পিতা গরিব ছিলেন বলে তাদেরও কেন গরিব হতে হবে এ ভাবনা মাঝে মাঝেই ভাবে রহিমা। এমনকি কোন ম্যাজিক হতে পারে না যাতে তারা তাড়াতাড়ি বড়লোক হতে পারে। আর বড়লোক হয়ে ছেলে নিউটনকে ভাল স্কুল কলেজে পড়াতে পারে, ভাল ভাল খাওয়াতে পারে। এ চিন্তা থেকে সে মাঝে মাঝেই লটারির টিকিট কেনে। ক্রীড়া পরিষদ লটারি, ক্যান্সার হাসপাতাল লটারি এমন আরো কত কী। ড্রর দিন উন্মুখ হয়ে থাকে, কিন্তু কোন ড্রতেই তার লটারির নাম্বার ওঠে না। একবার ড্রয়ের পর তিন চার দিন মনমরা হয়ে থাকে সে। কিন্তু তাদের কি আর মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকার উপায় আছে! উপায় নেই তাই মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে কাজ করতে হয়।
তার এই লটারির টিকিট কেনা নিয়ে স্বামী রুহুলের ভীষণ আপত্তি। মাঝে মাঝেই বলে-
: আচ্ছা তুমি খালি খালি লটারির টিকিট কিনে খাটনি করা টাকাগুলান উড়াও কেন। তুমি কি কোনদিন শুনেছ কোন গরিব লটারির টিকেট পেয়েছে?
: পায় পায় আমি জানি। আশাই জীবন। আমিও পাবো। আর টাকা পেলে নিউটনকে ভাল স্কুল কলেজে পড়াবো।
: সে ইচ্ছে তো আমারও আছে। কিন্তু কী করব বল, হাতে টাকা পয়সা থাকে না। যা আয় করি তার পুরোটাই চলে যায় খেতে পরতে। শোন তোমাকে বলি আর টিকিট কিনো না। ওসব পাতানো খেলা। আমাদের ভাগ্যে কখনই জুটবে না।
স্বামীর এ কথার পরও টিকিট কেনে রহিমা। তবে এবার প্রকাশ্যে নয়, লুকিয়ে। কিন্তু লুকিয়ে কিনলেও লুকিয়ে রাখা যায় না। এতটুকুন একটা ঘর তাতে একটাই পুরনো ট্রাঙ্ক আর কিছু বিছানা বালিশ। রহিমা টিকিটগুলো কখনও ট্রাঙ্কে রাখে, কখনও গুঁজে রাখে বেড়ায়। আর রুহুলের চোখে সেটা ঠিকই ধরা পড়ে। ধরা পড়ামাত্র স্বামীর প্রচ- বকুনি খায় রহিমা। মাঝে মাঝে রহিমার কাছ থেকে তার কষ্টের রোজগারের টাকাও নিয়ে নেয় রুহুল। তারপরও রহিমা লটারির টিকিট কেনে।
এই সংসারে একমাত্র সন্তান নিউটন। রহিমা যেসব বাড়িতে কাজ করত তার কোনো একটা বাড়িতে একদিন সে শুনেছিল বৈজ্ঞানিক নিউটন নাকি খুব বড় মানুষ। এ দুনিয়ার অনেক বড় বড় আবিষ্কার তিনি করেছেন। তাই আজ মানুষের জীবন এত সহজ হয়ে গেছে। এমন অনেক কথা। রহিমা তখন অন্তঃসত্ত্বা। ও মাঝে মাঝেই ভাবত ছেলে মেয়ে হলে তাদের নাম কী রাখবে। একবার ভেবেছিল ছেলে হলে নবী রাসূলের নামে নাম রাখবে। মেয়ে হলে বিবি ফাতেমা বিবি খাদিজা এমন কোন নাম। আবার এক সময় ভেবেছিল রাজা বাদশার নামে নাম রাখবে ছেলে-মেয়ের। কিন্তু নিউটনের গল্প শোনার সাথে সাথে সে সিদ্ধান্ত নিলো ছেলে হলে তার নাম সে নিউটনই রাখবে। মেয়ে হলে অবশ্য ভাবতে হবে। ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল যে নিউটনের গল্প করেছিল তাকে জিজ্ঞাসা করবে কোন মহিলা বৈজ্ঞানিক আছে কিনা। থাকলে তার নামেই মেয়ের নাম রাখবে।
