যুদ্ধের ডামাডোলে কত মানুষ যে হারিয়ে যায়! তখন ওরা হারায়নি। আর এখন- এখন এই মুক্ত পরিবেশে ওরা হারিয়ে যায়। হারিয়ে কোথায় যায়? কেনইবা হারায়? রেডিওতে নিখোঁজ সংবাদ শুনতে শুনতে শাহীনের কথা ভাবছিলেন হক সাহেব।
দুপুরের পর থেকে খোঁজ নেই ছেলেটার। ভর সন্ধ্যায় বিটু ঘুমুচ্ছে। ওদের মাকেও দেখা যাচ্ছে না। মেঝোটা কোথায়?
: এই যে আব্বা আমি ….।
দরজার আড়াল থেকে লাফ দিয়ে ঘরে ঢোকে মিঠু। ইচ্ছে করল একটা চড় কষে দেন ওর গালে কিন্তু সামলে নিয়ে কান চেপে ধরলেন।
: একদিন না বলেছি আজানের আগে আগে ঘরে ফিরতে। মনে থাকে না?

মনে ঠিকই থাকে। বাবাকে ভয়ও করে। মাও কম কড়া নন। একবার ধরলে আর রক্ষা নেই কিন্তু কিভাবে যেন দেরি হয়ে যায়। খেলার ভীষণ নেশা পেয়ে বসে। এই যে আজ বিকেল ৩টা থেকে বেলা ডুবার পরও বল ছাড়েনি মিঠু। অবশ্য বাবুই বাদ সাধছিল বেশি।
: নারে, আর খেলব না, আজান পড়ে গেছে
: না, না- খেলতে হবে। এখনো পাঁচ মিনিট বাকি।

বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বল পায়ে ছুটে যায় মিঠুদের গোলমুখে। গোলমুখে ইতস্তত মিঠুকে ফাঁকি দিয়ে বল ঢুকে যায় বারে।
: গো-ও-ল…

ছ্যাঁচ্ড়ামি করে খেলায় সমতা আনে বাবুরা। আসলে বাবুদের সঙ্গে পারা কষ্ট। যে পাঁচ মিনিটের দোহাই দিয়ে ওরা খেলা চালিয়ে যেতে থাকে সে পাঁচ মিনিট ওরা খেলেনি। মিঠুদের দুর্বলতার সুযোগে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে একটা গোল করে বলে-খেলা শেষ-ড্র
তারপর একজন বলটাকে ছুড়ে মারে পাশের ডোবায়। এমন বিতর্কিত গোলে মিঠুরা অনেকদিন পর জয়ের মুখ দেখেও ব্যর্থ হয়। সময়ের মিথ্যে অজুহাতে আর বাবুর কাণ্ঠামিতে মিঠুর দল খুবই হতাশ। অবশ্য দল নায়ক হিসেবে বাবু খেলেও মন্দনা। কিন্তু আজ সে হয়তো একটা চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। আজকের বলটা ও’ই বানিয়েছে। বল না ছাই! বল পাবে কোথায় ওরা? ওদের বড় ভাইরাইতো বল পায় অনেক কষ্টে; ক্লাব থেকে কিংবা চাঁদা দিয়ে কিনে। তাই বলে ওরা বল খেলবে না? দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে দোষ কী! রাস্তা ঘাটে মিল্কভিটা দুধের খালি প্যাকেট তো কতই পাওয়া যায়। ওগুলোর একটার মধ্যে খড়কুটো, কাগজ ভরে মুখটা বস্তার মত বেঁধে দিলেই তো একটা বল হয়ে যায়। এভাবেই প্রতিদিন মিঠুরা বল খেলে।
বাবুর বানানো বল আজ ঘন ঘন খুলে যাচ্ছিল। নিজেদের গোলমুখে এলেই “বল খুলে গেছে” বলেই বাবু বল হাতে তুলে নেয়। অহেতুক বল ধরার জন্য আট-দশবার তাকে হ্যান্ডবল করা হয়েছে। বাবুর আর একটা দোষ হচ্ছে পায়ে একটু টোকা লাগলেই ‘ও বাবাগো’ বলে পা চেপে ধরে বসে পড়ে। শেষে ফ্রি কিক আদায় করে আবার ছুটে যায় গোলমুখে। এভাবে কিছু সময় নষ্ট হওয়ার অজুহাতে বাবুরা কোন রকমে ড্র করে বাড়ি চলে যায়। তখন চারদিকে অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাসায় গেলে আজ যে মা কি করবেন। আর আব্বা এলেতো কথাই নেই। ভয়ে দুরু দুরু বুকে মিঠু বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। বাড়ি বলতে এই দু-চার-দশ গজ মাত্র। গেটে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ায় সে। হায় আল্লাহ! এমন খালি খালি লাগছে কেন নিজেকে? তাইতো! পায়ের স্যান্ডেল কোথায়। নিশ্চয় মাঠে ফেলে এসেছে। দিশেহারা হয়ে মাঠের দিকে দৌড় দেয় মিঠু। কিন্তু কোথায় স্যান্ডেল? খেলা শেষে হইচইয়ের মাঝে পায়ের লাথিতে কোথায় গিয়ে পড়েছে স্যান্ডেল তা কে জানে। নাকি দুষ্টুমি বা রাগ করে স্যান্ডেল কেউ লুকিয়ে রেখেছে। কাকে সে জিজ্ঞাসা করবে এ কথা? সবাইতো যে যার মত চলে গেছে। হয়ত এতক্ষণ পড়াও শুরু করে দিয়েছে। অন্ধকারে ঘাস আর লালমাটির ওপর অনুমানসিদ্ধ জায়গায় হাতড়াতে থাকে। শেষে হতাশ হয়ে আধো কাঁদো অবস্থায় বাবুদের বাসায় দিকেই রওনা দেয় মিঠু। বাবুটাতো ভীষণ পাজি। জিততে পারেনি বলে জিদ করে হয়ত ওর স্যান্ডেল লুকিয়ে রেখেছে। প্রায়ই সে এমন করে। দু’দিন আগে সে নাসিরের স্যান্ডেলও ফেলে দিয়েছিল পাশের পচা ডোবাতে। নাসির কিন্তু ছাড়েনি। কষে দুই ঘুষিতো মেরেছেই তারপর আবার কাঁদতে কাঁদতে বাবুর মার কাছে গিয়ে নালিশ করেছে। বাবুর আম্মাও দু’চড় মেরেছে বাবুকে এবং সাথে বাঁশের কঞ্চি আর হারিকেন নিয়ে ডোবা থেকে স্যান্ডেল তুলে বাবুকে দিয়ে ধুইয়ে আবার নাসিরের বাসায় দিয়ে আসতে বলে। সেই থেকে অবশ্য নাসির এ পাড়ায় খুব একটা আসে না। অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলে।

