শহীদ আফ্রিদি, মিসবাহ-উল হকসহ একঝাঁক তারকা ক্রিকেটারের বিদায়ের পর পাকিস্তান দলটি যাচ্ছে একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। তরুণরাই এখন দলের প্রধান ভরসা। তাই গত কিছুদিন ধরেই যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না পুরনো পাকিস্তানকে। তবে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিজেদের পুরনো ছন্দে ফিরেছে দলটি। সরফরাজ আহমেদের নেতৃত্বে এই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জিতেছে পাকিস্তান। এরপর গত মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজেও রীতিমতো বিধ্বস্ত করেছে শ্রীলঙ্কাকে। আর এর পুরো কৃতিত্বই একঝাঁক তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটারের। তাদের মধ্যে অন্যতম পেসার হাসান আলী। ডানহাতি এই তরুণ মিডিয়াম পেসার এখন শুধু পাকিস্তান নয়, সারা বিশে^ই অন্যতম সেরা বোলার।
তার সম্পর্কে একটি কথাই বলা যায়- এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। অভিষেকের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ^ ক্রিকেটকে মুগ্ধই করে চলছেন ২৩ বছরের এই তরুণ। খুব বেশি গতি নেই বলে, কিন্তু হাসান আলীর সবচেয়ে বড় অস্ত্র বৈচিত্র্য আর নিখুঁত লাইন-লেন্থ। ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করতে প্রতিনিয়ত বোলিংয়ে পরিবর্তন আনেন হাসান। নতুন, পুরনো সব বলেই করাতে পারেন সুইং। যার মাধ্যমে আদায় করে নেন বিশ^সেরা ব্যাটসম্যানদের সমীহ। অনেক দিন ধরে প্রতিভা সঙ্কটে ভুগতে থাকা পাকিস্তানের পেস বোলিং অ্যাটাক সমৃদ্ধ হয়েছে তার ছোঁয়ায়। মোহাম্মদ আমিরের সাথে তার বোলিং জুটি যেন মনে করিয়ে দেয় ওয়াসিম-ওয়াকার যুগের কথা।
২০১৬ সালের আগস্টে ডাবলিনে স্বাগতিক আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হাসান আলীর। প্রথম ম্যাচে ৫ ওভার বোলিং করে কোন উইকেট না পেলেও এরপর ইংল্যান্ডের মাটিতে তাদের সাথে ওয়ানডে সিরিজের চার ম্যাচে নিয়েছেন ৮ উইকেট। এ বছর জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েও কাঁপিয়ে দিয়েছেন স্মিথ বাহিনীকে। ৫ ম্যাচের সিরিজে একটি ৫ উইকেটসহ নিয়েছেন ১২ উইকেট। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরটাও খারাপ কাটেনি। তবে নিজেকে মেলে ধরতে হাসান বেছে নিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বড় আসর। প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে এক উইকেট নিলেও ফাইনাল পর্যন্ত পরের প্রতিটি ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন তিনের নামতা গুনে (দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও ভারত)। পাঁচ ম্যাচে মোট ১৩ উইকেট নিয়ে হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। প্রতিটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষ দলের ওপর দাপট দেখিয়ে দলকে নিয়ে গেছেন সেমিফাইনাল, ফাইনাল থেকে শিরোপার দ্বারপ্রান্তে। অথচ টুর্নামেন্ট শুরুর আগে পাকিস্তানকে কেউ সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই গণ্য করেনি। র‌্যাংকিংয়ে ৮ নম্বর দল হিসেবে তারা খেলতে এসেছিলো টুর্নামেন্টে।
