হজরত দাউদ (আ)-এর যুগের কথা। তখন দামওয়ান গ্রামে বাস করত এক গরিব চাষি। অভাব-অনটনে চলত তার সংসার। একদিন ক্ষুধার জ্বালায় চাষি কাতর হয়ে পড়ল। দিনভর খাবার খুঁজল। কোথাও খাবার পেল না। হঠাৎ একটা পথচারীর ওপর তার নজর পড়ল। পথচারী এক গাছের নিচে বসে খাচ্ছিল। গরিব চাষি লোকটার কাছে গিয়ে কাতরস্বরে বলল, ‘ভাই! আমি খুব ক্ষুধার্ত। দয়া করে আমাকে সামান্য খাবার দিলে পেটের জালা মিটাতে পারি।’
পথচারী ছিল খুব চালাক। সে চালাকি করে বলল, ‘দেখ ভাই! আমার কাছে একটা সিদ্ধ ডিম আছে। ডিমটা তোমাকে দিতে পারি। তবে আমার একটা শর্ত আছে। এক বছর পর তুমি ডিমের দাম সুদে-আসলে ফেরত দেবে। শর্তে রাজি থাকলে ডিমটা আমি তোমাকে দিতে পারি।’
গরিব চাষি ছিল খুবই ক্ষুধার্ত। তাই চাষি আর কিছু ভাবতে চাইল না। সে ভাবল, একটা সিদ্ধ ডিমের দাম আর কত হবে? এই সামান্য অর্থ তাড়াতাড়ি জোগাড় হয়ে যাবে। তাই চাষি লোকটার শর্ত মেনে নিল। সিদ্ধ ডিম খেয়ে সে কোনরকমে ক্ষুধা নিবারণ করল।
এক বছর পরের ঘটনা। ডিমওয়ালা গরিব চাষির বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। সে গাঁয়ের লোকজন ডেকে জড়ো করল। ডিমওয়ালা সবার সামনে বলল, ‘দেখুন ভাইসব! এক বছর আগে এই চাষি একটা ডিম নিয়েছে। এক বছর পর সুদে-আসলে ডিমের দাম পরিশোধ করার কথা। আমি আজ আমার পাওনা বুঝে নিতে এসেছি। দেখুন আপনারা! লোকটা যদি সেদিন ডিম না খেত তাহলে এই ডিম থেকে একটা মুরগির বাচ্চা হতো। সেই মুরগির বাচ্চা ছ’মাস পর বিশটি ডিম দিত। বিশটি ডিম থেকে আরও বিশটি বাচ্চা হতো। সেই বাচ্চাগুলোর প্রতিটি বিশটি করে ডিম দিত। সেই ডিম থেকেও বাচ্চা হতো। তা হলে কম করে হলেও বছরে আমি চারশ চল্লিশটি মুরগি পেতাম। আজ অন্তত চারশ চল্লিশটি মুরগির দাম চাষিকে শোধ করতে হবে।’
লোকটার কথা শুনে গরিব চাষির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে তো হতবাক। অত অর্থ সে দেবে কিভাবে! কিন্তু ডিমওয়ালা ছিল নাছোড়বান্দা। চাষি কেঁদে কেঁদে লোকটার কাছে মাফ চাইল। চতুর লোকটি চাষির কোনো আবদার শুনল না। সে হজরত দাউদ (আ)-এর দরবারে গিয়ে বিচার চাইল। চাষিও ডিমওয়ালার অভিযোগ অকপটে স্বীকার করল। দাউদ (আ) বললেন, ‘লোকটার শর্তে তুমি রাজি ছিলে। তাই ডিমের মূল্য তোমাকে পরিশোধ করতে হবে। তোমার যেহেতু নগদ অর্থ নেই, তাই এখন থেকে তোমার বাড়িঘর, জমি-জিরাত ইত্যাদির মালিক হবে ডিমওয়ালা।’
হজরত দাউদ (আ)-এর রায় শুনে গরিব চাষি হতভম্ব হয়ে গেল। বাদশাহর আদেশ। তাই জায়গা জমি, বাড়িঘর সে ডিমওয়ালার কাছে বুঝিয়ে দিল। ফলে চাষি হয়ে পড়ল নিঃস্ব। সে পথে পথে ঘুরে। আর মানুষের করুণায় কোন রকমে বেঁচে আছে। একদিন সে ক্ষিধের তাড়নায় পথের ধারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। চাষির করুণ অবস্থা সোলায়মান (আ)-এর চোখে পড়ল। তিনি সেবাযতœ করে চাষিকে সুস্থ করে তুললেন। তারপর তিনি চাষির দুঃখের কাহিনী মন দিয়ে শুনলেন।
ডিমওয়ালার চালাকি শুনে সোলায়মান (আ) বিস্মিত হলেন। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করতে চাইলেন। তাই চট-জলদি তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। সোলায়মান (আ) চাষিকে বললেন, ‘তুমি এক কাজ কর। কাল সকালে এক ঝুড়ি সিদ্ধ ধান নিয়ে দরবারে যাও। দরবারের চারপাশে ধানগুলো ছড়িয়ে দেবে আর বলবে, ‘এই ধানগুলো থেকে ধান গাছ জন্মাবে।’
গরিব চাষি সোলায়মান (আ)-এর কথামত পরদিন দরবারে গেল। সিদ্ধ ধান সে দরবারে ছড়াতে লাগল। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘এ ধান থেকে গাছ জন্মাবে।’
চাষির কা- দেখে দাউদ (আ) অবাক হলেন। তিনি লোকটার পাগলামি দেখে দুঃখ বললেন, ‘সিদ্ধ ধান থেকে গাছ কি জন্মাবে? এ কথা কেউ কি বিশ্বাস করবে? না এমন ঘটনা কোনদিন ঘটেছে।’
এ কথা শুনে হজরত সোলায়মান (আ) উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, ‘সিদ্ধ ধান থেকে যদি ধান গাছ না জন্মায়, তাহলে সিদ্ধ ডিম থেকেও বাচ্চা জন্মাতে পারে না। একটি সিদ্ধ ডিম খেয়ে চারশ’ চল্লিশটি মুরগির দাম পরিশোধ করতে হয়েছে গরিব চাষিকে। এর ফলে তাকে আজ ভিখেরির মতো পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে বাড়িঘর, জমি-জিরাত।’
হজরত সোলায়মান (আ)-এর কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেল। সবাই তাঁর বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো। এরপর দাউদ (আ) ডিমওয়ালাকে ডেকে চাষির জায়গা জমি ও বাড়িঘর তাকে ফেরত দিল। বাড়িঘর জমি-জিরাত ফিরে পেয়ে গরিব চাষি খুব খুশি হলো। এদিকে সোলায়মান (আ)-এর ন্যায়বিচারের কাহিনী মুহূর্তেই দেশময় ছড়িয়ে পড়ল।

 

Share.

মন্তব্য করুন