খেলার মাঠে স্যান্ডেল হারানোটা খুবই বিচ্ছিরি ঘটনা। সবাই স্যান্ডেল খুলে থ্রোলাইনের পাশে রেখে দেয়। দু’চার জোড়া অবশ্য গোলবার তৈরিতে কাজে লাগে। সাধারণত যারা গোলকিপার হয় তাদের স্যান্ডেল দিয়েই গোলবার সাজানো হয়। নিয়মিত গোলকিপার না থাকায় আজ মিঠুকেই গোলমুখে দাঁড়াতে হয়। আর আজকেই দিতে হচ্ছে ওকে খেসারত।
বাবুদের বাসায় ঢুকতেই বাবু একেবারে কিরে-কসম কেটে অস্থির। সে নাকি স্যান্ডেল নেয়নি। কিন্তু মিঠুতো ওকে কিছু বলেইনি। ব্যাপার বুঝে রান্নাঘর থেকে বাবুর আম্মা এগিয়ে এসে বাবুর কান টেনে ধরে বলে, ও যে স্যান্ডেল চাইতে এসেছে তুই কি করে বুঝলি? নিশ্চয় তুইই লুকিয়েছিস। যা, এক্ষুনি বের করে দে। সুযোগ বুঝে মিঠু বলে-এমনিতে বাসায় ফিরতে দেরি। তারপর যদি শোনে স্যান্ডেল হারিয়েছে তা হলে আব্বা আমাকে মেরে ফেলবে।
: না, না, তুমি বস। এই বাবু স্যান্ডেল এনে দে বলছি।
মুহূর্তের মধ্যে বাবু মাঠের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। দু’ মিনিট পরে একজোড়া স্পঞ্জ নিয়ে হাজির। চটাস করে দরজার কাছে ছুঁড়ে ফেলে। বাবুর আম্মা মিঠুকে বলে-“চল বাবা, তোমাকে দিয়ে আসি। এই বাবু আয় তো।”

কান ধরে দু’টান মারতেই কেঁদে দেয় মিঠু। উঠোনে দাঁড়িয়ে বাবুর আম্মা মিঠুর আম্মার সঙ্গে কথা বলছিলেন ছেলেদের দুরন্তপনা নিয়ে। কান্নার শব্দে এগিয়ে যায় দু’জন। বাবুর আম্মা হাত ধরে মিঠুকে সরিয়ে আনেন। মুখে বলেন-ভাইজান, মেরে কি করবেন। আমার বাঁদরটার জন্যই দেরি হয়েছে।
: বসেন আপা। কি আর বলব বলেন; ছেলেগুলোকে নিয়ে আর পারি না…।
মিঠুর আম্মা এবার কথা বলেন।- “কত করে বললাম ছোট দুটোকে ধারে-কাছে কোন স্কুলে দেন। তাতো কানে নিচ্ছেন না।
: কেন, আগের স্কুলে গেলেইতো পারে।
: অভয় দাস লেন অনেক দূর হয়ে যায়। এখান থেকে কেউ যায় না।
বাবুর আম্মা বলল- গোপীবাগে ভর্তি করে দেন না। বাবুতো ওই স্কুলেই যায়।
হক সাহ্বে সম্মত হলেন। ঠিক হলো কালই ওদের ভর্তি করে দেয়া হবে। যদিও এখন বছরের ছ’মাস পেরিয়ে গেছে। অথচ মনে হয় এই সেদিন-যুদ্ধে শেষ হয়েছে। যুদ্ধের ডামাডোলে ছেলেগুলোর লেখাপড়াই হলো না। শাহীনটা কোন রকমে বঙ্গভবনের স্কুলে যায়। মনু নামে এক ক্লাসমেটকে পেয়েছে সে। ছেলেটা কেমন কে জানে। বাপ তো বেশ ভদ্রলোক। সচিবালয়ে কাজ করে। বাবুর আম্মা উঠি উঠি করে। মিঠুর আম্মা বললেন, আপা আর একটু বসেন। শাহীনকে তো পাওয়া যাচ্ছে না।
: ওতো মাঝে মাঝেই এমন করে। বকেন না কেন ওকে?
: বকিতো আপা।
: কার সঙ্গে থাকে ও।
: ঐ তো পাশের বাসায় ভাড়া থাকে। আসলাম সাহেবের ছেলে। একই স্কুলে পড়ে।
: ও ছেলেকে তো ভাল বলে মনে হয় না।
খুব চাপা স্বরে কথাগুলো বলল বাবুর আম্মা। তারপর মিঠুর দিকে তাকিয়ে বলল-যাও, বাবুকে একটু পড়া দেখিয়ে দাও। মিঠু আর বাবু চলে যেতেই মহিলা একটু গলা খোলেন- ‘বলছিলাম কি, ছেলেটা কিন্তু বিড়ি খায়।’
আঁতকে ওঠেন মিঠুর বাবা-বলেন কী!
: একটু কম মেলামেশা করতে দেবেন
: না, না। আমি টোটালি বন্ধ করে দেবো।

বাবুর আম্মা চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন কাল সকালে যেন মিঠু আর বিটুকে উনাদের বাসায় পাঠিয়ে দেন। বাবুর বড় ভাই ওদের নিয়ে ভর্তি করে দিয়ে আসবে। বাবুর আম্মা চলে যেতেই হক সাহেব মিঠুর আম্মার ওপর চড়াও হন-তোমার জন্যই ছেলেগুলো উচ্ছন্নে গেছে।
: শুধু আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন। মনুদের বাসায় একটু খোঁজ নেন না।
: না, তুমি যাও। দেখ গিয়ে ও বাড়িতে আছে কিনা।

