ছোট্ট বন্ধুরা কেমন আছো? আশা করি তোমাদের আব্বু, আম্মু, বড় ভাই কিংবা বোনসহ সবাই ভালো আছো নিশ্চয়ই! সুস্থ, সুন্দর ও দীর্ঘজীবী হোক তোমাদের জীবন, এই দোয়া কামনা করছি। যদিও তোমরা এখন খুবই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছো কারণ খুব কাছেই তোমাদের বার্ষিক পরীক্ষা। অনেকের আবার শুরু হয়ে গেছে। যত ব্যস্ততাই থাক তার মাঝেও বলতে চাই, আমরা যেন সবাই বড়দের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ, ভক্তি এবং ছোটদের প্রতি আদর, স্নেহ, মায়া-মমতা, দরদমাখা অকৃত্রিম হিতাকাক্সক্ষী হতে পারি। হয়ত বুঝতে পেরেছো! মূল কথা হলো, আমরা যেন সকলেই বড়দের যথার্থ সম্মান, শ্রদ্ধা, ভক্তি করতে পারি এবং তাদের দেখানো সুন্দর, শাশ্বত পথে চলতে পারি সেই সাথে হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ, মায়া, মমতা জড়ানো ভালোবাসায় ছোটদের আকৃষ্ট করে সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। জানো বন্ধুরা! এই ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালার প্রিয় হাবিব এবং আমাদের প্রিয় নেতা, নবীকুল শিরোমনি রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের অল্প বয়স্কদের প্রতি দয়া ও স্নেহ করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান দেখায় না, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।” (তিরমিজি)
এই ব্যাপারে পবিত্র আবু দাউদ শরিফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হতে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে, “যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি স্নেহ ও দয়া দেখায় না, আমাদের বড়দের অধিকার চেনে না, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়।”
হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, আমি নবী করীম (সা) কে বলতে শুনেছি, “হতভাগ্য খারাপ প্রকৃতির লোকদের হৃদয় হতে দয়া ও করুণা কেড়ে নেয়া হয়।”
বন্ধুরা, এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির মুখ থেকে কত গুরুত্বপুর্ণ ও অর্থবহ কথা আমাদের জন্য এসেছে, যা শুধুমাত্র মুসলমান নয়, গোটা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য মাইলফলক। তিনি যা বলেছেন, তার কোন তুলনা নেই, যার পরিধি বিস্তৃতি এতটাই বিশাল যে, আমরা যদি মেনে চলি এবং মেনে চলার পরিবেশ তৈরি করতে পারি তাহলে দুনিয়াটা পরিণত হবে জান্নাতের মত।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ মৌলিক নির্দেশ প্রাপ্তির পরও আজ আমাদের অবস্থা এমনই যে, ছোটদের প্রতি স্নেহ আর বড়দের প্রতি সম্মান আমাদের মধ্যে থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে। যার কারণে পরিবেশ এতটাই নিচে নেমেছে যে, আমরা নিজেরা নিজেদের এতটাই স্বাধীন মনে করি যে, তাতে মনে হয় আমরা কেউ কাউকে চিনি না, কেউ কারো ধার ধারি না। ছোটদের প্রতি দয়া আর বড়দের প্রতি সম্মান বিলুপ্ত হওয়ায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র হতে ভ্রাতৃত্ব, হৃদ্যতা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, সম্প্রীতি, মায়া, মমতা, স্নেহ, প্রীতি, দরদ, আন্তরিকতা অনেকটা না থাকার মতই। যদিও কিছুটা থেকেও থাকে, তা একেবারেই সীমিত পরিসরে এবং নিজস্ব গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর এই সীমাবদ্ধ সম্মান আর ভালোবাসা দিয়ে গোটা দেশের