কিশোর পাতার নতুন প্রজন্মের ভাই-বোনেরা!
আশা করি ভালো আছো। তোমরা আমার শুভেচ্ছা নিও।
বুকের মধ্যে দুর্বিষহ ব্যথা ভার আর অসহায় বোবা যন্ত্রণা নিয়ে আমি লিখতে বসেছি। গত ২৫ আগস্টের পর থেকে পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ছে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে স্রোতের মতো লাখ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ অবিরাম পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। কেউ কেউ আসছে নৌকায় নাফ নদী পাড়ি দিয়ে। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে নাফ নদীতে নৌকাডুবিতে অনেকেই মারাও যাচ্ছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। তাদের লাশ তোলা হচ্ছে এপাড়ে। রাখা হচ্ছে রাস্তার পাশে। বার্মা টাইমসের এক বরাতে দেখা যাচ্ছে নৌকা দিয়ে পালিয়ে আসার সময় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা নাফ নদীতে ডুবে যায়। বাংলাদেশ বর্ডারগার্ডের ভাষ্য মতে, অসংখ্য শিশু ও নারীর লাশ তারা নাফ নদী থেকে উদ্ধার করেছে। একদিন টেলিভিশনে দেখলাম চারটি মাসুম বাচ্চার লাশ পানির ¯্রােতের ধাক্কায় নদীর কিনারায় এসে ভেসে আছে। এই পাড়ের লোকেরা লাশ তোলার ব্যবস্থা করছে। এই শিশুরা স্বার্থ বুঝে না হিংসা বুঝে না অথচ অহিংস ধর্মের তল্পিবাহক রাখাইনের উগ্র বৌদ্ধদের ও সামরিক বাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়ে নাফ নদীর পানিতে লাশ হয়ে ভাসছে। যে মায়েরা সন্তানকে বুকে ধরে বড় করার স্বপ্ন দেখছে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে পূর্বপুরুষের ভিটেয় নিশ্চিত জীবন কাটাবে ভাবছিলো তারা হঠাৎ বাস্তুহারা এবং আশ্রয়ের খুঁজে দিশেহারা হয়ে নদী পাড়ি দিতে জীবন হারাচ্ছে। আরেক দিন দেখলাম একজন ২০-২২ বছরের যুবক বৃদ্ধা মাকে কাঁধে বসিয়ে নদী পার হচ্ছে বাংলাদেশ আসার জন্য। এই ধরনের অনেক মর্মান্তিক অসহনীয় ছবি প্রতিদিন খবরের কাগজসহ সকল মিডিয়াতে দেখতে পাচ্ছি।
নাফ নদী ছাড়াও সীমান্তের নানা দিক দিয়ে রোহিঙ্গারা দলে দলে ¯্রােতের মতো প্রতিদিন বাংলাদেশে আসছে এবং অনেকেই আবার পথেই সন্তান জন্ম দিচ্ছে। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন কেউ সঙ্গে নেই। খাবার নেই, পানি নেই। পথের সঙ্গীদের সাহায্যে সন্তান প্রসবের পর আবার দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যাচ্ছে চাদর দিয়ে দোলনা বানিয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে বসিয়ে সন্তানরা কাঁধে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে নদী-নালা পার হয়ে দুর্গম বনে জঙ্গলে লুকিয়ে উপবাসে-অনাহারে দিনের পর দিন যাপন করে বাংলাদেশে ঢুকছে। এখন প্রশ্ন আমার- অতর্কিত রোহিঙ্গাদের এই বিপর্যয়ের কারণ কী? কারণস্বরূপ সামান্য কিছু ইতিহাস থেকে বলতে চাই, ‘তাওয়ারিখে ইসলাম আরাকান ও বার্মা’ নামক গ্রন্থে দেখা যায় ঈসায়ী অষ্টম শতাব্দীর কোনো এক সময় একটি আরব দেশীয় বাণিজ্য জাহাজ আরাকান অঞ্চলের কাছে নিমজ্জিত হয়। নিমজ্জিত জাহাজের নাবিকরা ‘রহম রহম’ শব্দ করে উদ্ধারের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করে। তাদের এই চিৎকার সমুদ্র তীরবর্তী আরাকানবাসীরা শুনতে পায়। পরবর্তীকালে এসব উদ্ধারপ্রাপ্ত নাবিকরা আরাকানে বসবাস শুরু করেন। আরবি ভাষায় অনভিজ্ঞ আরাকানিরা তাদের রহম নামে ডাকতে শুরু করে। এই রহমান শব্দটি আরাকানিদের বিকৃত উচ্চারণে রোহিঙ্গা নামে পরিচিত পায়। আরাকানের নাম মিয়ানমার হওয়ার পরে মিয়ানমারের একটি প্রদেশের নাম রাখাইন আর অধিবাসীদের নাম রোহিঙ্গা হয়। রাখাইন খনিজসম্পদে ভরপুর একটি প্রদেশ। রোহিঙ্গারা রাখাইন প্রদেশের আদি বাসিন্দা হলেও স্বার্থান্ধ মগ, বৌদ্ধ সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের জাতিগতভাবে এই দেশ থেকে নির্মূল করার জন্য বহুবার নানাভাবে নানা কৌশলে বিতাড়নের চেষ্টা করেছে খনিজসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের নেশায়। কারণ রাখাইন রাজ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলমান রোহিঙ্গারা জনসংখ্যার দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে। বহুদিন ধরে রোহিঙ্গাদের নানাভাবে নির্যাতিত, অপমানিত এবং নাগরিকত্ববিহীন জীবন কাটাতে বাধ্য করা হচ্ছিলো।