আসলাম সাহেবের পরিবারটি খারাপ না। চার ছেলে-মেয়ে। একমাত্র ছেলে মনু। ভালো নাম কি ‘রাব্বি’ যেন। তিন বোন। শেলী, বেলী, নাছিমা। শেলীটা মিঠুদের বয়সী। শেলীর চেহারা বেলী ফুলের মত; বেলীটা দেখতে কালো। আর বড় আপা নাছিমা কিসে আদর করে মিঠুদের! মিঠুর আম্মাকে ওরা ‘আন্টি আন্টি’ বলেই অস্থির।
মিঠুকে পড়তে বসিয়ে বিটুকে নিয়ে মনুদের বাসায় আসেন মিসেস হক। মিসেস আসলাম বেতের মোড়া এগিয়ে দেন। বসতে বসতে মিসেস হক বললেন- না আপা, বসব না। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা রেখে সেই যে বেরিয়েছে শাহীন; আর খোঁজ নেই। মনু কোথায়?
: আর বলবেন না, বাঁদরটার চিন্তাতেইতো আছি। তারও খোঁজ নেই।
: মনু কোথায় কোথায় যায়-চলেন না একটু খোঁজ নিয়ে আসি।
: আপনি বসেন, গল্প করি। ওর বাবাকে পাঠিয়েছি। এক্ষুনি চলে আসবে।
গল্প বেশ জমে উঠেছে দু’ আম্মার মধ্যে। এর মাঝে চা খেয়ে পানের পর্বও শুরু হয়ে গেছে। বিটুকে ডেকে নেয় বেলী আপা। বীজগণিতের সমীকরণ করতে করতে বিটুর সঙ্গে আলাপ জমায়।
: এই যে কালো মানিক ….।
: আমাকে ‘কালো’ বললেন কেন?
: সঙ্গে মানিকও বলেছি
: জানেন বেলী আপা? মিঠু না আমাকে কালিদাস বলে। এর মানেটা কি, বলেনতো?
: কালিদাস একজন বড় কবি ছিলেন।
: উনি কি দাস ছিলেন?
: আরে না, কালো মানিকের অর্থ মনে আছে তো?
: খুবই মনে আছে। ঐ যে, ফুটবল খেলতো খুব ভালো।
: ঠিক বলেছ। তা তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?
: জানেন বেলী আপা, আল্লাহ আমাকে কালো মাটি দিয়ে বানিয়েছেন বলে মিঠু ভাইয়া আমাকে ঘেন্না করে।
: আমিওতো কালো। জানো, কালো হচ্ছে বেহেস্তের আলো। আর সাদারা হচ্ছে গাধা। তোমার মিঠু ভাইয়া একটা গাধা আর আমাদের শেলীটাও।
পাশের টেবিলের এক কোনায় শেলী বই নিয়ে গুনগুন করে ‘মামার বাড়ি’ পড়ছিল। বেলী আপার খোঁচাতে ও চটে ওঠে।
: দাঁড়াও, আমি মিঠুকে বলে দিচ্ছি।

ছেলে-মেয়েদের কা- কারখানার গল্পে গল্পে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। আটটা বাজে বাজে। ছেলের খোঁজ নিয়ে আসলাম সাহেব এলেন না। ওদিকে হয়ত মিঠুর আব্বা আরও রেগে যাচ্ছেন। মিসেস হক উঠি উঠি করেন। এমন সময় উঠোনে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকে মনু।
: এসো সোনার চান। আজ তোমাকে …. ।
তেড়ে উঠে এলোপাতাড়ি কিল-চড় বসাতে শুরু করলেন মনুর আম্মা। বল, কোথায় গিয়েছিলি?
: স্কুলে অনুষ্ঠান ছিল।
: মিথ্যুক, আগে তো বলিস নি। মিঠু কোথায়?
: বাসায় পৌঁছে দিয়েছি।
: সত্যি করে বল, কোথায় গিয়েছিলি?
: মিঠুর সঙ্গে কচিকাঁচায় ছবি আঁকতে।
: ফের মিথ্যে কথা। হাতে কি?
: ছবি এঁকে পুরস্কার পেয়েছি।
ছবি সে কখনো আঁকে না। হয়ত সে মিঠুর সাথে কচি কাঁচায় গিয়েছে। কিন্তু একদিনে ছবি এঁকে পুরস্কার পাওয়া খুবই অবাস্তব। তা ছাড়া ছবি আঁকার পুরস্কারে কি খেলনা পিস্তুল দেয়া হয় নাকি। মিঠুর আম্মা অন্য কিছু ভাবেন। কিন্তু মিসেস আসলাম বিষয়টির ইতি টানার জন্য তৎপর হন।
: ঠিক আছে। পিঠে ছালা বেঁধে বসে থাকো। তোমার আব্বা আসুক। দেখেছেন আপা, বলেনতো, এটাকে নিয়ে কি করি?
: আমারওতো সেই প্রশ্ন। দেখি গিয়ে ওটার কি অবস্থা। ওর বাবাতো ধরলে ছাড়ে না।
মাঠ পেরিয়ে বাসার কাছে যেতেই হইচই শোনা যায়। ও আল্লারে, বাবারে, মাগো ইত্যাদি বিলাপে শাহীন চেঁচাচ্ছে। দরজা বন্ধ করে হক সাহ্বে ছেলেকে শাসন করছেন। শাহীনের চিৎকারে পাশের ফজলু সাহেব আর তার ছেলেরা বেরিয়ে আসে।
: হক সাহেব দরজা খোলেন। এভাবে বাচ্চাদের মারতে নেই।
বৃদ্ধ ফজলু সাহেব দরজা ধাক্কাধাক্কি করেন। মিঠু বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অসহায় মিঠুর আম্মাও চোখের পানি রাখতে পারেন না।
: মেরে ফেলেন। ভালো যখন হবে না তখন মেরেই ফেলেন।
: আরে বাবা, দরজাটা একটু খোলেন না; শুনিতো কি হয়েছে।
ফজলু সাহেব একটু রেগেই কথাগুলো বলেন। হক সাহেব এবার একটু নরম হলেন বোধ হয়। অস্থিরভাবে ফজলু সাহেবের উদ্দেশে বলেন- আগে ওকে সত্যি কথা বলতে বলেন। তারপর লাঠি উঁচিয়ে শাহীনকে বলেন-এখনো সত্যি বল, বলছি। কোথায় গিয়েছিলে?
: শিশু একাডেমির মেলায়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে শাহীন বলে।
: এগুলি কোথায় পেলি?
: মনু দিয়েছে।
: কিনেছে, না চুরি করেছে?
: নাড়াচাড়া করে দেখতে দেখতে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। তারপর আমাকে এই গাড়িটা দেয়।
: আর যদি কোনদিন ওর সঙ্গে তোকে দেখি।

দরজা খুলে দেন হক সাহেব। ততক্ষণে বিরক্ত হয়ে ফজলু সাহেব চলে গেছেন। মলিন মুখে মিঠুরা ঘরে ঢোকে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হক সাহেব রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে বিছানায় শুয়ে পড়েন। কপালের ওপর হাত চলে যায় তার। আর চোখ চলে যায় সিলিংবিহীন ঘরের চালে।
হারিকেনের নিভু আলোতে পড়তে বসে মিঠুরা। মা রাতের খাবারের আয়োজনে চুলোর পিঠে যান।

খুব সকালে ব্রাশ করতে করতে মিঠু মনু ভাইদের বাসার দিকে যায়। মনের মধ্যে খুব জিদ ওর। ও বাসার কারো সঙ্গে দেখা হলেই দু’চার কথা শুনিয়ে দেবে। শেলীর সাথেই দেখা হলো। সেও ব্রাশ করছিল। মিঠুকে দেখে এগিয়ে আসে। থু করে পেস্টের ফেনা ফেলে জানতে চায়- তোমাদের বাসায় কি হয়েছিল কালরাতে?
: দাদাকে খুব মেরেছে
: কেন?
: তোমার ভাইয়ার জন্যই তো। কি সব চুরি করে আমার দাদাকে দিয়েছে।
: কি! তুমি আমার ভাইকে চোর বললে? যাও তোমার সঙ্গে আড়ি।

