ইদরিস। বারো বছরের চঞ্চল শিশু। কৈশোরের নতুন হাওয়ায় পাল তোলা এক স্বপ্নতরী। মুসলিম পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়নি। গ্রামের মক্তবে পড়ে সে। মংডুর উত্তর পাশের হোয়াইছং গ্রামে বসবাস তাদের। কয়েকদিন ধরে মক্তবও বন্ধ হয়েছে সেনাবাহিনীর ভয়ে। বিকেলের অবসরে খেলতে গেছে বাড়ির পাশের মাঠে। চঞ্চলা মাঠে খেলার হৈ হুল্লোড়। হঠাৎ গুলির শব্দ। আঁতকে ওঠে সবাই। আতঙ্কে ছোটাছুটি চারিদিকে। এলোপাতাড়ি গুলিতে রক্তাক্ত শরীরে টলে পড়ে অনেকেই। কেউ কেউ স্পট ডেড। কেউ আবার আহত অবস্থায় পালিয়ে জীবন বাঁচায়। মাথায় গুলির আঘাত পেয়ে দেড় ঘণ্টা মাঠেই পড়ে থাকে ইদরিস। অনেক রক্তক্ষরণ হলেও মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় প্রাণে বেঁচে ছিল। আহত অবস্থায় অনেক কষ্টে পরিবারের সদস্যদের কাঁধে বাংলাদেশে এসেছে সে। তার বন্ধু শফিসহ বেশ কয়েকজন মারা গেছে খেলার মাঠেই। ছলোছলো চোখে কাতরকণ্ঠে সে বলে, আমরা বুঝে ওঠার আগেই অনেকগুলো গুলি এসেছে, আমি গুলি লেগে মাঠেই পড়ে গেছি, আমার বন্ধু শফি মরে গেছে মাঠেই।
সিনেমা কিংবা নাটকের কোন দৃশ্য নয় এটা। ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসী কোন গ্রুপের কাজও নয়। সভ্যসমাজের সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাচারী আচরণ। স্বেচ্ছাচারিতা বললেও ভুল হবে। একটি জনগোষ্ঠীকে জাতিগত নির্মূলের জন্যই এ ধরনের নৃশংস গণহত্যা। মিয়ানমারের ‘রাখাইন স্টেট’ নামে পরিচিত আরাকান রাজ্যে এ ধরনের ঘটনা নিত্যদিনের। শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার অপরাধে সেখানকার রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর নির্মূলে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এ অভিযানের কোনো শেষ নেই। প্রতিনিয়ত গণহত্যার শিকার হচ্ছে আরাকানের যুবক, তরুণ থেকে শুরু করে নারী-শিশু ও বৃদ্ধ। জীবন বাঁচাতে পাহাড়ি জঙ্গলময় পথ এবং খাল-নদী পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে।
মিয়ানমারের পূর্ব নাম বার্মা। আরাকানের নামও এখন ‘রাখাইন স্টেট’। মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার জন্যই আরাকানকে রাখাইন স্টেট নাম দেয়া হয়েছে। আর রাতারাতি মগরাও পরিচিত হচ্ছে রাখাইন নামে। এখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুলি করে নির্বিচারে। বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে সব শেষ করে দেয়। মগদস্যুদের মতো রাখাইনরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে দিনে দুপুরে খুন করে সবাইকে। যুবতী নারীদের তুলে নিয়ে যায়। শ্লীলতাহানি শেষে হত্যা করে। তরুণ-কিশোরদের প্রতি ওদের রাগ বেশি। অনেক কষ্ট দিয়ে হত্যা করে তাদের। অবুঝ শিশু এবং নারীরাও রেহায় পায় না তাদের হাত থেকে। রোহিঙ্গাদের পক্ষে সেখানে কেউ নেই পাশে দাঁড়াবার।
‘মগের মুল্লুক’ শব্দটির সাথে পরিচয় আমাদের সকলের। আরাকানি মগ-বৌদ্ধদের মাত্রাহীন জুলুম-নির্যাতনের প্রেক্ষিতে এ বাগ্ধারাটি আজও প্রচলিত। মধ্যযুগের সে ইতিহাসকে পেছনে ফেলে আরো একধাপ এগিয়ে গেছে মিয়ানমারের সেনাকর্তৃপক্ষ। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চিও সেনাবাহিনীর করতলে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। অন্ধভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন তাদের অপকর্ম। সেই সুযোগে গৌতম বুদ্ধের আদর্শধারী গেরুয়া পোশাকে আবৃত মগ-বৌদ্ধরাও ধারালো অস্ত্র হাতে নেমে পড়েছে রোহিঙ্গাদের পাড়ায় পাড়ায়। তাদের ধর্মে জীবহত্যা মহাপাপ হলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করলে কিংবা রোহিঙ্গা নারীদের শ্লীলতাহানি করলে কোন পাপ নেই। হায়রে ধর্মীয় দর্শন! হায়রে শান্তির ফেরিওয়ালা!