ইতিহাস ঘাঁটলে রোহিঙ্গাদের এই পর্যায়ে আসার অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
আমি রাখাইন প্রদেশের বা রোহিঙ্গাদের প্রাচীন ইতিহাস লিখতে বসিনি। অতি সম্প্রতি একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ওখানকার রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনী, উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দানবীয় প্রতিহিংসার নজিরবিহীন আক্রমণে রোজ কেয়ামতের দাবানল জ্বলে উঠেছে। এবং তাদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য এই নৃশংস বিতাড়ন শুরু হয়েছে।
উগ্র বৌদ্ধ এবং সেনাবাহিনীর অত্যাচারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যারা এখানে এসেছে এবং যারা ওখানে এখনো আটকা পড়ে আছে এবং বীভৎস অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের সবার কথা না বলে আমি শুধু অসহায়, বিপন্ন নারী ও শিশুদের মর্মান্তিক দুঃখ, দুর্দশার কাহিনী তোমাদের শোনাতে চাই।
২৫ শে আগস্টে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর রাখাইনের বৌদ্ধরা এবং মুসলিম রোহিঙ্গাবিদ্বেষী জনগোষ্ঠী সমগ্র এলাকার মানুষের জীবনকে পশুর মতো করে দিয়েছে। রাখাইনের একজন অভিবাসী আব্দুর রহমান নামের মাছ বিক্রেতার ভাষ্যমতে, রাখাইনের উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা একজন নারীকে গুপ্তচর সন্দেহে চুল কেটে তার হাতে বেঈমান সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে গোটা শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছে। আশ্রয় শিবিরের সোলেমা নামের এক নারীর কাছে শোনা যায়, ঈদের চারদিন আগে সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। বাড়ির পুরুষদের ঘর থেকে বের করে আনে। মেয়েদের ওড়না কেড়ে নিয়ে পুরুষদের গলায় পেঁচিয়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। কাউকে কাউকে আবার জবাইও করা হয়েছে। কাউকে আবার ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেছে। সামিরা নামের একটি মেয়ের মুখে শোনা গেলো, তার বাবা ও ভাইদের হত্যা করা হয়েছে এক রুমে। অন্য রুমে বোনদের ওপর চালিয়েছে পালাক্রমে নির্যাতন। তার গায়ে হাত দিতে এলে সে দৌড়ে বের হয়ে নৌকায় ওঠে। সে কোথায় যাচ্ছে ভাবার সময় পায়নি। কারো কোনো খবরও রাখেনি।
উখিয়ার কাস্টমস ছড়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া এক মেয়ের নাম মিনারা। তার বাড়ি মিয়ানমারের বুচিডং এলাকায়। তার স্বামীকে বর্মিরা মেরে ফেলেছে। সে জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে শরণার্থী ক্যাম্পে খুব কষ্ট পাচ্ছে। সন্তানদের নিয়ে কোথাও যেতে পারছে না। যেসব নারী জীবনের ভয়ে এখানে এসেছে তাদের এখানে এসেও স্বস্তি নেই। যে সমস্ত তাঁবুতে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে সেগুলো বৃষ্টি, কাদা আর বাতাসে তছনছ হয়ে গেছে। আরো শোনা গেলো, সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে অভিভাবকরা চরম নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন। একজন মা, তার মেয়ে সম্পর্কে বললেন, তিনি মেয়েকে নিয়ে খুবই ভয়ে আছেন। কিছু কিছু লম্পট ও পতিতাপল্লীর দালালরা তার মেয়ের দিকে কুনজর দিচ্ছে। মিডিয়ার সকল স্তরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিম নারীরা প্রায় সকলেই পর্দানশীন। এমন নির্মম অত্যাচার, দুঃখ, কষ্টে, অনাহারে পিষ্ট হয়েও