মুহূর্তের মধ্যে আড়ি নিয়ে শেলী চলে যায় বাড়ির ভেতর। মিঠু ভাবল ‘এভাবে কথা বলা হয়ত ঠিক হয়নি। তাই বলে ছেড়ে দেবে নাকি সে শেলীকে? কিছুতেই না। দাদার করুণ কান্নার কথা সে ভুলতে পারে না। সারারাতে তার ঘুম খুব কমই হয়েছে। মনুভাই ঘুম থেকে অনেক দেরি করে ওঠে। উঠেই বলে- নাস্তা দাও। হোম ওয়ার্কের বালাই নেই। বই বগলদাবা করেই মিঠুদের গেটের সামনে আসে। গেটে সামনে মিঠুর আব্বা। মনু থতমত খেয়ে যায়।
: শাহীন স্কুলে যাবে না আংকেল
: না বাবা, ওর শরীর ভাল না।
মনু চলে গেলে খেলনা দুটো নিয়ে মিসেস হক মনুদের বাসায় যান। মিসেস আসলামের মুখটা খুব মলিন হয়ে যায়। নিচু স্বরে বললেন-জানি আপা, কি নালিশ নিয়ে এসেছেন। কালরাতে ওর বাবা ওকে বকেছে। তারপর ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।
খেলনা দুটো মিসেস আসলামের হাতে তুলে দিয়ে মিঠুর আম্মা বললেন, এ কাজটা কিন্তু খুব ভুল। বাইরে রাত কাটাবার সুযোগ কোন মতেই দেবেন না।
: পরে আমি ভুল বুঝতে পেরে ওকে খুঁজে আনি। ওপাড়ার এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিল।
মায়ের কথায় কেমন যেন একটা আহ্লাদ আর আশকারা প্রকাশ পায়। নাছিমা, বেলী বলে ওঠে-তুমিই কিন্তু মনুটাকে লাই দিচ্ছ।
: তা হলে আমাকে কি করতে বলিস?
: কই, একবারওতো ভালো করে জিজ্ঞেস করলে না খেলনার কথা। দু’ঘণ্টা আগে যে স্কুলে গেল তাতেওতো বাধা দিলে না।

নাস্তা করছিল শেলী। বড় পা, মেঝ পা, আন্টি আর মার কথায় ওর কান যায়। সত্যিই তো, মিঠুতো তাহলে ভুল বলেনি। শুধু শুধি ওর সঙ্গে কাট্টি নিয়েছি।
: আন্টি, মিঠু ভাইকে একটু আসতে বলবেন কিন্তু।
: তুমিই চলো না, আসো।

শুধু শেলীই এসেছে তা নয়। শাহীনকে দেখতে এসেছে নাছিমা, বেলী আর মিসেস আসলাম। শেলীর চোখাচুখি হতেই মিঠু ভেঙচি কাটে। শেলী বলল-কাট্টি তুলে নিলাম। বলেই ডান হাতের ছোট আঙুলের মাথা জিহ্বায় রেখে আবার কপালে ছোঁয়ায়। এভাবে করলে নাকি আড়ি ভেঙে যায়। এক নিমিষে রাগ ভেঙে যায় মিঠুর। তারপর ওরা শাহীনের কাছে যায়। শাহীন থেকে থেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মিঠু একটু সমবেদনা জানিয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করলেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে। থাক থাক আর দরদ দেখাতে হবে না। আমাকে যখন মারছিল তখনতো তুই হাঁ করে দেখছিলি। কেন আম্মাকেতো ডেকে আনতে পারতি…..।
দাদার কথায় মিঠুর খুব কষ্ট লাগে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। শেলী বলল-কোথায় লেগেছে দাদা?
শাহীন রাগে অভিমানে নিরুত্তর। ঘুরে বসতেই হাঁটুর কাছে একটু ফোলা দেখা যায়। মিঠু ওখানে আঙুল ছুঁইয়ে শেলীকে কেবল বলে-এই দ্যাখ ‘দাগ’। অমনি চেঁচিয়ে ওঠে ‘উ বাবাগো’ বলে। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। মিসেস হক বললেন-দেখেছেন বাঁদরের কান্ড? সবাই হেসে ওঠে কিন্তু মিসেস আসলাম একটু সিরিয়াস হয়ে বললেন, তুমি মনুর সঙ্গে আর থেকো না বাবা।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শাহীন একটু স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বেলা তখন দশটা। স্কুল এগারোটায়। শাহীন বলে-আম্মা, আমি স্কুলে যাবো।
: যেতে পারবিতো
: বিকেলে আমি কচিকাঁচায়ও যাব।
: ঠিক আছে যাস।
: আম্মা, আমি আজ সারাদিন দাদার সঙ্গে থাকব। মিঠু বলল।
: আজ না তোদের স্কুলে ভর্তি হবার কথা।
: দাদাই আমাদের ভর্তি করে দেবে।
: আরে না না, স্যারদের আমার খুব ভয় করে।
: ঠিক আছে, তুই ওদের বাবুদের বাসায় নিয়ে যা। বাবুর বড় ভাই ইমরান ভর্তি করে দেবে।

ইমরান ভাই খুব ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। ঢাকায় কোন নামি ক্লাবে নাকি খেলে। মিঠু আর বিটুকে ভর্তি করে দিল গোপীবাগ প্রাইমারিতে। বই, পেন্সিল আর খাতা কিনে দিল দু’ভাইকে। শেষে বিটুকে নিয়ে গেল বাসায়। আর মিঠু গেল শাহীনের সঙ্গে। বড় ভাইয়ের বইগুলো বগলদাবা করে আর,কে, মিশন রোড ধরে বঙ্গভবন স্কুলের দিকে এগিয়ে যায় মিঠু। গর্বে ওর বুকটা ইয়াবড় হয়ে যায়। যেন সে নিজেই ক্লাস ফোরে পড়ে।
স্কুল গেটে মনুর সঙ্গে দেখা। আইসক্রিম খাচ্ছিল। শাহীনকে দেখে খুশি হলেও সঙ্গে ভাইটিকে দেখে কপাল কুঁচকায়।
: কিরে, আংকেল যে বলল স্কুলে আসবি না
: এলাম তোর সাথে দেখা করতে।
: মানে? ….. নে আইসক্রিম খা। অর্ধেক আইসক্রিম শাহীনের দিকে এগিয়ে দেয়। শাহীন হাত ইশারা করে ‘না’ বলে। মিঠু বলে-দাদার ঠা-া লেগেছে, খাবে না।
: তুমি বেশি কথা বলো। একটু রাগ হয়ে মনু বলে। শাহীন বলে- নারে, সত্যিই কিছু খাবো না। মন ভালো নেই। এখন থেকে মন দিয়ে পড়ব আর ছবি আঁকব। তোর সঙ্গে শুধু স্কুলেই দেখা হবে।
মনুর সঙ্গে শাহীনের এ-ই শেষ কথা। ঘণ্টা পড়ে গেলে শাহীন ক্লাসে যায়। মিঠুকে বলে-একটু ঘুরে ফিরে দেখ। এক পিরিয়ড করে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাব। খবরদার পেছন দিকটায় যাবিনে-ওখানে বানর আছে।
বঙ্গভবন স্কুলের বিশাল এলাকার পেছন দিকটা বনের মত। অনেক বানরের আড্ডা ওখানে। ভীষণ উৎপাত করে। ছাত্রদের টিফিন চুরি করে খেয়ে ফেলে। বই খাতা ছিঁড়ে ফেলে। পানির বোতল, টিফিন বক্স নিয়ে উধাও। অনেক ছেলেকে মারধরও করে। মিঠু একটু সাহস করে স্কুলের পেছনের দিকে যায়। উঁচু এক গাছের মগডালে সত্যিই দেখা গেল এক বানর পরিবারকে। বাচ্চাকে কেমন নিবিড় মমতায় আদর করছে।
: এই ছেলে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে কি করছ?
গার্ডের আচমকা চড়া গলায় ভীষণ ভয় পেয়ে যায় মিঠু। থতমত খেয়ে বলে-আমি এই স্কুলে পড়ি না। দাদার সঙ্গে এসেছি।
: বানর তাড়া করবে। যাও, গেটের সমনে গিয়ে অপেক্ষা কর।
: ওদের বের করে দিতে পারেন না?
: ওরা আমাদের অতিথি। আমাদের সম্পদ।
: ওরা তো ভীষণ উপদ্রব করে
: কিছু কিছু ছেলে বাঁদরের সঙ্গে বাঁদরামি করে ওদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে। সেই থেকে ওরা একটু জ্বালায়। আমরা দেখে শুনে রাখি।
টুং করে একটা ঘণ্টা পড়ল। শাহীন বেরিয়ে এলো। বাদাম কিনে দিল মিঠুকে। তারপর খেতে খেতে বাড়ির দিকে। হাঁটতে হাঁটতে কপাল নিচু করে শাহীন বলল- দেখত, জ্বর হয়েছে কি-না।
কপালে হাত রেখে মিঠু বলল-ইস, পুড়ে যাচ্ছে।

