ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুতে বিভিন্ন রঙে-রূপে সাজে সকল দেশের এই রানী। ছয় ঋতুর পরিক্রমায় সোনালি রঙ ছড়িয়ে আসে চতুর্থ ঋতু হেমন্ত। বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো, ‘ঋতু বলতে কী বোঝায়? হ্যাঁ। ঠিক বলেছো।’ ঋতু হলো, ‘বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের এই পৃথিবীর কোন একটি দেশ বা অঞ্চলের জলবায়ুর ধরন। ইংরেজিতে যা Late Autumn বলা হয়। মহাকাশে সূর্যের অবস্থান অনুসারে পৃথিবীর অক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঋতু পরিবর্তন সংঘটিত হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে কার্তিক ও অগ্রয়াহণ এই দুই মাস হেমন্তকাল। ঈসায়ী ক্যালেন্ডার যা আমাদের দেশে ইংরেজি সন বলে পরিচিত সেই অনুসারে মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর সময়কাল হেমন্ত ঋতু। মূলত হেমন্তকাল হচ্ছে শরৎ ও শীতকালের মধ্যবর্তী একটি পরিবর্তনশীল পর্যায়, তাই ইংরেজিতে একে খধঃব অঁঃঁসহ বলা হয়। বাংলা অভিধানে হেম শব্দের অর্থ স্বর্ণ বা সোনা। এই ঋতুতে আকাশে সাদা মেঘের ভেলা থাকলেও ফসলের মাঠে থাকে পাকা ধান। মাঠে মাঠে পাকা সোনালি ধানের শিষের দোলা কৃষাণ-কৃষাণীর মনে জাগায় খুশির ঢেউ। অন্তহীন এই সোনালি আনন্দের কারণেই হয়তো বা এই ঋতুর নাম হেমন্ত।
কবি সুফিয়া কামালের ভাষায়: ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে / কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে।’
এ সময় চাষিরা ধান কেটে ঘরে তোলে এবং ঘরে ঘরে উৎসব শুরু হয়।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়,
‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান
আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলেরই বান।’
শুধু কৃষকের শূন্য গোলায় ফসলের বান ডাকে না। মনেও আসে খুশির জোয়ার। নতুন ধানের গন্ধের সাথে সাথে নবান্ন উৎসবের পিঠা, পুলি আর মুড়ি-মোয়ার আয়োজনে মৌ মৌ আমেজে ভরে ওঠে গ্রাম-বাংলা।
এই সময় বাড়ির পাশের ক্ষেতগুলোতে শোভা পায় হলুদ মটর আর খেসারির ফুল। হেমন্তে শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, ধারমার, রাজঅশোক ইত্যাদি নানা ধরনের ফুল ফুটে। বাড়ির উঠানে ভোরে শিউলি গাছের নিচে পড়ে থাকে রাতে সুবাস ছড়ানো শিশির ভেজা সাদা সাদা ফুল। হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ সবার প্রাণে আনে উৎসবের মেজাজ। এই ঋতুতে দিনের শেষে তাপমাত্রা খুব বেশি কমে যায়। ফলে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে থেকেই বিকেলে ঠা-া পড়তে থাকে। ঘাসের ওপর জমে শিশির; কুয়াশাও দেখা যায় প্রায়ই। ধান কাটা, মাড়াই এবং কৃষকের গোলায় তোলা উপলক্ষে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় উৎসব। নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষকরা এই উৎসব পালন করে থাকে। সাধারণত নবান্ন হয় অগ্রহায়ণ মাসে। সে সময় আমন ধান কাটা হয়। এই নতুন ধানের চাল রান্না উপলক্ষে উৎসব হয়ে থাকে। আগের দিনে কোন কোন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে নিয়ে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হতো এবং পরে ক্ষেতের বাকি ধান কাটার পর চাল করে নতুন চালের পায়েস করে নবান্ন করা হতো। ঐতিহাসিকদের গবেষণা থেকে জানা যায়, কৃষির মতই প্রাচীন এই প্রথা। নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসব এখনো হয়। পিঠা-পুলি, মজার মজার খাবার আয়োজন, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে।
হেমন্তে নদী-নালা, খাল-বিলের পানি কমতে থাকে। সেই কম পানিতে গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা মেতে ওঠে মাছ ধরার উৎসবে। বড়রাও দল বেঁধে জাল নিয়ে নেমে পড়ে বিল, ঝিল, খাল, নদীর পানিতে। বোয়াল, শোল, রুই, কাতলা মাছ ধরে ঘরে ফেরে।

 

Share.

মন্তব্য করুন