গত মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজেও হাসানের চমক দেখেছে বিশ্ব। উভয় সিরিজেই সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার হয়েছেন তিনি- যথাক্রমে ১৪ ও ৬ উইকেট নিয়ে। দুই সিরিজেই হোয়াইটওয়াশ হয়েছে শ্রীলঙ্কা। এই সিরিজে হাসান গড়েছেন একটি বিশ^ রেকর্ড। চলতি বছর ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার এখন তিনি। ২০১৭ সালে ১৮ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ৪৫ উইকেট। পেছনে ফেলেছেন আফগান লেগস্পিনার রশিদ খানকে (৩৬ উইকেট)। সিরিজের চতুর্থ ও ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের ২৪তম ম্যাচেই পৌঁছে গেছেন ৫০ উইকেটের ক্লাবে। ওয়ানডেতে তার চেয়ে কম ম্যাচ খেলে ৫০ উইকেট পেয়েছেন ইতিহাসে মাত্র তিনজন বোলার। তবে পাকিস্তানের পক্ষে দ্রুততম ৫০ উইকেট শিকারি বোলারের রেকর্ড এখন তার। তিনি টপকে গেছেন ২৭তম ম্যাচে ৫০ উইকেট পূর্ণ করা ওয়াকার ইউনিসকে। সেই সাথে নিজেকে তুলে এনেছেন আইসির ওডিআই বোলিং র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানে। অভিষেকের মাত্র ১৪ মাসের মাথায় র‌্যাংকিংয়ে সেরা হওয়ার ঘটনা বিরল। সব মিলে ২৬ ওয়ানডেতে হাসান আলীর শিকার ৫৬ উইকেট। চলতি বছরেই তিনবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন। আর ১২ টি- টোয়েন্টিতে উইকেট ১৮টি। মাত্র দুটো টেস্ট খেলছেন এই পেসার, নিয়েছেন ৬ উইকেট। সংবাদমাধ্যম তাইতো তার নাম দিয়েছে ‘উইকেট টেকিং বোলার’।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্ম নেয়া এই ডানহাতি মিডিয়াম পেসারের ক্রিকেট জীবন শুরু হয়েছে আঞ্চলিক পর্যায়ের বয়সভিত্তিক দল দিয়ে। জাতীয় পর্যায়ে নজর কেড়েছেন ২০১৫ সালের পাকিস্তানের ঘরোয়া ন্যাশনাল টি-টোয়েন্টি কাপে। প্রতিভা দেখেই পাকিস্তান সুপার লিগের প্রথম আসরেই তাকে দলে ভেড়ায় পেশোয়ার জালমি। এরপর ঘরোয়া ওয়ানডে টুর্নামেন্টে ১৭ উইকেট নিয়ে নজর কেড়েছেন জাতীয় দলের নির্বাচকদের। তার জন্য খুলে যায় পাকিস্তান জাতীয় দলের দরজা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হাসান আলী শুরুটা হয়েছে সাদামাটা ভাবে; কিন্তু যতই সময় গড়িয়েছে, তিনি দিয়েছেন যোগ্যতার পরিচয়। অন্যসব বিখ্যাত পেসারদের মতো নয়, হাসান আলী সাধারণত বোলিং করেন ইনিংসের মাঝখানের ওভারগুলোতে। এই সময়টাতে ব্যাটসম্যনরা একটু দেখে শুনে এক-দুই রানের জন্য খেলেন। আবার বেশির ভাগ ম্যাচেই এই সময় ক্রিজে থাকেন সেট হওয়া ব্যাটসম্যানরা। তাই মাঝখানের ওভারগুলোতে উইকেট নেয়া স্বাভাবিকভাবেই কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই কী অবলীলায় করে যাচ্ছেন এই মিডিয়াম পেসার!
বড় ভাইয়ের উৎসাহে ক্রিকেটার হওয়া হাসান নিজের অবস্থান প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ছোটবেলায় ক্রিকেট নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো আমার। স্বপ্ন ছিলো বিশে^র সেরা বোলার হবো।’ গতি আর বাউন্সের ঝড় না তুলেও যে ব্যাটসম্যানদের কাবু করা যায় তা যেন আরো একবার বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছেন এই পাকিস্তানি পেসার। ক্যারিয়ার দীর্ঘ হলে হয়তো তার মাঝে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে আরেক কিংবদন্তি বোলারকে।

Share.

মন্তব্য করুন