মানুষের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর জীবনটাকে সুন্দর, সাবলীল, অর্থবহ ও সার্থক করতেই আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। দুনিয়ার সেই মানুষকে হাতে কলমে বাস্তবে শিখানোর জন্যই নবী মুহাম্মাদ (সা)কে প্রেরণ করেছেন। আর নবী (সা) কে পাঠানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’য়ালা তার পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “তোমাকে সারা জাহানের প্রতি রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) ছোট্ট বন্ধুরা! পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা যতগুলো সূরা, যতগুলো আয়াত নবী (সা)-এর ওপর নাজিল করেছেন তা কিন্তু শুধুমাত্র রাসূল (সা) এর জন্যই নয়, তা প্রত্যেকের জন্যই। আল্লাহ্ রাসূল (সা)-এর ওপর যখন যে আয়াত বা নির্দেশ নাজিল করতেন তখন হতেই তিনি তা মেনে চলতেন এবং মানার জন্য মানুষকে আহবান করতেন। তার আহ্বানে যারাই সাড়া দিয়েছেন তারাই সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন। নিজেদেরকে সম্মানের আসনে আসীন করেছেন। নেয়ামতে ভরা এই পথে শামিল হওয়ার জন্য এককালে সর্বনিকৃষ্ট মানুষ কাতারে কাতারে ছুটে এসেছেন। রাসূল (সা) এর পবিত্র সান্নিধ্য পেয়ে সবাই হয়েছেন সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ। আহা ! সে কি দৃশ্য! যা দুনিয়ার কোন চোখ দেখেনি, কোন হৃদয় ভাবেনি। মানুষ মানুষের প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল, আন্তরিক, স্নেহশীল তা দেখে মনে হতো সবারই এক দেহ, এক প্রাণ, একই সূত্রে গাঁথা সবার প্রত্যাশা। নিজের জীবনের মূল্য ছিল না; তবে সবার কাছে সবার জীবন অমূল্য। সবাই সবার কল্যাণে ছিল বদ্ধপরিকর।
একবার ওমর ফারুক (রা) দ্রুত হাঁটতে গিয়ে সামনে পড়লেন এক বয়স্ক মানুষ। যার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেয়েছে, যিনি কানে কম শোনেন, যার চোখ দুটো ঝাপসা, শরীরে বার্ধক্যের পরিপূর্ণ ছাপ। যে পথে ওমর ফারুক (রা) যাচ্ছেন সেই পথ ধরে বয়স্ক মানুষটি ধীর পায়ে হেঁটে চলছেন। উনাকে দেখে ওমর ফারুক থমকে গেলেন। কারণ তার মনে পড়ে গেল রাসূল (সা) এর সেই অমিয় বাণী, “যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি স্নেহ ও দয়া দেখায় না, আমাদের বড়দের অধিকার চেনে না, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়।” মনে হওয়া মাত্রই বয়স্ক মানুষটির সম্মানে তার হাঁটার গতি কমিয়ে দিলেন। ওমর ফারুক (রা) সন্তর্পণে তার নিরীহ শিশুসুলভ আদবে পিছু পিছু হাঁটছিলেন আর ভাবছিলেন, যদি আমি তার আগে যাই আর তিনি যদি মনে কষ্ট পান এই ভেবে আজ আমার বয়স হয়েছে ওর মত হাঁটতে পারি না বলে সে আমাকে পেছনে রেখে বেয়াদবের মত এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তাকে পেছনে ফেলে যদি আমি এগিয়ে যাই তাহলে তিনি হয়ত অসম্মান বোধ করতে পারেন। আগে পিছে অনেক কিছু ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যত ক্ষতিই হোক, রাসূল (সা)-এর শেখানো কথার বাইরে কিছু করে তার দলের বাইরে যাবো না। এমনি ভাবতে ভাবতে বেশ অনেকটা সময় পার হলে বয়স্ক মানুষটি তার গতিপথ পরিবর্তন করে তার গন্তব্যের দিকে ঘুরে চলতে থাকলেন। ওমর ফারুক (রা) সুযোগ পেয়ে গেলেন এবং বাকি পথটুকু হারানো সময়টুকু পুষিয়ে নিতে দৌড়াতে শুরু করলেন। এবড়ো-থেবড়ো মরুপথ দৌড়ে রাসূল (সা) এর কাছে পৌঁছালেন