দুপুর নাগাদ জ্বর কমে যায়। বিকেল গড়াতেই শাহীন বলল-চল, কচিকাঁচায় যাই। মিঠু রাজি হয়ে যায়। ভাইয়া এমন ভালো হয়ে গেল কেন? সেধে সেধে কত আদর করছে মিঠুকে। বিটুকে আচার কিনে দেয় আর বলে-বাইরে বেরুবি না।
মিঠুরা যখন মাঠ পার হচ্ছিল তখন বাবুরা বলে- এই মিঠু, আজ খেলবি না?
: না, দাদার সঙ্গে যাচ্ছি। ছবি আঁকা দেখব
: তুই বুঝি শিল্পী হবি? টিপ্পনী কাটে বাবু।
শাহীন কটমট করে তাকায়। মাথা নিচু করে সরে যায় বাবু। পেছন ফিরে মিঠু বাবুর উদ্দেশ্যে এমনভাবে হাত নাড়ে যেন বলছে ‘মনে কিছু করিস না’।

কচিকাঁচার আসরে এসে চোখ জুড়িয়ে যায় মিঠুর। আরে বাবা! এ দেখছি এলাহি কা-! কত রং, কত তুলি, কত ক্যানভাস, কত ছেলে ছবি আঁকছে! কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। মোম দিয়ে তৈরি পেন্সিল নাড়া চাড়া করতে করতে মিঠু জানতে চায়-এগুলি কি?
: মোমরং। নিবি নাকি। নে না দুটো। পকেটে ভর।
মিঠু ইতস্তত করে। শাহীন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে-তাড়াতাড়ি ঢোকা না পকেটে। দাদা ভাই দেখে ফেলবে তো।
: সেটা আবার কে?
: ঐ যে দেখছিস না? ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকা দেখছে।
সামনের দিকে তাকায় মিঠু। সুন্দর ছিমছাম পরিপাটি চেহারার এ ভদ্রলোক টহল দিচ্ছেন পুলিশের মত। উনিই এখানকার প্রধান। সবাই দাদাভাই বলে ডাকে।
মিঠুর হাত থেকে মোমরংগুলো নিয়ে শাহীন পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। মিঠুর গা কাঁপতে থাকে। পরক্ষণে শাহীন কি মনে করে মোমরংগুলো আবার রেখে দেয়। বলে-আব্বা দেখলে দু’জনকেই মারবে। চল এবার যাই। কেমন হয়েছেরে ছবিটা?
: খু-উ-ব সুন্দর! চা বাগানের সবুজ শ্যামলিমায় মিঠুর চোখ জুড়িয়ে যায়। একেবারে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

রাতের বেলা তিন ভাই সুর করে পড়ল। মা বাবা খুব খুশি। হক সাহেব শাহীনের জন্য রং পেন্সিল এনেছিলেন। মিসেস হক ওগুলো দিতেই শাহীন খুশিতে বাগবাগ। সে ভাবল বিকেলে মোমরং চুরি না করার জন্যই যেন এই উপহার মিলেছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে-আর সে মন্দ কাজ করবে না। কিন্তু একটা কথা ভেবে ওর মনে খুব কষ্ট লাগে। বাবা কেন ওর সঙ্গে মন খুলে কথা বলে না?