রহিমার ছেলে হয়েছিল। আর ছেলে হওয়ামাত্র স্বামীকে ও বলেছিল,
: ওর নাম রাখলাম নিউটন।
স্বামী আপত্তি করেছিল-
: এ আবার কেমন নাম? মুসলমানি নাম তো না।
: নামের আবার হিন্দুয়াানি মুসলমানি কি। নাম তো নামই। উনি একজন বড় বৈজ্ঞানিক। আমার ছেলে ওর মত হবে।
রুহুল সেদিন মনে মনে হেসেছিল। আবার চোখে পানিও এসেছিল তার। সন্তানকে নিয়ে বাবা-মা কত স্বপ্নই যে দেখে। কিন্তু তার কতটা তাদের মত লোকেরা পূরণ করতে পারে।
সেই ছেলে বড় হয়, কথা বলতে শেখে, হাঁটতে শেখে, দৌড়াতে শেখে, ওর স্কুলে যাবার বয়স হয়। কিন্তু রহিমা রুহুল ওকে স্কুলে পাঠাতে পারে না। আজ কাল স্কুলে অনেক খরচ। বইপত্র স্কুল ড্রেস, বেতন। প্রতি মাসে নিয়ম করে বেতন দেবে কি করে? তা ছাড়া আজকাল নাকি স্কুলে ভর্তি করলেই হয় না, মাস মাস টিচারের পেছনে টাকা গুনতে হয়। স্কুলে নাকি কোন লেখাপড়াই হয় না। সে টাকাই বা আসবে কি করে। আর টিচার না রেখে তারা পারবেও না। কারণ দু’জনের কেউই তারা লেখাপড়া জানে না। এতসব খরচ জোগানো কোনোভাবেই তাদের পক্ষে সম্ভব না। এমনিতেই তাদের দিন চলে না। একবেলা খেলে আর একবেলা উপোস দিতে হয়। তার মধ্যে যদি অসুখ বিসুখ হয় তাহলে তো একেবারেই না খেয়ে থাকতে হয়। এর মধ্যে ছেলেকে পড়াবে কি করে।
ছেলেকে যে লেখাপড়া শেখাতে পারছে না এ দুঃখ সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে রহিমাকে। রুহুলের দুঃখও যে কম তাও না। মাঝে মাঝেই রহিমা বলে,
: কোথায় ভেবেছিলাম ছেলেটা নিউটনের মত বৈজ্ঞানিক হবে আর তাকে কিনা আমরা স্কুলে দিতে পারলাম না।
: তুমি ভেবেছিলে বৈজ্ঞানিক হবে আর আমি ভেবেছিলাম ও হবে জজ ব্যারিস্টার। আদালতে বসে কালো গাউন গায়ে হাতুড়ি ঠুকে বলবে, অর্ডার অর্ডার। একটা সিনেমায় দেখেছিলাম জানো। কিন্তু দু’জনেরই চোখ ছলছল করে। তখন পাশে এসে দাঁড়ায় নিউটন। ওর পরনের প্যান্টটায় তালি দেয়া, জামাটাও অনেক পুরনো। মা ওর দিকে তাকায়,
: কিরে কিছু বলবি?
: বলছিলাম কি মা, আমিতো এখন বড় হয়েছি। আমার বন্ধুরা সবাই কাজ করে। আমি শুধু বসে খাই। ওরা কেউ মোট বয়, কেউ রিক্সা চালায়, কেউ ইট ভাঙে। আর তোমরা আমাকে কিছুই করতে দাও না। এটা ঠিক না। আমি কিছু করলে আব্বার কিছুটা সাহায্য হয়। আমি এক মহাজনের কাছে একটা রিক্সা ঠিক করে এসেছি। কাল থেকে রিক্সা চালাবো।
: বলে কি পাগল ছেলে! আরে তুই কি রিক্সা চালাতে জানিস নাকি?