আবরুহীন নয় কেউ। ওদের খুব অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। প্রথমত টয়লেট আর পানির জন্য। অনেকে নামাজ পড়ে কিন্তু পাক সাফ হওয়ার কোনো উপায় নেই। গোসল নেই, গায়ে দুর্গন্ধ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। টেকনাফ, রামু এলাকায় দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু মেয়ে ঐ এলাকার আবাসিক লোকদের বাড়িতে ওজু, গোসল ও নামাজের কাজ সারছে। কুতুপালংয়ের এক তাঁবুতে দেখা যাচ্ছে জয়নব নামের এক নারী, একই জায়গায় খাওয়া, শোওয়া, মলমূত্র ত্যাগ করতে হচ্ছে। কুতুপালংয়ের পাহাড়ে হোপ ফাউন্ডেশনের একটি মেডিক্যাল ক্যাম্পে নারী ও শিশুদের একটি দীর্ঘ লাইনের কথা হচ্ছে পত্রিকায়। এসব শিশু প্রায় সবাই সর্দি, কাশি, ডায়রিয়ায় ভীষণভাবে আক্রান্ত। সবার শরীরে চর্মরোগ। বহু মেয়ে আসছে ধর্ষণের শিকার হয়ে। অথচ এসব মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় তারা ভীষণ মানসিক যাতনা ও অসুবিধায় আছে। অনেক মেয়ে বর্মি সেনাদের জুলুমের কাহিনী বললো। বহু মেয়েকে বর্মি সেনারা জুলুম করার পরে মেরে ফেলেছে।
অনেক পোয়াতি নারী নিজের জীবন বাজি রেখে বর্মি বাহিনীর আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসার সময় জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্রবিহীন, স্বপ্নবিহীন, ভবিষ্যৎতহীন কিছু সন্তান। নিজের জীবনের দুঃখ, দুর্দশার কথা ভুলে গিয়ে তাদের এখন প্রধান চিন্তা সন্তান কিভাবে বাঁচাবে।
পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, আনুমানিক চার শতাধিক রোহিঙ্গা শিশু পথে জন্ম নিয়েছে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার ‘নো ম্যান ল্যান্ডে’। অনেক শিশু জন্মের পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কিছু কিছু নারীর জীবনে আরো এক ধরনের নবতর সমস্যার চিত্র দেখা যাচ্ছে, অবিবাহিত সুন্দরী মেয়ে যারা এসেছে তারা অপহৃত হচ্ছে, প্রতারক চক্রের হাতে পড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের নামে আরেক অজানার দেশে পাড়ি দিচ্ছে। সহিংসতা শুরুর পর থেকে যারা বন জঙ্গলে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। ষোল থেকে আঠারো হাজার গর্ভবতী নারী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার হিসাব মতে, শিশুর সংখ্যা দুই লাখের অধিক। অনেক শিশু এসেছে অপরিচিত জনের হাত ধরে। বর্মি সেনারা ওদের পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, শরণার্থীদের ৬৩% শিশু। এই নারী ও শিশুরা সবচেয়ে অসহায় এখানে। বাংলাদেশের মানুষের মানবিক চেতনায় ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ আছে বলেই প্রায় সবাই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়েছে। দৃশ্যমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয় শুধু সরকারি সাহায্য বা আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে অনেক রোহিঙ্গা অনাহারে মারা যেতো। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য যত সম্ভব শিগগিরই সামাজিক ও কর্পোরেট সংস্থাগুলির এগিয়ে আসা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে সোচ্চার হয়েছে তেমনিভাবে তাদের পিতৃভূমিতে ফিরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সোচ্চার হউক। রাখাইন বা আরাকান তাদের পিতৃভূমি। এই ভূমি থেকে তারা চিরতরে উৎখাত হউক এটা কখনো কারো জন্যই কাম্য হতে পারে না। এই ব্যাপারটি শুধু মিয়ানমারের সাথে সমঝোতা করে সমাধান করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের এই কঠিন সমস্যাকে সমাধান করতে হবে। আমাদের সবার কামনা হউক ভিনদেশের এই সব নিরীহ মানুষগুলো আশাহীন, ভরসাহীন জীবনপাত না করে নিজেদের পিতৃভূমিতে ফিরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিক।

 

Share.

মন্তব্য করুন