে ব্যাট করছে টাইটান গ্রহের এলিয়েনেরা। প্রথম দশ ওভারে কোন উইকেট না হারিয়ে টাইটানের সংগ্রহ ১০৩। এবার বল হাতে নিলেন সাকিব আল হাসান। বল হাতে নিয়ে এক আশ্চর্য ভঙ্গিতে ব্যাটসম্যানকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলেন। বল এলুমিনিয়ামের পিচে পড়ার পর সোজা না গিয়ে বাঁক খেয়ে স্ট্যাম্পে আঘাত করল। প্রথম উইকেটের পতন ঘটল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলেও একইভাবে আরও দুটি উইকেট চলে গেল। এই বল কে নাকি স্পিন বল বলে। বর্তমানে স্পিন জাতীয় কোন বল নেই। সব বোলারই প্রচ- গতির বল খেলে অভ্যাস করে ফেলেছে। তাই স্পিন বলে সুবিধে করতে পারছে না। এলিয়েনেরা সাকিবের বল দেখে ভড়কে গেছে।
নির্ধারিত ৫০ ওভারের আগেই টাইটান একাদশ ৩০৩ রানে অল আউট হয়ে গেল। প্রথমে সাকিবের বল খেলতে অসুবিধা হলেও কয়েক ওভার পর অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অন্য সব বোলারদের তুলোধুনো করলেও সাকিব আল হাসান ১০ ওভারে ২০ রান দিয়ে নিয়েছেন ৭ উইকেট। এদিকে বলের আঘাতে আঘাতে শ্রীনির প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো। এলিয়েনেরা প্রচ- গতিতে বল করে চলেছে। পৃথিবীর বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা সেসব বোলারদের ভালোভাবেই মোকাবেলা করছে।
৪৭ ওভার পার হয়ে গেল। পৃথিবীর সংগ্রহ ৪ উইকেটে ২৪৪ রান। ৩ ওভারে প্রয়োজন ৬০ রান।
পরবর্তী ওভারের প্রথম বলেই উইকেট চলে গেল। ১৭ বলে প্রয়োজন ৬০ রান। এবার মাঠে নামলেন সাকিব আল হাসান। সাকিব মাঠে নামার সাথে সাথে সবাই আনন্দধ্বনি করতে লাগল। সবার একরকম বিশ্বাস যে সাকিব কোন না কোন ভাবে পৃথিবীকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছাড়বেন। স্ট্রাইকে সাকিব আল হাসান। বোলার বাউন্ডারি প্রান্ত থেকে দৌড়ে এসে প্রচ- গতিতে বল ছুড়ে মারল। সাকিব কোন রকমে বল ঠেকালেন। পর পর ৩টি বল হয়ে গেল কিন্তু কোন রান হলো না। সাকিব খেয়াল করলেন প্রত্যেকটা বলই বোলার একই জায়গাতে ফেলছে। চতুর্থ বলের সময় বোলার যেখানে বল ফেলে সেখানে ব্যাট চালালেন। সাথে সাথে বলটি উড়তে উড়তে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে চলে গেল। পঞ্চম বলেও একই ভাবে ছক্কা হাঁকালেন সাকিব। শেষ বলে চার। তবে এই বলটি শ্রীনির গায়ে লাগায় ৮ রান হলো। টান টান উত্তেজনা।
২ ওভারে প্রয়োজন ৪০ রান। নন স্ট্রাইকে সাকিব। নতুন ওভারের প্রথম বলেই স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেক্সওয়েল আউট হয়ে গেল। নতুন ব্যাটসম্যান আসার পর আর ২টি বল এমনিতেই চলে গেল। পঞ্চম বলে সেও আউট। শেষ বলে নতুন ব্যাটসম্যান মাসকিন এসে এক রান নিলো। মাসকিন মহাবিশ্ব কাঁপানো ফাস্ট বোলার।
এক ওভারে প্রয়োজন ৩৯ রান। সাকিব আবারো নন স্ট্রাইকে। শেষ ওভারের প্রথম বল ডট। দ্বিতীয় বলে এক রান নিয়ে সাকিবকে স্ট্রাইক দিল মাসকিন। ৪ বলে প্রয়োজন ৩৮ রান। পরবর্তী তিন বল সাকিব দেখতেই পেল না। শেষ বলে প্রয়োজন ৩৮ রান। দর্শকেরা হতাশার দৃষ্টিতে সাকিবের দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর মানুষেরা বুঝি শেষ পর্যন্ত টাইটানের এলিয়েনদের কাছে হেরেই গেল।
ইনিংসের শেষ বল করতে ছুটে আসছে টাইটানের এলিয়েন টর। প্রচ- গতিতে বল ছুড়ে মারল টর। সজোরে ব্যাট চালালেন সাকিব আল হাসান। এবার বল উড়ে উড়ে শ্রীনিবাসের বুকের বাম পাশে লাগল। অন্যসব ব্যাটসম্যানের মারের চোটে তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রচ- গতিতে বল আঘাত হানায় শ্রীনির দুর্বল হার্ট সহ্য করতে পারল না। মহাবিশ্ব থেকে শ্রীনির প্রাণ মহাশূন্যে দোল খেতে লাগল। ৫০ রান হয়ে গেল এই বলে। পৃথিবী জয় পেল ক্রিকেটের আদি পিতার অসাধারণ অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সের কারণে।
অতি উত্তেজনা বা আনন্দ নামক অনুভূতির কারণে আমার দুচোখ বেয়ে দুই ফোঁটা তরল ইউরেনিয়াম গড়িয়ে পড়ল।

Share.

মন্তব্য করুন