বালুর বস্তা
মোহাম্মদ লিয়াকত আলী
বিদ্যা না থাকলেও বুদ্ধি আছে মোতালেবের। সব সময় বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে সে। পাড়াগাঁয়ের ছেলে মোতালেব। বিদ্যাহীন বুদ্ধিমান ছেলের দুটি কাজই আছে গ্রামে। ক্ষেত করা আর মাছ ধরা। মাছ ধরতে যেয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করে, কিভাবে বেশি মাছ ধরা যায়।
কোন মাছ কোন জায়গায় বেশি থাকে, কোন মাছ কি খায়, এসব বিষয়ে তার জ্ঞান টনটনে। শিং মাছ ঘুলা পানিতে থাকতে ও কেঁচো খেতে ভালবাসে। লগি দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে পানি ঘুলা করে বর্শিতে কেঁচোর টেপ গেঁথে অনেকেই বিলে ছিপ ফেলে। কিন্তু বড় বড় শিং মাছগুলো ধরা পড়ে মোতালেবের বর্শিতে।
লবণের বাটিতে কেঁচো রাখতে যেয়ে মোতালেব আবিষ্কার করে ফেলে এক অদ্ভুত সূত্র। লবণের সংস্পর্শে কেঁচোর শরির রাবারের মত শক্ত হয়ে গেছে। টেনে ছেঁড়া যায় না। ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে বর্শিতে গাঁথে সে। লবণ মাখা কেঁচো শিং মাছের এত প্রিয়, তা সেদিনই টের পায় মোতালেব।
বিলের মাঝে পুঁতে রাখা বাঁশের আগায় পানকৌড়ি ও মাছরাঙা বসে। যে পাখি আল্লাহ পাক হালাল করেছেন তা ধরে খেতে কোন দোষ নেই। অতিথি পাখির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞায় কিছুটা যুক্তি আছে।
বাঁশের কঞ্চি ধনুকের মত বাঁকা করলেই শক্তি সঞ্চার হয়। তাই বাচ্চারা খেলনা ধনুক তৈরি করে পাখি তাড়ায়। একটু বুদ্ধি খাটিয়ে এই সহজ প্রযুক্তি খাটিয়ে মোতালেব তৈরি করে পাখি ধরার ফাঁদ। বিলে পোঁতা বাঁশের সাথে একটি কঞ্চি বেঁধে ধনুকের মত বাঁকা করে একটি চিকন রশিতে ফাঁস তৈরি করে সে। বাঁশের মাথায় একটি কাঠি সেটে ফাঁস ঝুলিয়ে রাখে, যাতে কাঠিতে পাখি বসলেই খুলে যায় আর হেঁচকা টানে ফাঁস লেগে যায় পাখির পায়ে।
মোতালেবের ক্ষেতে ভাল ফসল ও তরিতরকারি ফলে। ভাল ফসল ফলানোর কৌশল নিয়ে দিন রাত ভাবে সে। পুরুষ ফুল ছিঁড়ে স্ত্রী ফুলে চেপে ধরে পরাগায়ণ করে। প্রজাপতি ও মৌমাছির ভরসায় থাকে না। সবজির বিচি সরাসরি মাটিতে না পুঁতে পলিথিন বেগে সারমিশ্রিত মাটিতে চারা গজিয়ে নেয়।
এত বুদ্ধি খাটিয়ে ও সংসারের গরিবি হালত দূর করতে পারে না মোতালেব। শুধু মাছ ধরে ও ক্ষেত করে গ্রামে টিকে থাকা কঠিন। বিদ্যাহীন বুদ্ধি নিয়ে শহরে এসে কিছু করারও সাহস পায় না।
এক আদম বেপারীর পাল্লায় পড়ে সৌদি আরব যাওয়ার মোহ পেয়ে বসে তাকে। তার ধারণা, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মানুষ তার মত বিদ্যাহীন এবং বুদ্ধিহীনও বটে। সেখানে যেতে পারলে হয়তো বুদ্ধি খাটিয়ে আরো ভালো কিছু করা যাবে।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে লাখখানেক টাকা ঋণ করে লেবার ভিসায় একদিন পাড়ি দেয় সৌদি আরব।