সবুজ শাক আর দূর্বাঘাসে মাঠের চারপাশ ভরে গেছে। শুধু মাঠের মধ্যখানে টাক পড়ে আছে। খুদে ‘পেলে’দের পায়ের দাপট কি আর সবুজমতির কোমল ঘাস সইতে পারে? পারে না। যেমন পারে না মিঠু ওর দাদার মনের ব্যথা সইতে। দাদা কেমন মনমরা হয়ে থাকে। এই যে আজ সকালে আরবি পড়তে পড়তে দাদা কেবলি আনমনা হয়ে যায়। উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
তিন ভাইকে এক লাইনে পড়তে বসিয়ে মিসেস হক যান নাস্তা তৈরি করতে। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে উচ্চ স্বরে তদারকি করছেন। বাচ্চাদের পড়াশুনার। আর ওরাও উঠে গিয়ে শুনিয়ে নিচ্ছে নিজ নিজ পড়া। শাহীনটা বেশি বেশি উঠছে। এত উঠছে কেন? ফাঁকি দিচ্ছে নাতো?
: এত আসতে হবে না। যাও আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। কোরআন শরীফ সালাম করে রেখে দাও।
: আম্মা আমার বাথরুম চেপেছে।
: যাও। এসে নাস্তা করবে।
বাথরুমে যাবার নাম করে শাহীন বেরিয়ে আসে মাঠে। মাঠ থেকে রাস্তায়। তারপর গলির মুখে। গলি থেকে মেইন রোডে। গোপীবাগ রেললাইনে পা দিতেই ডান দিকে চোখ চলে যায়। ওদিকে রেলস্টেশন। কত দুরন্ত ট্রেন চলে যায় ওখান থেকে। কোথায় কোথায় যায় ওরা?
রেলগেট পার না হয়ে সে ডানেই ঢুকে পড়ে। কমলাপুর স্টেশনের দিকে। রেলের পাতে পা রাখতেই শির শিরে একটা অনুভূতি বয়ে যায় মনে। রেললাইন, রেলগাড়ি আর রেলস্টেশন যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে রেল পাতের উপর দিয়ে। দু’হাত প্রসারিত করে দেয় দুদিকে। কেঁপে কেঁপে পড়ে যেতে চায়। পড়ে গিয়ে আবার ওঠে। আবার পড়ে। এভাবে খেলতে খেলতে স্টেশনে এসে পড়ে শাহীন।
মিনিট দশেক আপন মনে স্টেশনের লাইনেই কাটাল। তারপর হঠাৎ বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। পড়িমরি করে ছুটে হাঁপাতে হাঁপাতে আসে বাড়িতে। মিসেস হক অবাক হন। কেমন অস্বাভাবিক লাগছে শাহীনকে।
: বাথরুমের নাম করে বাইরে গিয়েছিলি কেন? মনু ডেকেছিল?
: না মা, আমার খুব খারাপ লাগছে
: কেন কি হয়েছে তোর?
: আজ স্টেশনে ঐ বুড়োকে আমি দেখেছি।
: কোন বুড়োকে?
: ঐ যে, আমাদের পাড়ায় আচার বেচত।
: সে তো ক’দিন হলো মারা গেছে।
অজানা আশঙ্কায় মিসেস হকের মন অস্থির হয়ে ওঠে। মৃত ব্যক্তিকে হঠাৎ করে দেখা ভয়ের নয় কি?
: মা, বুড়ো চাচা মিয়া আমার জন্যই মারা গেছে।
: কি আবোলতাবোল বকছিস?
: মনু ছিল আমার সঙ্গে।
: সেতো জানি। এর জন্য তোকেতো তোর বাবা কত মেরেছে।
: ওতে আমার শাস্তি হয়নি আম্মা।
ক’দিন আগের কথা। বৃদ্ধ আচারওয়ালার সঙ্গে শাহীন আর মনু দুষ্টুমি করে। বাকিতে আচার খায়। শেষে এটা ধরে ওটা ধরে টানাটানি করে। বিরক্ত হয়ে আচারওয়ালা চলে যায়। কিন্তু দুষ্টুমি তখনো ওদের ছাড়েনি। পিছু নিয়ে পেছন থেকেই আচারওয়ালার পয়সার বাটি তুলে নেয় ওরা। একটুও টের পায়নি বুড়ো। পরে অবশ্য বুড়ো কেঁদেকেটে অস্থির। শাহীন বলেছিল-ফিরিয়ে দে, বুড়ো অভিশাপ দেবে। মনু শোনেনি। মিঠু এসবের নীরব সাক্ষী। কিন্তু পাড়ার ছেলেরা ছাড়েনি। নালিশ করেছে ওদের বাবার কাছে। প্রচ- মার খেয়েছে শাহীন। মনুর কিছুই হয়নি। তহবিল হারানোর শোকে বুড়ো দু’দিন আচার বেচতে বেরোয়নি। তিন দিনের মাথায় হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়। তারপর গত পরশু হারিয়ে গেলেন পৃথিবী থেকে। আজ সেই মৃত বুড়োর মত একজনকে ট্রেনে করে যেতে দেখল শাহীন। ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছিল। বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে শাহীনের। চোখেরই ভুল। মানুষের মত মানুষতো দেখতে কতই আছে। কিন্তু মনকে সে যতই বোঝাতে চেষ্টা করে ততই সে এলোমেলো হয়ে যায়। শেষে অস্থির হয়ে ছুটে আসে বাড়িতে।
মাথায় তেল-পানি মালিশ করতে করতে মা বললেন- কোরআন শরীফ পড়ছিলি। বাথরুমের নাম করে বাইরে গেলি কেন? কি হয় তোর মাঝে মাঝে বলতো।
শাহীন নিজেই জানে না-কি হয় তার মাঝে মাঝে। ইদানীং তার কেবল হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কারো সঙ্গ ভালো লাগে না। কোন কষ্ট ভালো লাগে না।
: আচ্ছা মা, আব্বা আমার সঙ্গে কথা বলে না কেন? আমি কি দোষ করেছি।
: তোর আব্বাতো তোকে নিয়েই চিন্তা করে। স্কুলে যাবার পথে অফিসে গিয়ে দেখা করে আসিস।

গলির মোড়ে মুদি দোকানের টুলে বসে মনু কি যেন খাচ্ছিল। শাহীনের অপেক্ষায় ছিল। অনেকক্ষণ পর শাহীনকে দেখা গেল বই ছাড়া।
: কিরে এত দেরি করলি, বই কোথায়?
: ক্লাস করবো নারে। ছুটি নেব।
: কি হয়েছে তোর? জিন পরীতে পেয়েছে নাকি?
: মন ভালো নেই রে…
: চল, সিনেমা দেখে আসি
: মনু, চল আমরা আজ থেকে ভালো হয়ে যাই।
মনু নিরুত্তর। কিছুক্ষণ দু’জন চুপচাপ পথ চলে। নীরবতা ভেঙে মনু বলে-জানিস, কাল রাতে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কত কেঁদেছে। আমি নাকি খুব জ্বালাই। কিন্তু আমি কী করব বল।
: আমি মাকে বলেছি-ভালো হয়ে যাব।
: জানিস, আব্বা নাকি বাসা পাল্টাবে আমার জন্যই।
: তুই ভাবিস না, আমি তোর সঙ্গে দেখা করব। মন দিয়ে লেখাপড়া করিস। কচিকাঁচায় আসিস। তুইতো গিটার খুব ভালবাসিস। ওখানে গিটারওতো শিখতে পারিস।
মনু বলল-‘আচ্ছা’।
টিকাটুলী মোড়ে এসে শাহীন মত পাল্টায়। মনুকে বলে-তুই স্কুলে যা। আমি আব্বার সঙ্গে দেখা করে বাসায় চলে যাবো। মনু বলে-বিকেলে দেখা হবে। কিন্তু সে দেখা আর হয় না। কারণ শাহীন মতিঝিলের লাল এগারোতলা ওয়াপদা ভবনের চার তলায় তার বাবার সঙ্গে দেখা করে।
ফাইলের আড়ালে মাথা নিচু করে কি সব লিখছিলেন হক সাহেব। বাবার সহকর্মী কাজী আংকেল বলল-আরে শাহীন যে। সঙ্গে সঙ্গে হক সাহেব মাথা তুললেন।
: কিরে স্কুলে যাসনি?
: আব্বা, আমার মন খুব খারাপ।
: কেনরে, মনের আবার কি হলো? পাগল ছেলে….
সত্যিই শাহীন খুব পাগল ছেলে। খুব রহস্যময় আচরণ করে মাঝে মাঝে। মা তাকে কতবার পীর ফকিরের কাছে নিয়ে গিয়ে ছিল। গোটা দুই তাবিজও ঝুলছে ওর গলায়। আজও মিসেস হক আশা করছেন বিকেলে ওকে নিয়ে যাবেন ধলপুরের নিম ফকিরের কাছে।

