স্কুল ছুটি এখন। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। পরীক্ষার ফলও বের হয়ে গেছে। সে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে প্রমোশন পেয়ে উঠেছে। স্কুল খুলবে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে। খুললেই নতুন ক্লাসের পড়াশোনা শুরু হবে। এখন বাবুর কোনো কাজ নেই। বাড়িতে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের অনেক বই। বলতে গেলে রীতিমতো একটা মস্ত বড় লাইব্রেরি। পড়ার অভ্যাসও ভালো। তারপরেও মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে। কারণ বাড়ি একেবারেই জনশূন্য। কথা বলার মানুষ নেই।
ক্লাসের বইটিই কেনা হয়ে গেছে। কিছু কিছু লেখাপড়াও বাবু শুরু করে দিয়েছে। তাতে কি! বাবুর সময় যে কাটতে চায় না।
বাবুর মা-বাবা দু’জনে চাকরি করেন। মা স্কুলে, বাবা অফিসে। বাবা চলে যান সেই সকাল সাতটায়। আর মা যান সাড়ে ৯টায়। তারপর বাড়িটা খাঁ খাঁ করতে থাকে। বাবুর কাছে ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। বাবুর সঙ্গী-সাথী বলতে ঘরে কেউ নেই। তাই সে একেবারে একা। ঘরে দেলওয়ার নামে একটা কাজের ছেলে আছে। বয়সে তার থেকে দু’চার বছরের বড়। কিন্তু বাড়ির খুঁটিনাটি সব কাজ তাকেই করতে হয় বলে অবসরের সময় নেই। বাবু সহজে তাকে পায় না।
স্কুলের পাঠ্যবই ও অন্যান্য বই পড়লেও তার সময় কাটে না। সে চায় একজন সঙ্গী। সে যখন ঘুম থেকে ওঠে সে দেখে দেলওয়ারকে কাজ করতে। ঘরবাড়ি ঝাড়– দেয়া, বিছানা পত্তর গোছানো, বাথরুম পরিষ্কার করা এককথায় রান্না ছাড়া যাবতীয় কাজ দেলওয়ার একাই করে। তারপর আছে ঘন ঘন দোকানে যাওয়া।
মায়ের একটা পুরনো কাজের মেয়ে আছে। লাল চান্দ তার নাম- সে রান্না ঘরের কাজ করে।
বাবু তাকে লাল চান বুয়া বলে থাকে। মাঝে মাঝে লাল চান্দ বুয়ার ওপর বিরক্তি ধরে যায় বাবুর। কারণ সে একবারের কাজ দশবারে করায় দেলওয়ারকে দিয়ে। ছোটখাটো জিনিস আনার জন্য দেলওয়ারকে বারবার দোকানে যেতে হয়। ফলে বাবু দেলওয়ারকে তার কোনো প্রয়োজনেই পাশে পায় না।
মুখ হাত ধুয়ে চা-নাস্তা খেতে খেতে মায়েরও স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। কিছু করতে মন চায় না। তবুও তাকে মায়ের দিয়ে যাওয়া কাজগুলো করতে হয়। মায়ের দেয়া কাজ হচ্ছে অঙ্ক কষা, ইংরেজি গল্পের বই পড়ে কঠিন ও নতুন নতুন শব্দগুলো দাগ দেয়া আর অভিধান ঘেঁটে ঘেঁটে তার অর্থ বের করে লিখে রাখা। ইংরেজি গ্রামার শেখা।
মা বলেন, আমরা বাঙালি, বাঙলা আমাদের কাছে কঠিন না।
কিন্তু ভালো ইংরেজি শিখতে হলে কষ্ট করতে হবে এখন থেকেই। ইংরেজি না জানলে পৃথিবীর কোথাও ঠাঁই নেই। বাবু ঠিকই রোজ মার কাজ করে রাখে। কিন্তু তাই বলে কি প্রতিদিন রুটিন মাফিক বাঁধা-ধরা কাজ করতে ভালো লাগে? ধুত্তোরি ছাই। মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে বাবুর।
তার স্কুলের বন্ধুরা এখন পরীক্ষা শেষে কত জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ গেছে মা-বাবার সঙ্গে কক্সবাজারে। কেউবা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ইন্ডিয়া। আর সে কিনা সারা বন্ধটা ঘরে বসে ঘোড়ার ডিম ভাজছে। করবেই বা কি! তারতো স্কুলের দারোয়ান, পিয়ন ছাড়া এমন মানুুষও নেই যার সঙ্গে সে কোথাও যেতে পারে।
ছুটি কাটাবার মতো দাদার বাড়ি অবশ্য আছে। কিন্তু একেবারেই অজপাড়াগাঁ যে। শীতের দিনে ওখানে যাওয়ার কথা ভাবাও যায় না। যাওয়ার কোনো রাস্তা-ঘাট নেই। একমাত্র বর্ষায় নৌকো দিয়ে চলাচল করা যায়। কোন প্রকারে গেলেও ওখানে গিয়ে আরাম নেই। দুই চাচার সংসার এত বড় যে, ওদের নিজেদেরই জায়গা হয় না। বাবুরা গেলে ওদের খুব কষ্ট করতে হয়। তা ছাড়া আরো আছে ল্যাট্রিন সমস্যা।
