বহু দিন আগের কথা, আরাকান রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। গ্রামের নাম কুসুমপুর। গ্রামে সহজ সরল মানুষ বাস করত। তারা কৃষিকাজ করে বা মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। খুব সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে মিলেমিশে দিন কাটছিলো। মারামারি হানাহানি হিংসা-বিদ্বেষ কিছুই ছিলো না। সকলে যেনো একটি পরিবার। কিন্তু সে সুখ আর বেশিদিন সইল না। গ্রামে দেখা দিল এক ভুতুড়ে কা-। গ্রামের পশ্চিম দিকে একটি নদী বয়ে গেছে, নদীর পাশ দিয়েই গঞ্জে যাবার রাস্তা। আর রাস্তার পাশেই একটা বটগাছ। আর বটগাছের নিচে একটা বিশাল পাথর অবস্থিত। সেটি বহু বছর থেকে সেখানে পড়ে আছে, কবে থেকে আছে তার ইতিহাস কেউ সঠিক বলতে পারে না। দৈত্যাকারের মত পাথরের দেহ, মনে হয় এই গিলে খাবে। পাথরের পেছনের দিকে ঘন অন্ধকার, আর নিচ দিয়ে একটা গভীর সুড়ঙ্গ। অনেকটা ঘরের মত। গ্রামের কেউ ওই গভীরে প্রবেশ করে নি। কারণ বহু বছর আগে একদিন একদল কৃষক ক্ষেতে কাজের পর বটগাছের নিচে পাথরে হেলান দিয়ে বিরতি নিচ্ছিলো। এমন সময় এক কৃষক পাথরের পেছন দিকে প্রস্রাব করতে গেলে ওই গভীরে পড়ে যায়। পরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই থেকে গ্রামের মানুষের পাথরের প্রতি আরও ভয় বেড়ে যায়। কেউ পাথর ঘেঁষতে চায় না। গঞ্জে যাবার পথে পাথর প্রদক্ষিণ করার সময় লোকেরা অনেক ভয় নিয়ে পার হয়। এই প্রাণ যাবে বুঝি। আর এই ভয়টাই দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। একদিন গভীর রাতে গ্রামের এক কৃষকের দল গঞ্জে থেকে তাদের পণ্য বিক্রি করে বাড়ি ফিরছিলো, ঠিক যখনি বটগাছের নিচ দিয়ে পাথর প্রদক্ষিণ করবে তখনি তারা মানুষের কণ্ঠের মত একটি বিকট শব্দ শুনতে পায়। তারা ভয়ে কাঁপতে থাকে। আবার শব্দ ভেসে আসে। তারা বুঝতে পারে পাথরের দিক থেকেই শব্দ আসছে। কিন্তু কিভাবে! পাথর কিভাবে কথা বলে! এ কেমন অদ্ভুতুড়ে কা-। ভয়ে তাদের শরীর শীতল হয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার পাথরের পেছন থেকে লম্বা দু’টি পাঞ্জাবিওয়ালা হাত বেরিয়ে আসে। হাত দু’টি ইশারা করে, যা কিছু আছে তা রেখে চলে যেতে এবং গ্রামে গিয়ে কিচ্ছু না বলতে। বললেই ঘাড় মটকাবে। কৃষক দল ভয়ে শস্য বিক্রির সব টাকা পয়সা, জিনিসপত্র রেখে দৌড়ে চলে যায়। তারপর পাথরের পেছন থেকে দু’টি লোক বেরিয়ে আসে এবং টাকা আর জিনিসপত্র নিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কৃষক দল গ্রামে ফিরে যায়, এবং পাথরের কথামত মুখ বন্ধ রাখে। পরদিন গ্রামের মাতব্বর রহিম মিয়া ঠিক এমনি গভীর রাতে শহর থেকে বাণিজ্য করে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনিও ওই পাথরের কবলে পড়েন এবং সর্বস্ব হারান। পাথরের কথামত তিনিও গ্রামে এসে চুপ থাকেন। এভাবে চলতেই থাকে, গঞ্জ কিংবা শহর থেকে যে কেউ গভীর রাত করে গ্রামে ফিরলে তারা ওই পাথরের কবলে পড়েন এবং সর্বস্ব হারান। অদৃশ্য ভাবে পাথর কথা বলে উঠে এবং সবকিছু রেখে যেতে বলে, আর পরে দু’টি লোক পাথরের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে আর রেখে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। গ্রামের প্রায় সিংহ ভাগ লোকই পাথরের কবলে পড়েছেন। তবে কেউই মুখ খুলছেন