: জানি জানি, শিখে নিয়েছি। ও খুব সোজা ব্যাপার। তোমরা ভেবো না। আমি ঠিকই চালাতে পারব।
কথা বলেই উঠোনের অন্য ধারে বন্ধুদের সাথে ডাঙ্গুলি খেলতে বসে যায় নিউটন। রহিমা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এখন ওর খেলা আর পড়ারই বয়স। সবে তো বারোতে পড়েছে। এই বয়সে ও নাকি রিক্সা চালাবে। ও প্যাডেল ঘোরাবে কি করে। পা কি প্যাডেল পর্যন্ত যাবে ওর? রহিমার বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে।
একই ভাবনা ভাবছিল রুহুলও। নিউটনের দিকে তাকিয়ে ওর মন ভীষণ খারাপ হয়। এই কচি ছেলেটা নাকি কাল থেকে রিক্সা চালাবে। কিন্তু রিক্সা না চালিয়েই বা করবে কি ও ! কাল না চালালে পরশু চালাতে হবে ওকে, পরশু না হলে তার পরদিন। এর হাত থেকে তো ওর মুক্তি নেই। হয় রিক্সা চালাবে না হলে মোট বইবে না হলে ইট ভাঙবে এটাই ওর কপাল। মন খারাপ নিয়ে ঘর থেকে বের হয় রুহুল। রাস্তা দিয়ে হাঁটে আর ভাবে রহিমা লটারির টিকিট তো শুধু শুধু কেনে না। ওর ওতো একটাই মাত্র ছেলে। ও মা, ওর ওতো ইচ্ছে করে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে, ভালোভাবে মানুষ করতে। রুহুল ভাবে, লটারির টিকিট কেনা নিয়ে রহিমাকে আর সে কিছু বলবে না। বলা তো যায় না একদিন হয়ত সত্যিই লটারিতে প্রাইজ বেঁধে যাবে। সেদিন নিউটনকে এখানে না, আমেরিকা পড়তে পাঠাবে সে। এই ভাবনা নিয়েই পথ চলে রুহুল। বস্তির অন্যরা তখন কাজ থেকে ফিরছে। রুহুলের কাজ আজ একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে। সালাম ওকে দেখে বলে,
: কি রুহুল ভাই আজ কাজে যাওনি?
: যাইনি মানে। কাজে না গেলে আমাদের চলবে কি করে, আমরা খাবো কি?
এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। সালাম জবাব চায়ও না। ও ঘরের দিকে যেতে থাকে আর রুহুল হাঁটতে থাকে রাস্তার দিকে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে রুহুলের। নিউটনের মত তার ছেলেবেলাটাও কেটেছে কষ্টে। পিতা মারা গিয়েছিলেন অল্প বয়সে। তেমন জমিজমাও তাদের ছিল না। যেটুকু যা ছিল ঠকিয়ে নিয়েছিল শরিকেরা। মা আর দাদি বাড়ি বাড়ি খেটে তাকে মানুষ করেছিল। মার একটাই স্বপ্ন ছিল তাদের হারানো জমিটুকু যেন সে বড় হয়ে উদ্ধার করে। মাঝে মাঝেই বলতেন সে কথা,
: আমার রুহুল বড় হবে। কামাই করতে শিখবে। আর সে কামাইয়ের টাকা দিয়ে আমাদের হারানো জমিটুকু উদ্ধার করবে। আবার আমাদের গোলায় ধান উঠবে, ঢেঁকিতে পাড় পড়বে, উঠোনে ধান নাড়া আর ঝাড়া হবে। আমরা পিঠে বানাবো, পায়েস রাঁধবো।
দাদি মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতেন,
: আমি চালের আগা কেটে খুদ বানাবো, সেই খুদে খুদ ফুটাবো। শহরের লোকেরা নাকি ওটাকে বলে বউ খুদ। কি কা- গ্রামের খুদ ফুটানো শহরে গিয়ে হয়ে গেল বউ খুদ। আর শোন বউ পোলাউয়ের চাল রাখব আলাদা করে। মাঝে মাঝেই রুহুলকে পোলাউ রান্না করে দেবো সাথে ঘরের মুরগি আর হাঁসের ডিম ভাজি।
অনেক স্বপ্ন ছিল মা আর দাদির। বড় সে ঠিকই হয়েছে, টুকটাক কামাই করতেও শিখেছে। কিন্তু গ্রামের প্রভাবশালী লোকদের সাথে পাল্লা দিয়ে সে জমি উদ্ধার করতে পারেনি। চেষ্টা করতে গিয়ে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ‘যদি সে জমি উদ্ধারের চেষ্টা করে তার লাশ পড়বে।’ তাই আর চেষ্টা করেনি। অন্যের জমিতে বেগার দিয়েই তার দিন কেটেছে। এর মাঝে মুক্তিযুদ্ধ বেধে গেছে। সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। যুদ্ধ শেষে বীরের বেশে দেশে ফিরেছে। কিন্তু তার ভাগ্য বদলায়নি। দাদি মারা যাবার পর সে মাকে নিয়ে শহরে এসেছে। এখানেই দুঃখ কষ্টে মাকে নিয়ে কাটিয়েছে। বস্তির ঘরে পাশাপাশি থাকত রহিমারা। মাই পছন্দ করে রহিমাকে বউ করে এনেছে। তারপর একসময় মা-ও চলে গেছেন। আর তার দুই বছর পর সংসারে এসেছে নিউটন। সে নিউটনকে ভাল মত খেতে দিতে পারে না, পরতে দিতে পারে না, স্কুলে পাঠাতে পারে না। এমনই অক্ষম পিতা সে। রুহুল মাঠের কিনারায় ঝিম মেরে বসে থাকে। ওর কিছুই ভাল লাগে না। এমন কতক্ষণ কেটেছে জানে না সে। হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকায়। নিউটন দাঁড়িয়ে,
: আব্বা কি হয়েছে। এখানে একা একা বসে আছ কেন?