ঘর থেকে বেশ দূরে খালের পাড়ে টিনের পায়খানায় যেতে তার খুব কষ্ট হয়। তার মাও ভয় পান। তাই দেশের বাড়িতে মাও যেতে চান না। নানার বাড়ি স্কুল থেকে একটু দূরে। ইচ্ছে করলে যাওয়া যায়। কিন্তু কার কাছে যাবে? নানা-নানী মারা গেছেন অনেক আগেই।
মামারা সব বিদেশে থাকেন। সারা বছরই নানার ঘর থাকে তালাবদ্ধ। ও বাড়ির আনন্দ আছে বাগ-বাগিচায়, পুকুরে। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে পুকুর পাড়ি দিতে। কিন্তু যেখানে মানুষ নেই সেখানে গিয়ে কী হবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে বাবুর মনটা বিষণœ হয়ে ওঠে।
ছোটকালে নানার বাড়িতে গেলে অনেক আনন্দ পেতো। এখন সমস্ত বাড়িটা যেনো গোরস্থানের মতো হয়ে গেছে। তাই বাবু এসব ভাবতে চায় না। এখানেও এমন কেউ নেই যাদের সঙ্গে মিশতে পারে- খেলাধুলা করতে পারে । যারা আছে তারা হচ্ছে স্কুলের মালী, বেয়ারা, দারোয়ানের ছেলেমেয়েরা। এসব ছেলেমেয়েরা সহজেই স্কুল শিক্ষিকার কোয়ার্টারে আসে না। মাও ওদের সঙ্গে মিশতে দেন না।
একদিন মা স্কুলে যাওয়ার সময় বাবু বলে, তোমরা চলে গেলে আমার একা বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না। আমার বন্ধুরা সব পরীক্ষা দিয়ে নানান জায়গা বেড়াচ্ছে। তোমরা আমাকে ঘরে বন্দী করে রেখেছো। একদিন দেখো ঠিক পালিয়ে যাবো। তখন তোমরা আমাকে খুঁজে পাবে না। বাবুর কথা বলার ভঙ্গিতে মা ভয় পেয়ে যান। উৎসুক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে কেনরে বাবা! কী হয়েছে তোর? এসব বাজে চিন্তা তোর মাথায় এলো কী করে?
কেন আসবে না, তোমরা সারাদিন বাইরে থাকো আর আমি সারাক্ষণ ঘরে বন্দী থাকব? আমার বুঝি কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন একা একা কি থাকা যায়?
সত্যিই তো ছেলেটা একা হয়ে গেছে। তারা চলে গেলে কেউতো তাকে সঙ্গ দেয়ার থাকে না। লালচান্দ তো সর্বদা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দেলওয়ার তো তার কাজ করে সময় পায় না। সেওতো ছোট মানুষ। বাবুকে সঙ্গ দেয়ার সময় কই তার?
মা কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে বাবুকে বলে এখনতো শীতকাল তাই না? তুই সামনের লনে কিছু গাছ লাগাস না কেন? দেখবি কতো ভালো লাগে। শরীরও ভালো থাকবে। তুই কাল সকাল থেকেই একটা বাগান করার চেষ্টা কর। আমি মালীকে বলে তোকে একটা জায়গা করে দেবো। প্রয়োজনে দেলওয়ারও থাকবে। দেখবি, কত ভালো লাগে। কেমন?
বাবু কতক্ষণ চুপ করে থাকে। পরে মার কথা মেনে নেয়। ঠিক আছে মা, কাল থেকে তাই করবো।
কিন্তু কাজের সময় লালচান্দ বুয়া দেলওয়ারকে বার বার ডাকতে পারবে না। লালচান্দ বুয়া তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবুর কথায় হেসে ফেলে বলে, না, না, ভাইয়া, আমি আপনার বাগান করার সময় কখনো দেলওয়ারকে ডাকবো না।
পরদিন থেকে বাবুর বাগান করার কাজ শুরু হয়। দু’দিনের মধ্যে দেলওয়ারকে নিয়ে বাবু বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটার আগাছা পরিষ্কার করে ফেলে। পরে একদিন মার স্কুলের মালির সাহায্য নিয়ে ফুলের বেডও ঠিক করে নেয়।
বাবু এখন ভীষণ ব্যস্ত। লেখাপড়াতো আছেই। লেখাপড়ার পরে একটু সময় পায় না সে। এখন আর সকালের দিকে সে মার দেয়া কাজগুলো করতে পারে না। তবে মার কাজের ছাড় নেই। তাই রাতে মায়ের আদিষ্ট কাজগুলো করতে হয়। সময়মতো নামাজও পড়তে হয়।
সকাল-বিকেল তার কাটে পড়াশুনা ও বাগান পরিচর্যার কাজে। বিকেল বেলা মা-বাবা ঘরে ফিরলে তারাও কিছুক্ষণের জন্য বাবুর বাগান ঘুরে ঘুরে দেখেন।
মাঝে মাঝে মা স্কুল থেকে ফেরার পথে নার্সারি থেকে নিয়ে আসেন নানা ধরনের মৌসুমি ফুলের চারা। ডালিয়া, কসমস, সূর্যমুখী, গাঁদা, জিনিয়া, দোপাটি, আরও কত কী!