মদিনার নিকটবর্তী উপশহর আল গাছিম তার কর্মক্ষেত্র। সেখানকার এক খেজুর বাগান মালিকের অধীনে তার চাকরি। বাংলাদেশে খেজুর গাছ এমনিতেই বড় হয়। রস সংগ্রহ না করলে এমনিতেই খেজুর হয়। কোন পরিচর্যার দরকার হয় না।
কিন্তু মদিনার খেজুর বাগানে নানা রকম কাজ করতে হয় তাকে। তৈরি হয় নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। নিজ দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটি গাছ থেকে পরীক্ষা মূলকভাবে রস সংগ্রহ করে। জাল দিয়ে গুড় বানিয়ে একদিন বাগান মালিককে খাওয়ায়। গুড় খেয়ে মালিক চমৎকৃত হয়। কিন্তু সে গাছে খেজুর কম হওয়ায় এ কর্মসূচি বাতিল হয়ে যায়।
পাঁচশ রিয়াল বেতনের অর্ধেকের বেশি চলে যায় খাওয়া-পরায়। ঋণের টাকা শোধ করতেই চলে যায় দুই বছর। আরো দু’বছর চাকরি করে সঞ্চিত কিছু বৈদেশিক মুদ্রা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসে স্বদেশে। বুদ্ধিমান মোতালেব দেশে ফিরে নির্বোধ পাগল পরিচয়ে। সৌদি আরব থেকে মানুষ নিয়ে আসে ফ্রিজ, টিভি, ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাপটপ, ওয়াশিং মেশিন, ব্ল্যান্ডার মেশিন আরো কত ইলেকট্রনিকস সামগ্রী। কাপড় চোপড় ও নানা রকম শখের জিনিস সস্তায় পাওয়া যায়। গৃহস্থালি কাজের ছোট ছোট যন্ত্রপাতি, যেমন পিঁয়াজ কাটা, মশলা পিষা, ফলের জুস তৈরির মেশিন সুলভমূল্যে আনা যায় বিদেশ থেকে। স্বল্প সময়ে রান্নার প্রেসার কুকার নিয়ে আসে অধিকাংশ যাত্রী।
এসব কিছুই আনেনি বেওকুফ মোতালেব। কিছু সস্তা কাপড়, কিছু ফল ও এক কনটেইনার জমজমের পানি এনেছে চার বছর চাকরি করে। এসব জিনিস আনা নির্বুদ্ধিতা বা পাগলামি নয়। তাকে পাগল বলে পরিচিত করে বিরাট এক বালুর বস্তা বিমানে করে মদিনা থেকে ঢাকা আনার জন্য।
যে দেশে যে জিনিস সস্তা, সে দেশ থেকে সে জিনিসই মানুষ আমদানি করে। ভারতের গরু তাই কোরবানির হাট দখলে করে বাংলাদেশে। পদ্মার ইলিশ পাচার লাভজনক ব্যবসা। তাই বলে মরুভূমির বালু কেউ বিল্ডিং তৈরি বা বন্যা ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশে বয়ে আনে না।
খাল কেটে কুমির আনা যায় না। এক দেশের পানি আরেক দেশে নেয়া যায়। তাই বলে ড্রামে ভরে পদ্মা যমুনার পানি কেউ মরুর দেশে নিয়ে যায় না। বরকত ময় জমজমের পানি পাইপলাইন দিয়ে মক্কা থেকে সুদূর মদিনায় পাঠানো হয়। কনটেইনার ভরে সারা পৃথিবীতে সরবরাহ করা হয়।
বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মচারীরা প্রথমে ভেবেছিল, ব্যাটা হয়তো বালুর ভেতর অন্য কোন নিষিদ্ধ জিনিস পাচার করছে। হাতের তালুতে ঘষে, নাকে গন্ধ শুঁকে, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করেও তেমন কিছু আবিষ্কার করা গেল না। পাগল ছাড়া কি কেউ ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ভিজা বালু বিমানে ওঠায়?