: এমনি। তুই কোথায় গেছিলি? এই যে তোকে বাড়িতে ডাঙ্গুলি খেলতে দেখে এলাম?
: ডাঙ্গুলিই খেলছিলাম। তারপর ভাবলাম ছেলেরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে দেখে আসি। তাই দেখছিলাম।
রুহুলের মনে পড়ে আজ চৈত্র সংক্রান্তি। গ্রামের মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব চলছে। বাচ্চাদের সবার হাতেই রঙবেরঙের ঘুড়ি। কেউ মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে, কেউ ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। রুহুল স্কুলের ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে নিউটনের বয়সের অনেক কিশোর। তাদের সবার হাতে ঘুড়ি। ঘুড়িতে ঘুড়িতে ছেয়ে গেছে সারাটা আকাশ। কী যে ভালো লাগছে সে আকাশ দেখতে। আকাশে যেন লাল নীল হলুদ সবুজের মেলা। রুহুলের মন কেমন করে। তার ছেলে ওই মেলার অংশীদার হতে পারল না। কেন কেন সে পারবে না, অবশ্যই পারবে। পকেটে হাত দেয় রুহুল। শ তিনেক টাকা আছে পকেটে। এ টাকায় ঘুড়ি আর লাটাই হয়ে যাবে।
: চল বাবা।
: কোথায়?
: ঘুড়ির দোকানে। তোকে ঘুড়ি আর লাটাই কিনে দেব
: সত্যি বলছ আব্বা। আমি ভয়ে তোমাকে বলিনি। তোমার হাতে পয়সা নেই। যদি তুমি মন খারাপ করো তাই।
: আরে না, আব্বাকে অত ভয় পেতে আছে নাকি। যা ইচ্ছে করে বলবি। আমি পারলে সাথে সাথে দেব, না পারলে পয়সা জমিয়ে পরে দেব।
ওরা ঘুড়ির দোকানের দিকে হাঁটতে থাকে। পথে বেলুনওয়ালাকে দেখে থমকে দাঁড়ায় রুহুল। নিউটনকে বলে
: বেলুন নিবি?
আজ যেন নিউটনের পাওয়ারই দিন। ও খুশির আতিশয্যে বলে,
: নেব আব্বা, নেব।
: এই বেলুন কত করে?
: তিরিশ টাকা
রাগি গলায় রুহুল বলে,
: তুমি বেশি দাম..
এই পর্যন্ত বলে থমকে যায় রুহুল। আজ ছেলেকে সাথে নিয়ে বেলুন কিনতে এসেছে সে। এমন আর কোনদিনই আসেনি। আজ সে কারো সাথে রাগারাগি করবে না। নিজেকে সংবরণ করে নিউটনকে বলে,
: কোন দুটো নিবি দেখ, পছন্দ কর-
নিউটন বিস্ময়ের সাথে বলে,
: দুটো!
: হ্যাঁ দুটো, কেন বেশি চাস?