আশা ভঙ্গ হলো সবার। বাবার সঙ্গে দেখা করে শাহীন আর বাড়ি ফেরেনি। ফিরতে পারেনি। অফিসের ক্যান্টিন থেকে বাবা ওকে প্যাটিশ খাইয়ে, লিফ্টে নিচে নামিয়ে দিয়ে বলেন-সোজা বাসায় চলে যাও। কিন্তু সোজা চলে এলো কমলাপুর রেলস্টেশনে। কু-উ-উ ঝিক-ঝিক করে একটা ট্রেন তখন কোথায় যেন যাচ্ছিল। বিনা টিকিটের যাত্রী হলো শাহীন। হারিয়ে যাবার অজানা ঠিকানার উদ্দেশে ছুটে চলল ট্রেনটা শাহীনকে নিয়ে।

তখন আজান দুপুর। ক্লাস করে বাবুর সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল মিঠু-বিটু। পথে মনুর সঙ্গে দেখা।
: মিঠু, তোমার দাদাকে দেখেছ?
: কেন বাসায় নেই
: স্কুলের দিকে গিয়েও যায়নি। বলেছে আংকেলের অফিসে যাবে।
: সকালে রেলস্টেশনের দিকে চলে গিয়েছিল।
: চল, ওদিকেই খুঁজে আসি।
মিঠু, বিটু আর মনু ছুটল শাহীনের খোঁজে।

সারাবাড়িতে সবাই চুপচাপ। হক সাহেব এই মাত্র এলেন ব্যর্থ খোঁজাখুঁজি করে। কত হয়রানি যে শাহীন করে চলেছে তাদের। রাগে দুঃখে তার বুকটা ফেটে যেতে চায়। মিসেস হকেরও একই অবস্থা। তিনি ভাবছেন আরও একটা বিষয়। এ নিয়ে শাহীন কতবার হারাল। নিম ফকির বলেছিল ছেলেটার ওপর একটু জিনের প্রভাব আছে। একটু সাবধানে, চোখে চোখে রাখবেন। এবার হারালে পাওয়া কষ্ট হবে। এ কথা ভেবেই আঁচলে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকেন তিনি। বিটু মলিন মুখে মার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিঠু খাতায় আঁকি বুকি করতে থাকে।
বিকেলে বাবু এলো। খেলবি না? মিঠু ‘না’ বলে দেয়। তারপর বেলী আপার সঙ্গে এলো শেলী। শেলী দু’ভাইকে সান্ত¡না দেয়-
: মন খারাপ করো না। এবারও দেখ ঠিক ঠিক ফিরে আসবে।
বাবুর আম্মা, টিপুর আম্মা, শেলীর আম্মা-এক এক করে সবার আম্মাই আসেন। একেকজন একেক রকম কথা বলেন। কেউ বলে-ছেলেটাকে শাসন বেশি করা হয়, কেউ বলেন ‘কম’, কেউ বলেন এবার নিশ্চয় ছেলেধরার পাল্লায় পড়েছে। তারপর মাইকিং, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আর বেতারে নিখোঁজ সংবাদ দিতে বলেন। মিঠুর আম্মা চুপচাপ শোনেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

হক সাহেব খোঁজাখুঁজি শেষ করে রাত বারোটায় বাসায় ফেরেন। সে রাতে মিঠুদের ঘুম হয়নি। মাঝ রাতে মা কোরআন শরীফ পড়েন। বাবা এপাশ ওপাশ করেন। কতবার শাহীন হারিয়ে গেছে। কিন্তু কখনো বাড়ি ছাড়েনি। শুয়ে মিঠু সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে দাদার কথা। কোথায়, কোন দূরে একা একা হারিয়ে গেল দাদা, একটু বলেও গেল না। মিঠুর মনে পড়ে চা বাগানের ছবির কথা। ওই ছবির মত কোন ঠিকানায় হারিয়ে গেল নাতো দাদা?

কত কষ্টে রাত কেটে যায় ওদের। এত সুন্দর ভোরেও খুব উদাস উদাস লাগে। কি এক শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে ওদের হৃদয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিঠু। নাসিমা আপা দু’বোনকে নিয়ে ব্রাশ করতে করতে মর্নিং ওয়াকিং করছে। বসন্তের এ সময়টা হাঁটতে কি যে ভালো লাগে! শেলী মাথা ঝেঁকে কি যেন ইশারা করে। হয়ত জানতে চাচ্ছে-দাদা এসেছে কিনা। মিঠুও মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয়-আসেনি। শেলী হাত ইশারায় ডাকে। মিঠু মাথা নেড়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। বিটু বেরিয়ে যায় ব্রাশ নিয়ে। কিছুক্ষণ পর মনুকে দেখা গেল বাড়ির আশপাশে। মিঠুর বাবাকে মনু এড়িয়ে চলে। খুব ভয় লাগে। কি-না ‘কি’ জিজ্ঞেসা করে ফেলে।
খুব ভোরে মিসেস হক যাবেন নিম ফকিরের কাছে। অশীতিপর এই বৃদ্ধ ফকির আয়না পড়া জানেন। আয়নাতে নাকি দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া ছেলের আবছা কায়া। সেই কায়া সুখে আছে না দুঃখে আছে-তা বলে দেবে ফকির। তাই জানতে যাবেন মিঠুর আম্মা। মিঠুকে নিয়ে বের হন তিনি। সূর্য ওঠার আগেই ধরতে হবে নিম ফকিরকে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আসলাম সাহেব এলেন মিঠুদের বাসায়। শাহীনের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করলেন। পরামর্শ দিলেন কি করতে হবে। আর নিজের ছেলের দস্যিপনার জন্য বিব্রতবোধ করলেন। জানালেন-ওকে আমি হোস্টেলে অথবা রাজশাহীতে ওর খালার কাছে পাঠিয়ে দেবো।
ব্রাশ করতে করতে শেলীরা চলে আসে বড় রাস্তার মোড়ে। কি নীরব রাস্তা! নাসিমা’পা ব্যাক-টার্ন নিলেন। শেলী আর বিটু বক্ বক্ করছে।
: জানো, আব্বা না কোয়ার্টার পেয়েছে
: সেটা আবার কী?
: কোয়ার্টার মানে সরকারি বাসা।
: কোথায়?
: অনেক দূর। রায়ের বাজার।
: আমরা খুব একা হয়ে যাব, শেলী আপা।
: তোমার ভাইয়াকে নিয়ে বেড়াতে আসবে।