বটে; কিন্তু যথাসময়ে পৌঁছাতে পারলেন না। যখন তিনি আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর সামনে দাঁড়ালেন তখন তিনি রীতিমতো হাঁফাচ্ছিলেন। তার অবস্থা দেখে আল্লাহর রাসূল (সা) অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ওমর, উপস্থিতির ব্যাপারে তুমি তো কোনদিন এমনটি করনি? আজ হঠাৎ তোমার বিলম্ব হওয়ার কারণ কী? ওমর ফারুক (রা) থেমে থেমে সব কথা খুলে বললেন। তার মুখে বিস্তারিত ঘটনা শোনার পর রাসূল (সা) এর মুখে একটা অম্লান মুচকি হাসি ফুটে তা নীলদিগন্তে সুখের বারতা ছড়িয়ে মিলিয়ে গেল, তার একটু ¯িœগ্ধ পরশ ওমর ফারুক বিন খাত্তাব এর হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
ছোট্ট বন্ধুরা, মনে রেখো, আল্লাহর রাসূল (সা) যার ওপর খুশি হবেন, আখেরাতের কঠিন হাশরের ময়দানে তার স্থান জান্নাত ছাড়া আর কোথাও হতে পারে না। তোমাদের এইটাও মনে রাখতে হবে দুনিয়াতে যে মানুষ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, দল রাসূল (সা)-এর দেখানো পথে চলবে এবং অন্যদের মেনে চলার আহবানে তৎপর থাকবে কেবল সেই মানুষ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, দলের ওপর রাসূল (সা) সন্তুষ্ট থাকবেন, আর তাদেরই সেদিন কোন বিন্দুমাত্র পেরেশানি থাকবে না।
আমরা না বুঝে অথবা সাময়িক বৈষয়িক স্বার্থে শ্রদ্ধাভাজন আব্বা, আম্মা, বড় ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বয়স্কদের সাথে দুর্ব্যবহার করে থাকি তা কারো জন্যই কখনই কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, যারা বয়সে বড় তারা যদি কুরআন, সুন্নাহর আলোকে সেই শিক্ষার অনুসারী হয়ে থাকেন তাহলে তাদের চলার পথটাই আমাদের চলার পথ হতে পারে। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে তারা কিছু বুঝেন না, যারা তা ভাবেন তা হতে পারে রাসূল (সা) এর আদেশ বা নির্দেশিত পন্থার বিপরীত কিংবা হতে পারে তা চরম অকৃতজ্ঞতা। পৃথিবীতে যিনি এক বছরের বড় তার অভিজ্ঞতা বর্তমান উঠতি বয়সের যে কোন মানুষটির চেয়ে বেশি। শুধুমাত্র বয়সের কারণে বয়স্ক সম্মানিত মানুষটিকে খাটো করে দেখা বা হেয়প্রতিপন্ন করা অথবা এড়িয়ে চলা হতে পারে এক ধরনের বেয়াদবি। প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর গুরুত্বপুর্ণ এবং মৌলিক কাজ হচ্ছে জীবন উৎসর্গ করে হলেও আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা) এর সন্তুষ্টি অর্জনের স্বার্থে এবং নিজের আখেরাতকে নিষ্কণ্টক করতে ঐক্য বজায় রাখা। এই ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৩) আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের অল্প বয়স্কদের প্রতি দয়া ও স্নেহ করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান দেখায় না, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।” (বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি শরিফ)
ছোট্ট বন্ধুরা এসো, আমরা রাসূল (সা)-এর কথামত তাঁর দেখানো পথে চলে সম্মান, শ্রদ্ধা, দয়া ও স্নেহের পরিবেশ গড়ে তুলে আমাদের বসবাসের পৃথিবীকে নুতনের জন্য সুন্দর গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলি, যাতে শেষ বিচারের দিবসে আমরা মুক্তিলাভ করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকেই তাঁর এবং তাঁর রাসূলের (সা) প্রদর্শিত পথে চলার তৌফিক দান করুন।

Share.

মন্তব্য করুন