না। তবে ইদানীং তাদের সকলের মধ্যে একটা স্তম্ভিত ভাব লক্ষ করা যায়। সবাই যেন ভয়ে ভয়ে থাকেন। কেউ আর সন্ধ্যার পর ওই রাস্তা দিয়ে যেতে চায় না। কেউ না যাওয়াতে আপনা আপনিই অই রাস্তা ভুতুড়ে রাস্তা হিসাবে পরিচিত হয়। এ দিকে মাতব্বর রহিম মিয়ার এক মাত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়। দিকে দিকে আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। বেশ বড় আয়োজন। তাই কাছের দূরের সকল আত্মীয়স্বজন বিয়ের অনুষ্ঠানে আসেন। মাতব্বরের একমাত্র বোন হালিমা বেগমও বহুদূর পেরিয়ে পাশের রাজ্য থেকে আসেন। হালিমা বেগম পাশের রাজ্যের এক ছেলের সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। তাই মাতব্বর রহিম মিয়া তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তবে একমাত্র মেয়ের বিয়েতে রহিম মিয়া সব ভুলে একমাত্র বোনকেও নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আর বোনও সেই খুশিতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে সপরিবারে আসেন। হালিমা বেগমের একটি মাত্র ছেলে বেশ বুদ্ধিমান আর সাহসী, তার সাহসের জুড়ি নেই। সেও মামাতো বোনের বিয়েতে আসে। পাশের রাজ্য থেকে আসতে বেশ রাত হয়। আর তারাও ওই অদ্ভুত পাথরের কবলে পড়েন এবং সর্বস্ব হারান। পরে বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হন। তারাও পাথরের আদেশ মত মুখ বন্ধ রাখেন। কোন মতে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়। তবে হালিমা বেগমের একমাত্র ছেলে আবু বক্করের পাথরের ব্যাপারটা বেশ চিন্তায় ফেলে। সে ঘটনার পর থেকে ভাবতে থাকে এ কিভাবে সম্ভব! অদ্ভুতভাবে পাথর কথা বলে। এমন ঘটনা তো কোনদিন শুনিনি। এ কেমন অদ্ভুতুড়ে কা-। সে ভাবতে থাকে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, নিশ্চয় এর পেছনে কোনো রহস্য আছে, আর এ রহস্য আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। পাথরের নিষেধ উপেক্ষা করে সে মামাকে সব ঘটনা খুলে বলে, মামা থমকে যান। কারণ একমাত্র ভাগনার মৃত্যুফাঁদ দেখতে পাচ্ছেন। পাথরের কথা মত যদি কেউ এ ঘটনা প্রকাশ করেন তাহলে ত পাথর ঘাড় মটকাবে, আর তা তার ভাগনা প্রকাশ করে দিয়েছে, তবে ভাগনার কি হবে! মাতব্বর রহিম মিয়া ভয় পেয়ে যান, ভাগনাকে চুপ করাতে চান। কিন্তু ভাগনা কোনমতেই চুপ হওয়ার ছেলে নয়। উল্টো সে প্রশ্নের মাত্রা বাড়াতে থাকে। মামাকে পীড়াপীড়ি করে কিছু জানলে খুলে বলতে, পরে ভাগনার চাপে পড়ে মামা সব ভুলে বলতে বাধ্য হন। বলেন তিনিও পাথরের কবলে পড়েছিলেন এবং সব হারিয়েছিলেন আর গ্রামের অনেকই পাথরের কবলে পড়েছেন তবে কেউ মুখ খুলতে নারাজ। পাথরের ভয়ে। এবার আবু বক্কর বুঝতে পারে, পাথর সবাইকে কাবু করেছে, সে ভাবতে থাকে এটা কি ভূত! না ভূত হতে পারে না। এ কেমন ভাবনা। ভূত কোথা থেকে আসবে। তাহলে পাথর কিভাবে কথা বলে এ কিভাবে সম্ভব! না এটা দেখতে হবে। ব্যাপারটা কি। না জানি কত মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছেন। সে চিন্তায় থাকে কিছু একটা করতে হবে। সারা রাত ভাবনায় ডুবে থাকে। একটুও ঘুমায়নি। রাত পেরিয়ে সকাল হয়। সকাল হতেই মাতব্বর রহিম মিয়ার বাড়িতে হট্টগোল বেধে যায়, কারণ সারা বাড়িতে আবু বক্করকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেলো ছেলেটা। এ দিকে আবু বক্কর ভোরবেলা তার বাড়ির দিকে রওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য বন্ধুদের নিয়ে ফিরে আসা। কারণ সে জানত এ সমস্যাটা একা সমাধান করা সম্ভব নয়। আর এ গ্রামেরও কেউ তাকে সাহায্য করবে না। সবাই আতঙ্কে। তাই সে গ্রামে গেছে বন্ধুদের নিয়ে আসবে আর ওই ভুতুড়ে কা-ের রহস্য উদঘাটন করবে। যথারীতি সে গভীর রাতে গ্রামে পৌঁছায় এবং রাতেই বন্ধুদের এক করে সব খুলে বলে। প্রথমে বন্ধুরাই ভয় পায়, পরে তারা রাজি হয়। এবং পরদিন সকালে কুসুমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বহু পথ প্রদক্ষিণ করে তারা গ্রামে পৌঁছায়, তখন চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। গভীর রাত। তারা একটি নিখুঁত পরিকল্পনা করে সামনে এগোয়। আবু বক্করের কথামত আট জনের দলের মধ্যে দু’জন যায় বটগাছের পেছনে, দু’জন থাকে দূরে আর দু’জন গাছের দু’পাশে চুপ করে আড়ালে বসে থাকে। আর আবু বক্কর আর তার এক বন্ধু একটা পুঁটলিতে কিছু খড়কুটো ভরে পাথরের দিকে এগিয়ে যায়। হাতে একটা আগুনের কুপি। কারণ সে জানত ভূত হলে আগুন ভয় পাবে আর কাছে ঘেঁষবে না। তাই সে ওই কুপি হাতে করেই এগোচ্ছিলো। তো ঠিক যখনি তারা পাথর প্রদক্ষিণ করবে তখনি, সে দিনের মত পাথর অদৃশ্য ভাবে কথা বলে উঠে এবং সব রেখে যেতে বলে। তারাও পুঁটলিটা রেখে আর পুঁটলির পাশে কুপিটা রেখে সামনে চলে। আর দূরে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। তারা দেখে দু’টি লোক বেরিয়ে আসে আর ওই পুঁটলিটা হাতে নেয় কিন্তু কুপির আগুনে একটুও ভয় পাচ্ছে না। আবু বক্কর বুঝে যায় এরা ভূত নয়, এরা মানুষ ভূত। তাই সে পরিকল্পনা মত আক্রমণ বলে চিৎকার করে আর সাথে সাথে তার বন্ধুরা ওই দুই ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে। আড়াল থেকে আবু বক্করও আসে এসে দেখে সাদা পাঞ্জাবি আর মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা দু’টি লোকই মানুষ। তারা এতদিন মানুষকে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে সব আত্মসাৎ করে আসছিলো। তারপর তাদেরকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামে নিয়ে আবু বক্কর ওই দুই ব্যক্তিকে তার মামা রহিম মিয়ার গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখে আর মামাকে সব খুলে বলে। রহিম মিয়া চমকে ওঠেন এবং লোক দু’টিকে দেখতে চান। পরে লোক দু’টিকে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান এবং লোক দু’টিকে চড়-থাপ্পড় মারেন। পরে তার বাড়িতে গ্রামের সকলকে জরুরি বৈঠকে ডাকেন। সকালে একে একে গ্রামের সকলে উপস্থিত হন এবং ওই লোকদেরও উপস্থিত করা হয়। দেখা যায় তারা গ্রামের সেই দুই চোর যাদের বার বার চুরির অপরাধে গ্রাম থেকে জুতোর মালা পরিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। গ্রামের সবাই হতবাক হয়ে যায়। তাহলে কি তারাই এতদিন ভূত সেজে লোকেদের কাছ থেকে সব লুটে নিত। তারপর গ্রামের সবার সর্বসম্মতিক্রমে তাদের রাজদরবারে কাজীর নিকট পৌঁছানো হয় এবং কাজী তাদের অপরাধ শুনে আজীবন বন্দি থাকার শাস্তি দেন আর আবু বক্করসহ তার বন্ধুদের গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে পুরস্কার দেয়া হয়।

Share.

মন্তব্য করুন