রাখাইন রাজ্যে জন্ম নেয়া, বেড়ে ওঠা শিশুদের চোখে কোন রঙিন স্বপ্ন নেই। ফ্যাকাশে চোখে তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বাসযোগ্য পৃথিবীর পরিবর্তে তারা উপহার পাচ্ছে লাশের মিছিল। লাশের ধ্বংসস্তূপ ও মৃত্যু উপত্যকা থেকে ইদরিসের মতো পালিয়ে এসেছে অসংখ্য শিশু। পিতা-মাতার সঙ্গে কিংবা অভিভাবকহীন হয়ে বাংলাদেশে আসা লাখো রোহিঙ্গা শিশু এখন জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকিতে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের থাকার জায়গা দিয়েছে। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে শারীরিক-মানসিক চিকিৎসা দেয়ার। পরম মমতায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু এতে কি ফিরে আসবে শিশুদের জন্য একটা বাসযোগ্য পৃথিবী! আশ্রয় শিবিরে এখন ওদের বসবাস। মানবিক বিপর্যয়ের এক নিদারুণ ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাদের ওপর দিয়ে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকার ঠেলে শিশুরা আলোর পথে বেরিয়ে আসতে পারবে তো?
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই প্রায় আড়াই লাখ। এসব শিশুর ৬০ ভাগই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। শিশু-কিশোররা এখন নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। এদের কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছে। কারও মা-বাবাকে চোখের সামনেই হত্যা করেছে মিয়ানমারের মগ-সেনারা। অনেকেই বাবা-মা হারিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেশ ছেড়েছে। অভিভাবক ছাড়াই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা শিশুই সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সর্দি-কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখি।
যেসব শিশুর মা আছে তারাও চরম কষ্টে পড়েছেন। অভুক্ত শিশুদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে দৌড়াচ্ছেন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। পাশাপাশি অসুস্থ শিশুদের নিয়ে লাইন দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা ক্যাম্পে। উখিয়ার বালুখালী, কুতুপালং, পালংখালী পানবাজারসহ বিভিন্ন চিকিৎসা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা মায়েরা সন্তান কোলে নিয়ে ভিড় করছেন চিকিৎসার জন্য। প্রেসক্রিপশন কিংবা ওষুধ পেলেও অনেক মা’ই বুঝতে পারছেন না ব্যবস্থাপত্র। কিভাবে ওষুধ খাওয়াবেন সেই নিয়ম বুঝছেন না। তাই তারা যাকেই দেখতে পাচ্ছেন ক্যাম্পে তাদের কাছ থেকে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছেন ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম-কানুন।
কুতুপালং শরণার্থী শিবির এলাকায় একটি মিসিং সেন্টার খোলা হয়েছে। ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় এই সেন্টার খোলা হয়। প্রতিনিয়ত সেন্টারের সামনে করুণ পরিবেশ। মিসিং সেন্টারে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে পিতা-মাতা হারানো শিশু। স্বজন ফিরে পাওয়ার কান্নার রোল সেখানে। সন্তান হারানো পিতা-মাতাদের ভিড় যেমন আছে এখানে তেমনি পিতা-মাতা হারানো শিশু। তাদের খুঁজে পাওয়ার পর এখানে জমা রাখা হয়। কিছুক্ষণ পরপর মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় শিশুর খোঁজ পাওয়ার কথা। উখিয়া-টেকনাফের রাস্তায় রাস্তায় কিংবা ক্যাম্পে ক্যাম্পে নিষ্পাপ ও কোমল-কচি শিশুমুখের ছড়াছড়ি। এসব শিশু এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকেই যাত্রা শুরু করেছে। কেউ জানে না তাদের এই যাত্রা কোথায় গিয়ে শেষ হবে।
রুমানা। বারো বছরের কিশোরী। আবদুর রহিম। সাত বছরের শিশু। ভাইবোন তারা। মিসিং সেন্টারে কাঁদছে এতিমের মতো। সত্যিই যে ওরা এতিম হয়ে গেছে চিরদিনের মতো। মগরা বাবাকে মেরে ফেলেছে আগেই। পালিয়ে আসার সময় পথেই মারা যায় তাদের আহত মা। আহত ভাইটিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও পারেনি। একদিকে ক্ষুধা তৃষ্ণা অন্যদিকে আহত শরীরের রক্তক্ষরণে সেও মারা যায় রাস্তাতেই। সাথে আসা প্রতিবেশীদেরও হারিয়ে ফেলেছে তারা। অন্যদের সাথে কোনমতে প্রাণে বেঁচে নাফ নদী পেরিয়ে এসেছে। কে বা কারা তাদের মিসিং সেন্টারে রেখে গেছে। চোখে মুখে শুধু হাহাকার। কান্নার দাগ যেন শুকনো নদীর স্মৃতিচিহ্নের মতো দাগ হয়ে আছে চোখের নিচে। কে তাদের ভালোবাসবে! বড় হওয়ার স্বপ্ন তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার কল্পনাই এখন তাদের বড় চ্যালেঞ্জ। অত্যাচারের ভয়াবহতা। বাবার হত্যা। আহত মা এবং ভাইয়ের মৃত্যু। জঙ্গলে তাদের লাশ ফেলে আসা। সব যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করছে তাদের। গোটা জীবন হয়তো তাড়িয়ে বেড়াবে এ ভয়াবহ স্মৃতি।
