আমাদের কানাই স্যার রেগে গেলেই যাকে তাকে কান ধরে ওঠ-বস করাতেন আর বলতেন- ‘গুবরে মাথা’। তাতে আমরা খুব মজা পেতাম। ভাবতাম সত্যি বুঝি মাথা ভর্তি কাউডাং মানে গোবর! তাই স্যার চলে গেলে সাজাভোগকারী সহপাঠী বন্ধুটিকে আমরাও ক্ষেপাতাম ‘গুবরে মাথা’ বলে। হয়তো সেও তাই বিশ্বাস করতো। তাই মাথা নত করে চুপচাপ বসে বসে কাঁদতো অথবা সবার অলক্ষে ক্লাস ছেড়ে পালাতো। তবে সেটা হতো আরো করুণ ব্যাপার। পরদিন কানাই স্যারের ক্লাস থেকে শুরু করে সব ক্লাসের স্যারের হাতে তাকে কানমলা, বেতের বাড়ি অথবা চড়-থাপ্পড় খেতেই হতো। সেদিন অবশ্য আমরা আর ক্ষেপাতাম না। বরং তো মায়া লেগে যেতো। এমনি ধরনের গুবরে মাথার ছাত্র ছিলো গৌড়াঙ্গ, শ্রীবাস, টুটুল, জয়নাল, বাদল আর সুজিত। এদের নামগুলো টপাটপ ঠোঁটের আগায় চলে এলো এজন্য যে, পড়া না পারার কারণে যারা প্রায়ই মার খেতো তাদের মাঝে অই ছয় রত্ন ছিলো কমন। আর অন্য যারা অনিয়মিত বা মাঝে-মধ্যে স্যারদের ধোলাইয়ের পাল্লায় পড়ে নাকের জল, চোখের জল একাকার করে বাড়ির পথ ধরতো- তাদের মাঝে অবশ্য আমার নামও আছে। তবে আমরা একদিন ধোলাই খেলে মাসভর তা মনে রাখতাম বলেই হয়তো স্যারেরা আমাদেরকে নিয়মিত ‘হ্যারাস’ করতে পারতেন না। হ্যাঁ, ‘হ্যারাস’ মানে যে ‘অপমান’! সে কথাটা মামার কাছ থেকে আগেই তালিম নিয়েছিলাম। ‘হ্যারাস’ হলে প্রেস্টিজ মানে আত্মসম্মান থাকে না।
এটাও মামা শিখিয়েছেন হাতে কলমে। আর তা হলো, তিনি যদি তার নিজস্ব কোন গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারতেন যে, তার প্রিয় ‘আব্বুজান’ আজ ক্লাসে প্যাঁদানি খেয়েছে- তো তিনি দুই হাতে আমার দুই কান চেপে ধরে হাঁক ছাড়তেন- ‘আজকাল লেখাপড়ায় ফাঁক মারা হচ্ছে! আয় তবে দেখাচ্ছি মজা’। বলেই আর মুহূর্ত দেরি করতেন না। চোখের পলকে আমার কান দুটো মলে দিয়ে বলতেন- যা তোকে আজ দারুণ রকম হ্যারাস করে দিলাম। প্রেস্টিজ থাকে তো ঠিক মতো লেখাপড়া করিস।
ব্যাস, একবার হ্যারাস হবার ধাক্কা সামলাতেই মাস কাবার। পড়া ফাঁকি তো দূরেই থাক, বেশি বেশি দুষ্টুমি করতেও প্রেস্টিজে লাগতো। আর কানাই স্যার যেদিন সুযোগ পেয়ে ‘গুবরে মাথা’ বলেছেন তো, লজ্জায় মাটিতেই মিশে যেতাম। অথচ এই গোবরই যে কতো মহা মূল্যবান বস্তু! সেটা বুঝলাম ক্লাস নাইনে ওঠে।
আমরা তখন মামা বাড়ির ধার কাছটিতে থাকি না। আব্বা চাকরি বদল করে চলে এলেন কুড়িগ্রামে। ভর্তি হলাম কুড়িগ্রাম বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো। মাত্র দু’মাসে ক্লাসের সব সহপাঠীর সাথে ভাব জমে গেলো। সবাই যেন আপনজন। এক মন, এক প্রাণ।