সরলমনা বিটুর মনটা ভেঙে যায়। দূর! সবাই শুধু চলে যায় আর হারিয়ে যায়। এই সেদিন, গ্রাম থেকে নানা-নানী এলো। দু’দিন না যেতেই বললেন-যেতে হবে। শেষে চলেই গেলেন। কেউ চলে গেলে বিটুর খুব কান্না পায়। কাঁদেও খুব। বুকের মধ্যে হাহাকার করে। কণ্ঠনালীতে ব্যথা অনুভূত হয়।
নিম ফকির মিঠুর মাকে জানালো যে, এখান থেকে শত শত মাইল দূরে আছে ছেলেটা। একজন দরবেশ মত লোক ওকে আশ্রয় দিয়েছে। শুনে কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করলেন মিসেস হক।

 

সময় গড়িয়ে যায়। জীবনতো থেমে থাকে না। তাই মিঠুরা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবু মিঠুর আম্মা মাঝে মাঝেই শাহীনের কথা বলেন আর কাঁদেন। টানাটানির সংসারে ছেলের পেছনে নগদও গেছে কিছু। এ টাকায় বেতারে আর কাগজে নিখোঁজ সংবাদ দিতে হয়। কিন্তু মাস পেরুলেও কোনো হদিস মেলেনি শাহীনের। শুধু মনের সান্ত¡Íনা নেয়ার জন্য মিঠুর আম্মা মাঝে মাঝে যান নিম ফকিরের কাছে। তাতেও দু’পয়সা খরচ করতে হয়।
মিঠু আর বিটু মাঠে খুব কম বেরোয়। একদিন বাবু, নাসির আর টিপু বলল- এভাবে ঘরের মধ্যে বসে থাকলে ভূত হয়ে যাবি। সেই থেকে দু’ভাই মাঠে নামে। অবশ্য ছোট্ট বিটু বাবুর সঙ্গে তর্কই বাধিয়ে দেয়।
: খেলি না মানে, কি বলছ তুমি বাবু ভাই, খেলিতো।
: কি খেলো?
: লুডু, কেরাম, দাবা।
: ও, ওই শেলীদের বাসায়? আরে ওগুলোতো মেয়ে মানুষের খেলা।
: খেলাতো খেলাই। ছেলেমেয়ে আবার কি!
: না তোমরা ওই হিংসুটে মেয়েটার সঙ্গে খেললে আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো না। খেলবোও না।

শেলীর কথা বাবু একদম শুনতে পারে না। শেলী নাকি একদিন ওকে ঢাকাইয়া কুট্টি বলেছে। আর একদিন বলেছিল ‘পিচ্চি বাবু’। পিচ্চি বাবু আবার কী! বাবু কি এখানে দুটো আছে নাকি? না হয় সে একটু ছোট খাটই দেখতে। তাই বলে পিচ্চি বাবু নাম দিতে হবে নাকি। আর ‘ঢাকাইয়া কুট্টি’ কেন বলল?
বাবুরা মূলত পুরনো ঢাকার বাসিন্দা। ওর বাবা খাস ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলে। কিন্তু বাবুরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। বাবুর আম্মার দেশ খুলনা। লেখাপড়া জানেন। শুদ্ধ কথা বলেন। ঐভাবে গড়ে তুলেছেন বাবুদের। মিঠুদের সঙ্গে দারুণ দহরম মহরম। আর শেলীদের সঙ্গে তেমন নয়। মনুর আচার আচরণের জন্যই বোধ হয় এই দূরত্বটা হয়ে যায়। তাছাড়া কবুতর পোষা নিয়ে একদিন শেলীর সঙ্গে বাবুর ঝগড়া লাগে।
বাবুর একজোড়া কবুতর তাড়িয়ে এনেছিল মনুর কবুতর। নিয়ম হচ্ছে কোন কবুতর জোট বেঁধে চলে এলে সে কবুতর তার হয়ে যায়। এমনভাবে মনুর একজোড়া কবুতর বাবু দখল করে নেয়। এমনকি শাহীনেরও একটা গিরিবাজ নিয়ে যায়। তখন কেউ তাকে বাধা দেয়নি। আর নিজের কবুতর যখন জোট বেঁধে চলে আসে তখন সে হন্যে হয়ে দৌড়ে কবুতর নিতে আসে। মনুভাই না থাকায় জোর করে নিজের কবুতর ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার জন্য শেলী বাবুকে ‘চোর’ বলেছিল। সে থেকেই বাবু শেলীর ওপর রেগে আছে। বিটু আর বাবু যখন শেলীদের নিয়ে বিতর্ক করছে তখন এগিয়ে আসে মিঠু। খুব বিষণœ সুরে বলল-জানিস বাবু, শেলীরা না চলে যাচ্ছে।
: কোথায় যাচ্ছে।
: ওর আব্বা বদলি হয়েছেন।
: সত্যি বলছিস?
: ঐ দেখ না।
পেছনের দিকে তাকায় বাবু। একটা পাঁচ-টনি ট্রাক মাঠের এক প্রান্তে। মালপত্র ঠেসে ভরছে ওতে। মনুভাই আর তার আব্বা তদারকি করছে। গেটের সামনে লাল ঘাগরা আর ছাপা ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে শেলী। কিযে ফুটফুটে সুন্দর লাগছে ওকে! মিঠুরা এগিয়ে যেতেই মিষ্টি হাসল। বলল-বাবু ভাই, চলে যাচ্ছি, আপনাকে অনেক খারাপ বলেছি। মাফ করে দেবেন। বলেন; দেবেন না?
বাবু হকচকিয়ে যায়। এত সুন্দরভাবে কোনদিন কথা বলেনি শেলী। সব সময় তুই-মুই, পিচ্চি আর চোর বলে কথা বলেছে। কি একটা অনুভূতিতে বাবুর খুব কান্না পায়। সামলে নিয়ে বলে-শেলী আমি তোমাদের কবুতর দিয়ে দেবো। ওটা ডিম পেড়েছে। ক’দিন পর বাচ্চা ফুটবে। বাচ্চাসহ দিয়ে আসব। শেলী হাসল।
ট্রাক থেকে মনু চেঁচিয়ে ওঠে-“তাই নাকি বাবু? ওদের যত করো কিন্তু। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব।” শেলী বলল- তোমরা কিন্তু অবশ্যই রায়ের বাজারে আসবে।” মিঠুরা ‘আচ্ছা’ বলল।
দুপুর নাগাদ ট্রাক ছেড়ে গেল। বত্রিশ নম্বর মানিক নগরের বাসা খালি হয়ে গেল। উদাস হয়ে গেলে সবার মন। সব চাইতে খারাপ লাগল মিঠুদের। বিটু-মিঠু একা হয়ে গেল। আবার কিছু দিনের জন্য একটা শূন্যতা ওদের গ্রাস করল।
ঘুরে ফিরে আসে শাহীনের কথা। দেখতে দেখতে মাস কেটে যায়। এরপর ঋতু। বছরটাও ছুঁবে হয়ত। সময়ের ফাঁকে ফাঁকে শাহীনের কবুতরগুলোও উড়ে যায়। ওরা হারিয়ে যায়। দূর নীলিমায়। যেমন করে ছেলেটা হারিয়ে যায়।

 

 

 

Share.

মন্তব্য করুন