পাগল হউক আর আহাম্মক হউক, সে বিমানের আন্তর্জাতিক রুটের প্যাসেঞ্জার। তাই সম্মানের সাথেই বেরিয়ে আসে বহির্গমন লাউঞ্জ দিয়ে। রিসিভ করতে আসা গ্রামের আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধব অত্যন্ত খাতির করে মাইক্রোবাসযোগে ভালুকার নিজ গ্রামে নিয়ে আসে তাকে।
সেখানেও একই অবস্থা। আহাম্মকটা এক বস্তা চিনি আনলেও ক্ষতি ছিল না। যেহেতু সৌদি আরবে চিনি আর লবণের দাম সমান। ঈদ আসলে বাংলাদেশে চিনির দাম লাগামহীন ঘোড়ার মতো লাফায়।
যে যত কথাই বলুক মোতালেব নির্বোধ নয়। সে বুদ্ধি না খাটিয়ে কোনো কাজ করে না। বালুর বস্তায় করে নিয়ে এসেছে সে তার চার বছরের অভিজ্ঞতা।
আরাফাতের ময়দানে বাংলাদেশের নিমগাছের সফল কার্যক্রম দেখেই তার মাথায় এ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাংলাদেশের উর্বর মাটিতে আরবের খেজুর হবে না কেন? মরুভূমির বালুর সাথে কিছু প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে তার ভেতর খেজুর বিচি কিছুদিন রাখলে শিকড় গজায়। সেই বিচি মাটিতে পুঁতলে চারা হয়। বাংলাদেশের মাটিতে এই সহজ প্রযুক্তির পরীক্ষা চালানোর জন্য মোতালেবের এই পাগলামি।
বাবা রাগ করে বালুর বস্তা ও বিচির পোঁটলা ছুড়ে ফেলে দিলেও মোতালেব হাল ছাড়েনি। সযতে তুলে রেখেছে ধানের গোলায়। কিছুদিন পর চালনি দিয়ে চেলে বালু থেকে বিচিগুলো আলাদা করে। প্রতিটি বিচিতেই শিকড় গজিয়েছে। সবজি ক্ষেতে গোবর সার দিয়ে বিচিগুলো পুঁতে দেয় সৌদি কায়দায়। যথারীতি চারা হয়। চারা বড় হয়। দু’বছর পর মানুষ টের পায় মোতালেবের কেরামতি।
ছয়টি গাছে প্রথম ফলন হয় অবিকল মদিনার খেজুর। মুখে দিয়ে চিবিয়ে দেখে, সেই স্বাদ। পনেরো দিনেই খেজুর পরিপক্ব হয়। হলুদ ও লাল রঙের টসটসে খেজুর। দুই জাতের বিচি এনেছিল সে। দুই জাতের খেজুরই ফলেছে। দলে দলে লোক আসে মোতালেবের খেজুর গাছ দেখার জন্য। সে সকলকে দুই পিস খেজুর দিয়ে আপ্যায়ন করে। সে এলাকায় পরিচিত হয় খেজুর মোতালেব নামে।
পরীক্ষায় সফলকাম হওয়ার পর সে এক বিঘা জমি কিনে তৈরি করে বিশাল খেজুর নার্সারি। বিনা পয়সায় খেজুর খাওয়ায়ে চড়া দামে বিক্রি করে খেজুর চারা। তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় করা হয় এক একটি চারা গাছ। চারা বেচা টাকায় মোতালেবের কাঁচাঘর এখন পাকা বাড়ি।
অনেকেই খেজুর খেয়ে বিচি পুঁতেছে, কিন্তু চারা গজায়নি। বালুর বস্তার গোমর সে ফাঁস করে না কারো কাছে।
বিদ্যাছাড়া বুদ্ধিরও কদর আছে। বিদ্যা থাকলেও অনেকে বোকা থেকে যায় আজীবন। বালুর বস্তা টানলেও বুদ্ধিমানরা কখনো বোকা হয় না।

 

Share.

মন্তব্য করুন