কিন্তু তার মাঝে সুজনটা যেন কেমন একটু ভিন্ন ধাঁচের। ওকে প্রতিদিন ক্লাসে না পেলে আমার মনটাই ভরতো না। একটু চঞ্চল আর চনমনে বলেই হয়তো ওকে অমন করে ভালো লাগতো। অবসরে পাকা কথাশিল্পীর মতো কেমন বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতো- মনে হতো আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ মুজতবা আলী, শওকত ওসমান কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্প শুনছি। আমাদের পাঠ্য বইতে তাদের গল্প ছিল কী না! তা ছাড়া খালি গলায় গানও গাইতো ভালো। যেন অবিকল আব্দুল আলীম। আর ওদের ছোট্ট বাড়ির কুলগাছ থেকে কুল পেড়ে আনতো পকেট ভরে। কখনো পাকা খেজুর অথবা করমচাও আনতো। এমন খোলা মনের বন্ধু যেন আর দু’একটা হয় না।
কিন্তু বছর ঘুরতেই কিসের থেকে কি যে হয়ে গেলো- হঠাৎ আমাদের স্কুল বন্ধ করে হাজার হাজার মানুষ দিয়ে ভরা হলো ক্লাস রুম। স্কুলের মাঠে রান্ন্া হয় খিচুড়ি। নয় ড্যাগ, দশ ড্যাগ, বারো ড্যাগ। সরকারি গাড়িতে চাল আসে, ডাল আসে। কখনো বিস্কুটও আসে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, ঠেলা-ধাক্কা, গলা-ধাক্কা দিয়ে মানুষকে লাইন ধরিয়ে সেই বিস্কুট আর খিচুড়ি দেয়া হয় পলিথিন আর কাঁঠাল পাতার ঠোসে। আমাদের বাসায়ও রান্না-বান্নার চেহারা বদলাতে শুরু করেছে। এক বেলা রুটি আর দু’বেলা ভাতের বদলে দু’বেলা রুটি আর এক বেলা খিচুড়ি হতে লাগলো। এই নিয়ে আব্বা-আম্মা প্রায়ই তর্ক বাধিয়ে দেন। একদিন তো আব্বা সাফ সাফ জানিয়েই দিলেন- এখন থেকে খেসারির ডাল দিয়ে খিচুড়ি পাকাবে। আমি আর মশুর ডালের ‘বোচকা’ টানতে পারবো না। পাই তো মোটে তিন টাকা মাইনে- তাতে আবার মশুর ডাল। তাছাড়া মশুর ডাল বাজারে মিললে তো! সব গিলছে রাক্ষুসে মোংগা। চারদিকে অনাহারী লাশ পড়ছে। এখনো যে খেতে পাচ্ছো, তাই আল্লাহর শুকরিয়া করো। না হয় বাপের বাড়ির পথ ধরো।
এতোক্ষণে বুঝলাম, কুড়িগ্রামে মঙ্গা নামে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। আমাদের চেয়ে সুজনদের অবস্থা আরো সঙ্গিন। সুজনের বাবার কাজ নেই। বাড়িতেও তেমন শস্য মজুদ নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা। ওকে দেখি প্রতিদিনই কাউডাং মানে গোবর কুড়িয়ে ঝাঁকা ভরে বাড়িতে নিয়ে যায়। ওর মা তাই দিয়ে ব্যানা গাঁথেন। তারপর তা রোদে শুকিয়ে চুলোতে জ্বালান। সে আগুনেই চলে রান্না-বান্না।