নয়ন। আট বছরের শিশু। সে মাটিতে গা এলিয়ে ছিন্নকাপড়ে নীরব হয়ে আছে মিসিং সেন্টারে। এই সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নাজির আহমদ জানান, শিশুটির গায়ে খুব জ্বর। তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে। সে কিছু বলতে পারে না। সব সময় আতঙ্কিত। বাবা মা সবাইকে মেরে ফেলেছে মগরা। বাড়িঘরও পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। পথঘাট চেনে না। অন্য কোন এক প্রতিবেশী তাকে এখানে রেখে গেছে। এমন মানসিক চাপ নিয়ে বেঁচে আছে অসংখ্য শিশু। মানসিক চাপ কমাতে ইতোমধ্যে শিশুদের খেলাধুলা ও গল্প বলার মাধ্যমে বিনোদনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিভিন্ন সংগঠন। এ পর্যন্ত কুতুপালং, লেদা ও শ্যামলাপুরে স্থায়ী তিনটিসহ ছয়টি শিশুবান্ধব কেন্দ্র এবং কিশোরী ক্লাব স্থাপন করেছে তারা। কিন্তু এসবের মাধ্যমে কতজন শিশুকেই বা ফিরানোর যাবে জীবনের স্বাভাবিক পথে!
নুরভার বেগম। আরাকানের তামবাজার বৈদ্যপাড়ায় তার বাড়ি। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। সন্ধ্যার আলো নিভতেই তাঁদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয় সেনাবাহিনী। চোখের সামনেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে তাদের বাড়িঘর। সেনাসদস্যদের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে দুর্গম পাহাড়ে লুকিয়ে রাত কাটায় তারা। এরপর পায়ে হেঁটে পাহাড়, টিলা, খাল-নদী পেরিয়ে আট দিন পরে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে উখিয়ায় আসেন। পুরো নয়টি দিন কেটেছে অনাহারে-অর্ধাহারে। এমতাবস্থায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন নুরভার। তার চার বছরের শিশুকন্যা ফাতেমা। সর্দি-কাশি ও জ্বরে ছটফট করছে মেয়েটিও। মেয়ের পাশে মাটিতে পড়ে আছেন মা নুরভার বেগম। দাঁড়ানোর শক্তি নেই তার। পাহাড়ি পথে হেঁটেছে, খাল-পানি পার হয়েছে। রাত্রি কেটেছে পাহাড়ের জঙ্গলে। বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে কোন রকমে জীবন নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। তার চোখে কি আর কোন দিন হেসে উঠবে সুখের সংসারের মিষ্টি আলো?
জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমসহ প্রতিটি মিডিয়ায় শিশু-কিশোর কিংবা বৃদ্ধ-নারীসহ অসহায় মানুষের ছবি এখন অহরহ। ফেসবুক, টুইটারসহ অনলাইন জুড়ে নির্যাতনের বীভৎস চিত্র। রোহিঙ্গা শিশু কিশোরদের ওপর নির্মম অত্যাচারের এসব দৃশ্য দেখে কোন মানুষ সুস্থ থাকতে পারে না।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। বহু কষ্টে তাদের ঠাঁই মিলছে পাহাড় ও সমতলে। এর মধ্যে বেশি কষ্টে দিনযাপন করছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা। কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে ঠাঁই পাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এখানে শিশু-কিশোরদের রোগ বালাই অনেক বেশি। পাহাড়ে ত্রিপল দিয়ে গড়ে তোলা বসতিতে বৃষ্টির পানি ও ঢলে বেহাল অবস্থা। যৎসামান্য খাদ্যও ভিজে নষ্ট। খাদ্যের অভাবে দিশেহারা। ভিজে কাদামাটির ওপর নির্ঘুম রাত কাটায় তারা। রাতে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। দিনেও তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। তবু তারা বাঁচতে চায়। হাসতে চায় সুন্দর জীবনের আলোয়। স্বপ্ন দেখতে চায় স্বাধীন বসতভিটের। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত আরাকানে তারা ফিরে যেতে চায় নিরাপত্তার সাথে। বিশ্ববিবেক! স্বপ্নগুলো উড়ে যাচ্ছে ঘরপোড়া ধোঁয়ার সাথে। ওদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে এগিয়ে এসো। আবার শুরু হোক সুখের স্বপ্ন। হেসে খেলে বেড়ে উঠুক নিজের বসতবাড়িতে। সবাই মিলে আওয়াজ তুলি ‘রোহিঙ্গা শিশুদের হাসতে দাও’।

Share.

মন্তব্য করুন