: না না আব্বা দুটোই অনেক।
নিউটন বেছে বেছে বেলুন পছন্দ করে। রাহুল তাকে দুটো বেলুন কিনে দেয়। এরপর আরো এগোয়। সামনে গজা মিছরি কদমা খই বিক্রি হচ্ছে। রুহুল থমকে দাঁড়ায়। দোকানিকে বলে,
: পঞ্চাশ টাকার গজা আর পঞ্চাশ টাকার কদমা দাও।
দোকানি গজা কদমা ঠোঙায় ভরে নিউটনের হাতে দেয়। নিউটনের চোখ চকচক করে। রুহুল বলে,
: জানিস নিউটন, আমরা যখন ছোট ছিলাম এমনই গজা কদমা বিক্রি হত আমাদের গ্রামে। আর বিক্রি হত হাওয়াই মিঠাই। এখন এই ঢাকা শহরে ওগুলো মাঝে মাঝে দেখি। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলাকার মত না। আমাদের ছেলেবেলায় ওগুলোর সাইজ ছিল ছোট ছোট। কিযে মজা ছিল খেতে। আর পাওয়া যেত চিনি দিয়ে বানানো আম লিচু। সেগুলো লাল সাদা সবুজ নানা রঙের হত। একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করত সেগুলো। ওসব আর এখন কোথাও দেখি না। আর একটা জিনিস পাওয়া যেত, ভাঙাড়িরা আসত বাড়ি বাড়ি। তারা ভাঙা কাচের বিনিময়ে কটকটি বিক্রি করত।
: কটকটি কি জিনিস আব্বা?
: সে গুড় দিয়ে বানানো একরকম জিনিস। কি যে মিষ্টি খেতে! আমি খালি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভাঙা কাচ জোগাড় করতাম। আর ভাঙাড়ি এলে সেগুলো দিয়ে কটকটি কিনতাম। দাদি খুব বকতেন আমাকে,
: অত খাস না, অত খাস না। তোর কিন্তু ক্রিমি হবে। হতোও। কিন্তু আমি শুনতাম না।
নিউটন বিস্ময় নিয়ে শুনছিল। আব্বা থামতেই ও বলে,
: থেমো না আব্বা। আরো বলো। আমার যে কি ভাল লাগছে। তোমার ছেলেবেলাটা আমার চেয়ে অনেক ভাল ছিল।
: তা ছিল বাবা, সত্যিই ভাল ছিল। আমরা গ্রামে থাকতাম। সেখানে গাড়ি ঘোড়া ছিল না, বাতাস দূষিত ছিল না, শাকপাতা যাই-ই খেতাম টাটকা খেতাম। নদী ছিল, বড় বড় পুকুর ছিল। মাটির দাওয়া আর টিনের ঘরে থাকলেও সে ঘর এত ছোট ছিল না। সে ঘরে জানালা ছিল। আমাদের উঠোনে আমগাছ ছিল, সে গাছে পাখি এসে বসত। আমরা গাছ থেকে নারকেল পেড়ে খেতাম। পানি শুকিয়ে গেলে বিল থেকে মাছ ধরতাম। শাপলা আর কচুপাতা দিয়ে মা সে মাছ রান্না করতেন। সত্যিই আমার শৈশবটা সুন্দর ছিল।
: আব্বা আরো বল।
: আমাদের গরু ছিল। সেই গরু নিয়ে মাঠে চরাতে যেতাম আমি। খুঁটো পুঁতে গরু ছেড়ে দিলে ও নিজের মত ঘাস খেয়ে বেড়াত। আর আমি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে কখনও বাঁশি শুনতাম আবার বাঁশি শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও পড়তাম।
: কে বাঁশি বাজাতো?
: রাখাল ছেলেরা। তখন অনেকেই তাদের গরু দেখাশুনা করার জন্য লোক রাখত। তাদের গরুর রাখার বলা হত। রাখাল মানে যে রাখে। অনেক রাখাল খুব ভাল বাঁশি বাজাতো। ওরাও গরু চরতে দিয়ে গাছে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজাত। আর সে বাঁশির সুর এতটাই সুন্দর ছিল যে ঘুম এসে যেত। একদিন এক মজার কা- হয়েছিল।
: কি হয়েছিল বল না আব্বা?
: আর বলিস না, আমি গরু নিয়ে মাঠে খুঁটি পুঁতে দিয়ে বসে বসে বাঁশি শুনছিলাম। কি যে ঝিরঝিরে বাতাস বইছিল তখন। একদিকে বাঁশির সুর, অন্য দিকে ঝিরঝিরে বাতাস কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ আমার এক বন্ধু এসে ধাক্কা দিয়ে আমাকে জাগালো,
: এই তুই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস আর ওদিকে দেখ তোর গরু খোঁয়াড়ে দিয়ে দিয়েছে।
: খোঁয়াড় কি আব্বা?