একদিন আমার ওপরও গোবর কুড়ানোর আদেশ জারি হলো। আব্বা আম্মার ওপর ক্ষেপে গিয়ে গড়গড়িয়ে বলে দিলেন- লাকড়ি-খড়ি আর কিনতে পারবো না বলে দিচ্ছি। দাম বেড়েছে আগুনের মতো। তোমার ড্যাংগা ছেলেকে গোবর কুড়াতে বলো। স্কুলতো বন্ধই। সারাদিন খায় দায় আর টই টই পৈ পৈ করে পাড়া বেড়ায়। ওসব চলবে না বলে দিচ্ছি।
আম্মা একটু প্রতিবাদ করতেই তিনি আমাকে শুনিয়ে আরো গলা চড়িয়ে বললেন- এ্যাঁহ্! আপনার ছেলে নবাব জাদা সদরুদ্দিন! হয়েছে সিম্পল এক কেরানির ছেলে, ওনার আবার প্রেস্টিজ! সবাই যদি গোবর কুড়াতে পারে- তো, সেও পারবে, ওর বাপ পারবে। ওর চৌদ্দ গোষ্ঠী পারবে। না হলে চাল-চুলো গোল্লায় যাক।
ব্যাস, আমার আর প্রতিবাদ করা হলো না। মামার কাছে শেখা হ্যারাস আর প্রেস্টিজের কথা ভুলে, শরম-লজ্জা ত্যাগ করে সেদিন থেকেই সুজনের সাথে সাথে আমিও লেগে গেলাম গোবর কুড়াতে।
তবে সপ্তাহ না ঘুরতেই আব্বা একদিন গরম গরম জিলিপি কিনে এনে খুশিতে ডগমগ হয়ে আম্মাকে জানালেন- নাও গো, কুড়িগ্রামে চাকরির মজা আজ চুকিয়ে এসেছি। আগামী মাসের এক তারিখে জয়েন করবো খোদ রাজধানীতে। সুজনের টিসিরও ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ত্রিশ তারিখ সকালেই ঢাকার ট্রেন ধরবো।
আব্বার কথা শুনে আমার আর আনন্দের সীমা রইলো না। ভাবলাম রাজধানীতে আর যাই হোক- অই গোবর, মানে কাউডাং তো কুড়াতে হবে না। এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে কথাটা সুজনকে জানালাম।
সুজন কোন কথাই বললো না। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো একটা মরা গাছের ওপর। অমন সময় একটু দূরে একটা গরু কেবল মাত্র গোবর ছেড়েছে। আমি অলস পায়ে গিয়ে সেই গোবরগুলো যেই না ঝাঁকায় তুলেছি- অমনি সুজন যেন উড়ে এসে এক থাবাতে ঝাঁকাটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো- খবরদার! তুই আর গোবর ধরবি না। তাহলে একদম খুন করে ফেলবো।…খুন করে ফেলবো।…
কথাটা বলেই সুজন এক দৌড়ে ছুটে পালালো। আমি পিছু পিছু ছুটেও ওকে আর থামাতে পারলাম না। মনের দুঃখে এদিক সেদিক ঘুরে-ফিরে বাসায় পৌঁছে দেখি আম্মা একঝাঁকা গোবর নিয়ে ব্যানা গাঁথছেন। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এ গোবর পেলেন কোথায়? আম্মা অবাক হয়ে বললেন- কেন রে, তুইতো সুজনকে দিয়ে এইমাত্র পাঠিয়েছিস।
ব্যাপারটা আমার বুঝতে একটু বিলম্ব হতেই- মনের গহিনে হঠাৎ যেন আবছা আবছা কানাই স্যারকে দেখতে পেলাম।
তিনি আঙুল তুলে বলছেন- তোর তো একটা গুবরে মাথা। তুই এতো সহজে এই রহস্য বুঝবি না।

 

Share.

মন্তব্য করুন