বাবু দেলওয়ারকে নিয়ে মাটি কুপিয়ে গোবর মিশিয়ে বেডের মাটি চারা লাগানোর উপযোগী করে রাখে। চারা আসতেই দু’জনে মিলে একেক বেডে একেক রকমের ফুলের চারা লাগিয়ে দেয়।
এখন কাজ কমে গেছে অনেক। শুধু পানি দেয়া আর মাঝে মাঝে নিড়ানি দেয়া। কোনো অসুবিধা মনে হলে মালীকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নেয়। এসব কাজ করতে কি যে মজা বাবু আগে বোঝেনি।
বুঝলে এমন করে শুধু শুধু সময় নষ্ট করতো না। এত দিন ধরে সময় নষ্ট করার জন্য বাবুর আফসোসের শেষ নেই।
বাগানের জায়গার মাটিটা ভালো। তার ওপর মালী মিশিয়ে দিয়েছে সার। গাছগুলো অল্প দিনের মধ্যেই খাবার পেয়ে তরতরিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। বাবুর চোখে মুখে আনন্দ উল্লাস যেনো ঝরে ঝরে পড়ছে।
উহঃ কী আনন্দ! এই আনন্দ প্রকাশ করার ভাষা পায় না বাবু। মার প্রতিও সে কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে।
বুদ্ধি করে তিনি বড় বড় চারা এনেছিলেন বলে খুব তাড়াতাড়ি গাছগুলোতে ফুল আসতে শুরু হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে বাগানটা রঙবেরঙের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। বিরাট বিরাট গাঁদা ফুল বাগানটাকে যেনো আলো করে রেখেছে। বিদেশি হাজার রকমের ফুলের মধ্যে গাঁদা ফুলকেই বাবুর মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর।
ডালিয়া, কসমস, জিনিয়া, দোপাটি ফুটেছে অনেক। কিন্তু গাঁদার মতো এতো রূপের বাহার আর কোনো ফুলে নেই। গাঁদার কাছে সবি যেনো নি®প্রভ। চন্দ্রমল্লিকার শরীর থেকে অসংখ্য ফুলের কলি বেরিয়ে আসার প্রহর গুনছে। চন্দ্রমল্লিকার গাছগুলো বুকের মধ্যে ফুলের কলি নিয়ে পোয়াতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাগান করার পর থেকে বাবুর ঘুমও কমে গেছে। বাবার অফিসে যাওয়ার আগেই সে ঘুম থেকে উঠে অজু করে নামাজ পড়ে বাগানে চলে যায়।
প্রত্যেকটি বেডে বেডে তার সযতœ দৃষ্টি। কোন গাছের পাতায় পোকা ধরলে বাবু আস্তে করে পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে দেয়। কোনো গাছের পাতা শুকিয়ে হলুদ রঙ ধরলে তার চোখ এড়ায় না।
এখন বাবুর সঙ্গী বাগানের ফুল গাছগুলো। কোন গাছটি ভালো, কোন গাছটি অসুস্থ সে বুঝতে পারে। বাগানকে ঘিরে যেনো ফুলকুমারীদের মিনা বাজার বসেছে। এই মিনা বাজারে বেচাকেনা নেই। এখানে শুধু চোখ ভরে দেখা মন ভরে উপলব্ধি করা। বিকেলের দিকে বাগানে আসলে দেখা যায় কোথা থেকে অনেক রঙের প্রজাপতি, মৌমাছিরাও আসতে শুরু করেছে গাছে গাছে। ছোট ছোট চড়ুই পাখি পাতার আড়ালে বসে পোকামাকড় খুঁজে বেরাচ্ছে।
দুই বেলা ফুলের কাছে না গেলে তার ভালো লাগে না। ফুলগুলোও যেনো তাকে না দেখলে অভিমানে মুখ ভার করে থাকে। বলে কি গো, বাবু ভাইয়া এতো দেরিতে এলে কেন?
তোমার হাতের স্পর্শ না পেলে, আমাদের সোহাগ না করলে আমরা যে ভালো করে আকাশের দিকে তাকাতে পারি না।
আকাশ, মাটি আর তুমি এই নিয়েই তো আমাদের এই ক্ষণকালের জীবন। বাবু ওদের মনের কথা বুঝতে পারে।
বাগান এখন বাবুর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। বাগানে মাঝে মাঝে কিছু কিছু চড়–ই পাখি আসা-যাওয়া শুরু করেছে। তারা ফুলের গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। বাবুর সাড়া পেলেই ফুড়–ত করে উড়ে যায়। বাবুর মনে হয় ওরা যেনো তাকে নিয়ে কানামাছি খেলতে চায়।

Share.

মন্তব্য করুন