: সেটা ধর গরুর জেলখানা। মানুষ অন্যায় বা অপরাধ করলে যেমন জেলে পাঠানো হয় গরুকেও তাই পাঠানো হয়। ওটা একটা ঘেরা জায়গা। গরু হয়ত কারো বেড়া ভেঙে দিয়েছে, কারো ক্ষেতের সবজি খেয়ে নিয়েছে তখন তারা ধরে গরুকে খোঁয়াড়ে দেয়। যার গরু তাকে তখন ক্ষতিপূরণ দিয়ে গরু ছাড়িয়ে আনতে হয়। খোঁয়াড় মালিককেও কিছু দিতে হয়। তা আমার গরু খুঁটা উপড়ে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল আরেক জনের ক্ষেতে। তার ক্ষেতের বেগুন গাছ তছনছ করে দিয়েছে। তাই ওরা তাকে ধরে খোঁয়াড়ে দিয়েছে।
: কী মজার কা- গরুর আবার খোঁয়াড়!
: তুই তো এখন মজা পাচ্ছিস। কিন্তু সেদিন যে আমার কি অবস্থা হয়েছিল। গরু ছাড়ানোর পয়সা আমি কোথায় পাব। আর মা যদি শোনে আমি গরু চরাতে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাহলে আর রক্ষা রাখবে না। গরু নিয়ে মাঠে আসার সময় মা বার বার বলে দেন, ‘দেখিস ঘুমিয়ে পড়িস না যেন। গরু যেন খুঁটি উপড়ে কোনদিকে ছুটে না যায়।’
: তারপর কি হল আব্বা?
আর কি, আমি ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ফিরলাম। আমাকে একা ফিরতে দেখে এগিয়ে এলেন মা। এদিক ওদিক তাকিয়ে গরু না দেখে রাগি কণ্ঠে বললেন,
: গরু কোথায়?
: আমি তো তো করে বললাম, খোঁয়াড়ে। মা লাঠি হাতে তেড়ে এলেন আমার দিকে।
: এত করে তোকে বলে দিয়েছি গরুর খেয়াল রাখতে আর এখন তুই বলছিস গরু খোঁয়াড়ে। এই গরু খোঁয়াড়ে গেল কি করে? তুই কি ঘুমিয়েছিলি নাকি অন্য ছেলেদের সাথে খেলতে চলে গেছিলি? কী সর্বনাশ তুই করলি বল দেখি। এখন গরু ছাড়ানোর পয়সা আমি পাবো কোথায় … বলতে বলতে আমার দিকে তেড়ে এলেন মা। আর তার চেয়েও জোরে ছুটে এলেন দাদি। বললেন,
: তোমার এত বড় সাহস বৌমা আমার নাতির গায়ে হাত তোল। নাতি আমার আঁধার ঘরের সলতে। গরু খোঁয়াড়ে গেছে কিছু গচ্ছা যাবে। তা কি আর করা যাবে। আমার কাছে সামান্য কিছু জমানো আছে। ওটা দিয়েই গরু ছাড়াবো।
: মা তুমি কথায় কথায় জমানো ওই সামান্য টাকায় হাত দাও। এর পরে যখন বড় কোন বিপদ হবে কি করবে তুমি?
: এটাও বড় বিপদ। এই গরুই তো আমাদের সম্বল। রোজ দুই সের দুধ দেয় এই গাই। এই দুধের পয়সায় আমরা চলি। একদিন গরু খোঁয়াড়ে থাকা মানে একদিনের দুধ মার যাওয়া। সেটা কি তোমার মাথায় আছে বৌমা? আমি যাচ্ছি গরু ছাড়াতে। তুমি কিন্তু খবরদার আমার নাতির গায়ে হাত দেবে না। না থাক তোমাকে বিশ্বাস নেই। চল দাদু আমার সাথে, চল।
: দাদি আমাকে সাথে নিয়ে গরু ছাড়াতে গেছিলেন। যাদের ক্ষেতের সবজি নষ্ট করেছিল টাকা দেয়ার পরও গজ গজ করছিল তারা। এক পর্যায়ে রেগে গেছিলেন দাদি,
: আমার গাই তোমার ক্ষেতের সবজি নষ্ট করেছে তার জন্য তোমরা যা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছ দিয়েছি। এরপর আবার কথা কি? এরপরও যদি কথা বল আমার টাকা আমাকে ফেরত দাও। গালমন্দই যদি শুনব টাকা দেবো কেন? কই দাও?
এরপর ওরা চুপ করে গেছিল। দাদি বড় শক্ত মানুষ ছিলেন। সহজে কারো কাছে মাথা নোয়াতেন না। দাদি যতদিন বেঁচে ছিলেন আমরা ভালোই ছিলাম। তিন দিনের জ্বরে দাদি মারা গেলেন। মারা যাবার আগে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
: তোর মাকে দেখিস দাদু। ও বড় নরম মনের মেয়ে। আমি ওকে কোনদিন ছেলের বৌ মনে করিনি। মেয়ে মনে করেছি বরাবর। আমি চলে গেলে ওর বড় কষ্ট হবে। তুই ওকে দেখিস। সাথে সাথে রাখিস।
: তখন আমি কতটুকু বল, এই ধর আঠারো উনিশ বছর বয়স। দাদি চলে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে একদিন আমাদের গোয়াল থেকে গরু চুরি হল। সবাই জানে কারা নিল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আর জনা বিশেক লোক এসে বলল, আমাদের বাড়িটা নাকি দাদি তাদের কাছে বিক্রি করে গেছেন। জমি জমাতো আগেই শরিকেরা নিয়ে নিয়েছিল। এবার শেষ সম্বল বাড়িটায় হাত দিল। প্রতিবাদ করার কিছুই ছিল না তারপরও আমি প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করেছিলাম। আর তখনই আগের মত আবারো হুমকি এসেছিল। মা বলেছিলেন,
: ছাড়ান দে বাপ। চল আমরা শহরে চলে যাই। সেই শহরে আসা,
: তাহলে আব্বা তোমার গ্রামের লোকগুলো তো খুবই খারাপ ছিল,
: না সবাই খারাপ ছিল না। ভাল লোকও কিছু ছিল। কিন্তু তারা খারাপ লোকের ভয়ে কিছু বলত না। আমাদের জন্য তাদের মায়া দয়া ঠিকই ছিল কিন্তু আমাদের পাশে দাঁড়াবার সাহস ছিল না।
কথা বলতে বলতে ওরা আরো এগোয়। মাঠের একপাশে নাগরদোলা ঘুরছে। সেদিকে তাকিয়ে আব্বা বলেন,
: জানিস আমাদের ছেলেবেলায় পৌষ সংক্রান্তির মেলা হত। তখন নাগরদোলা আসত। আরো কত কিছু যে আসত সে মেলায়। পুতুল নাচ হতো। আমি একবার পুতুল নাচ দেখেছিলাম। কি যে মজার! পুতুলদের একজন রাজা হয়, একজন রাণী, একজন সেনাপতি আর রাজার হিংসুটে সৎমা। সে এক দারুণ মজার ব্যাপার। ঠিক আছে একবার তোকে পুতুল নাচ দেখাবো। আর শোন আমাদের গ্রামে যাত্রাও হত। নবার সিরাজউদদৌলা, ক্লিওপেট্রা এইসব যাত্রা। সারারাত ধরে চলত সেসব যাত্রা। আমরা খড়ের ওপর বসে দেখতাম। মাঝে মাঝে দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়তাম। আবার তরবারির ঝনঝনানিতে ঘুম ভেঙে যেত। কি সব ঝলমলে পোশাক পরে আসত ওরা। তখন আমার রাজা হতে ইচ্ছে করত। রাজা তো হলাম না হলাম কাঠমিস্ত্রির যোগালে। যাকগে যাক, চল তোকে ঘুড়ি কিনে দি,
ওরা ততক্ষণে ঘুড়ির দোকানে এসে পড়েছে। আব্বা বলেন,
: কোনটা নিবি দেখ?
: কোনটা ভাল ওড়ে?
: এই যে এই এরোপ্লেন মার্কা ঘুড়িটা। এটা নে। দারুণ উড়বে। সবার ঘুড়ি ও কেটে দেবে। আর এই যে লাটাই সুতা আর মাঞ্জা।
ঘুড়ি পেয়ে আনন্দে লাফাতে থাকে নিউটন। আব্বাকে বলে,
: তুমি বাড়ি যাও আমি একটু ঘুড়ি উড়িয়ে আসি।
: তুই ওড়া, আমি বসে বসে দেখি।
(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন