চিকার দেহ থেকে মারাত্মক দুর্গন্ধ বের হয় তা সবাই জানে। এ জন্য চিকাকে এড়িয়ে চলে সবাই। ময়লার স্তূপে ঘুরে ঘুরে তার শরীর বিশ্রী হয়ে যায়। দিনের বেলা মোটেই চলতে পারে না। রোদ লেগে চোখ ঝাপসা হয়। তাই দিনের আলো ফুটলে তারা আবর্জনার ভেতর লুকিয়ে থাকে।

একটা চিকা প্রতিজ্ঞা করলো। এ হীনতা যেমন করে হোক দূর করবে। তাকে ওপরে উঠতেই হবে। এ অবস্থা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। পৃথিবী কতো বদলে গেছে। সবাই শিক্ষার জোরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সে কিনা পচা নর্দমার ময়লায় কাটাচ্ছে। কী করে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যায়। এই নিয়ে সব সময় চিন্তা করে সে। তার সাথে কেউ মিশতে চায় না। গায়ের চিমসে গন্ধটা কেউ সহ্য করতে পারে না। কারও সাথে মিশতে গেলেই তড়িঘড়ি কেটে পড়ে। এমনকি স্বগোত্রীয় ইঁদুরও তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না। কাক তাদের মাংস ভক্ষণ করে না। সেটা ওই কটু গন্ধের কারণে। সে শুনেছে কাক অত্যন্ত বুদ্ধিমান। কাকের কাছে বুদ্ধি নেয়ার কথা সে ভাবলো।

একদিন সকালে সে গেলো কাকের কাছে। কাককে সে মনের কথা বললো। ইঁদুর হলে কাক তাকে গিলে খেতে এক মুহূর্ত দেরি করতো না। কিন্তু চিকার উপস্থিতি টের পেয়ে সে কাজে সময় ক্ষেপণ করতে লাগলো। কাকের সাক্ষাৎ লাভের জন্য চিকা তাগাদা দিতে লাগলো।
‘কাক দাদা। বাইরে আসুন না। বহুদূর থেকে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘দাঁড়িয়ে থাকো। কাজ পড়ে আছে। দেরি হবে।’
‘দাঁড়িয়ে তো আছি দাদা। আর কতক্ষণ। পায়ে ব্যথা ধরে গেলো।’
‘তাড়া দিলে তো হবে না। সমস্যা হলে আর একদিন এসো।’
‘এটা একটা কথা বললেন দাদা। এতো আশা করে এলাম। আপনি বলছেন আর একদিন এসো।’
‘এমনি কি বলছি। কাজের সময় ভ্যানভ্যান করলে একটুও ভালো লাগে না।’
‘দাদা। আপনার জন্য মুরগির কলজে এনেছি। ছনবাবরির পুঁটলি এনেছি। দেরি হলে নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘দাও তো দেখি। কোথায় ছনবাবরি আর মুরগির কলজে।’

প্যাকেট থেকে কলজে আর ছনবাবরি বের করে চিকা কাকের সামনে রাখলো। খাবার পেয়ে মজা করে খেতে লাগলো কাক। সে চিন্তা করলো চিকাকে দিয়ে সে লাভবান হতে পারবে। সে তো অনেক দিন থেকে মোড়লগিরি করছে। কোনদিন চিকা তার কাছে আসেনি। চিকার কিসের সমস্যা? সারারাত ময়লা ঘাঁটে। দিনের বেলা লুকিয়ে কাটায়। তার আবার সমস্যা কিসের? যাই হোক। কষ্ট করে এসেছে কথা তো শুনতে হবে। ঢেঁকুর তুলে ভারিক্কি মেজাজে কাক বলে,
‘ভাই, বাড়িটা কোথায় যেন?’
‘বাড়ি আলুপট্টি চিকামোড়।’
‘তা কী দরকারে এসেছো?’
‘আমার একটা উপকার করতে হবে দাদা।’
‘কী উপকার?’
‘আমি সবার সাথে মিশতে চাই। কিন্তু গায়ের গন্ধের জন্য মিশতে পারি না।’
‘সেটা আমি কি করবো? ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাও।’
‘ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। বলে চিকিৎসায় কাজ হবে না।’
‘দামি সেন্ট কিনে মেখে দেখো। হলেও হতে পারে।’
‘আমাকে কে দেবে সেন্ট। আমি তো ওসব চিনি না।’
‘ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য চেষ্টা করে দেখবো। দুই হাজার টাকা নিয়ে কাল সকালে এসো।’

টাকা জোগাড় করতে চিকার সময় লেগে গেলো। এদিকে কাকও চলে গেলো দেশের বাইরে। টাকা এনে চিকা কাকের দেখা পেলো না। ওর বউ জানালো কাকের ফিরতে সময় লাগবে। অগত্যা তার হাতে টাকাটা দিয়ে দিলো চিকা। সে তাকে অনুরোধ করলো। যাতে ভালো সেন্ট জোগাড় করে দেয়। কাকের বউ কাককে খবর পাঠালো। ফেরার সময় কাক সেন্ট নিয়ে আসতে ভুল করলো না। সেই সেন্ট গায়ে মেখে চিকা গেলো ইঁদুরের আস্তানায়। ইঁদুর তাকে বরাবরই এড়িয়ে চলে। আজ সে ইঁদুরকে দেখিয়ে দেবে তার কদর কতটা বেড়েছে। বিদেশী সেন্টের গন্ধে তাক লাগিয়ে দিতে চায় সে। আস্তানার বাইরে থেকে সে ইঁদুরকে ডাকতে লাগলো।
‘ইঁদুর বন্ধু বাড়িতে আছো?’
ইঁদুর চিকার গলা চেনে। বন্ধু বলে ডাকায় রেগে গেলো ইঁদুর। সে তখন আড্ডা দিচ্ছিলো। তার বন্ধুরা দামি লোক। একটা আনাড়ি চিকা বন্ধু বলায় সে লজ্জিত হলো। সে রেগে কাঁপতে কাঁপতে আস্তানার বাইরে বের হলো।
‘তুমি কখন থেকে বন্ধু হলে মান্যবর? খুব দেখি সাহস হয়েছে। বলে দিচ্ছি কখনো এমন সাহস দেখাবে না।’
‘অতো দেমাগ করো না। কাছে এসো।’
‘ওখান থেকেই বলো। কিইবা বলার আছে তোমার?’
‘গন্ধটাকে নিন্দে করো তো। এখন ওসব নেই।’
‘তাতে কী হয়েছে? এখানে এসেছো ফুটানি ঝাড়তে?’
‘দামি সেন্ট গায়ে মেখেছি। একটু শুঁকে দেখো না। মনটা ভরে যাবে তোমার।’
‘বকলামি করতে হবে না। যেখান থেকে এসেছো ভালোয় ভালোয় সেখানে চলে যাও।’
ইঁদুর পাত্তা দিলো না চিকাকে। সে তাকে আস্তানায় ডাকলো না। দেহে তার কতো সুবাস হচ্ছে। একটু পরখ করলো না। বরং গজর গজর করতে লাগলো, ‘পড়ে থাকা খাবার খুটে খায়। তার আবার ফটোর ফটোর। চিমসে গন্ধে কাছে ঘেঁষা যায় না। সে এসেছে আমার সাথে দুস্তি করতে। এমন মার মারবো। বডিতে জান থাকবে না।’
ইঁদুরের কাছে পাত্তা না পেয়ে চিকা হতাশ হয়ে গেলো। সে ভাবলো, শুধু সেন্ট মেখে চলবে না। ভালো পোশাকও পরতে হবে। নতুন স্টাইলের জুতা, ল্যাটেস্ট মডেলের হাতঘড়ি এবং সাহেবি কোট না পরলে বড় লোকদের মজলিসে সে যাবে কী করে। আর এসব জিনিস সে পাবে কোথায়। এ বিষয়ে কাকই তাকে সাহায্য করতে পারে। নিশ্চয়ই কাক ভালো পরামর্শ দেবে। কাক বাড়িতে ছিলো না। অনেক হয়রান হয়ে চিকা কাকের সাথে দেখা করলো। কাক একটা মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলো। মিটিং সেরে মনোযোগ দিয়ে শুনলো কাক। চিকা বললো,
‘আমাকে ইঁদুর অপদস্থ করেছে।’
‘বিষয়টা কী?’
‘ওর সাথে দেখা করতে গেছি। আমার কথা শুনলো না।’
‘তুমি কিছু বলোনি?’
‘বলেছি। কতো করে বলেছি। সেন্ট মেখে এসেছি। গায়ের গন্ধ দূর হয়েছে আমার।’
‘এখন কী বলতে চাও। কী করতে বলো আমাকে?’
‘জ্যাকেট, জুতা আর ঘড়ি এনে দিন। যত খরচ লাগে আমি দেবো।’
‘পনেরো হাজার নিয়ে আসবে। বেশি লাগলেও গুনতে হবে তোমাকে।’

পনেরো হাজার টাকা নিয়ে এলো চিকা। সে টাকা দিয়ে জ্যাকেট জুতা হাতঘড়ি এনে দিলো। সে পোশাক পরে অবাক হয়ে গেলো সে। এতো সুন্দর লাগছে তাকে! কাকের কালো চশমা ছিলো। সেটা ওর চোখে লাগিয়ে দিলো। আর যায় কোথায়। জবরদস্ত সাহেব বনে গেলো সে। সেদিনই সে কালচারাল অনুষ্ঠানে যোগ দিলো। আয়োজকরা তাকে ভিআইপি আসনে বসতে দিলো। অনুষ্ঠান শেষে দুটো কথা বলার জন্য ডাক পড়লো তার। শিল্পরসিকের মতো খুঁটে খুঁটে ব্যতিক্রমী আলোকপাত করলো সে। সবাই তাজ্জব হলো তার বক্তব্যে। অনেক উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে ডাক পড়তে লাগলো তার। প্রধান অতিথির আসনও অলঙ্কৃত করতে লাগলো সে। অল্প সময়ের মধ্যে সে কালচারাল ব্যক্তিত্বে পরিণত হলো।

চিকার কর্মকান্ডে খুশি হতে পারছিলো না ইঁদুর। তার ভ-ামি সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে লাগলো সে। তার প্রোপাগান্ডায় সায় দিতে অনেকেই রাজি ছিলো না। নিজ যোগ্যতায় কেউ ওপরে উঠতে পারে উঠুক। তাকে টেনে নামানোর দরকার কী। কিন্তু ইঁদুর এতটা সরব হলো যে কিছু লোক সচেতন হয়ে উঠলো। তারা সন্ধিহান দৃষ্টিতে চিকার ওপর নজর রাখতে লাগলো। মূর্খ চিকা চাপার জোরে সংস্কৃতি মহলে বিচরণ করবে। এটা মেনে নেয়া অনেকের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠলো।
কিছুদিন পরে দেশের বাইরে চলে গেলো কাক। সকলেই বলতে লাগলো কাক হয়তো দেশে ফিরবে না। কারণ সে বিদেশে অনেক সম্পদ করে ফেলেছে। সেখানে কাকের আরও বউ আছে বলে মনে হয়। এসব কথা শুনে চিকা ঘাবড়ে গেলো। তার জুতা জ্যাকেটের রঙ চটে যাচ্ছে। হাতঘড়িটা ঠিকমতো চলছে না। অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কাকের সাথে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো চিকা। সে বারবার কাকের বাড়িতে যেতে লাগলো। কখন আসবে কাক দেশে ফিরে। এই প্রশ্ন করে কাকের বউকে বিরক্ত করতে লাগলো। তার আচরণে বিরক্ত হয়ে কাকের বউ ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকা শুরু করলো।
এক রাতে ইঁদুর ক’জন সাথীকে নিয়ে চিকার বাসায় ঢুকে পড়লো। তারা তার জ্যাকেট আর জুতা টুকরো টুকরো করে ফেললো। তার হাতঘড়িটা গর্তের মধ্যে ফেলে দিলো। ঘুম থেকে জেগে চিকা দেখে তার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। জ্যাকেট জুতা না হলে সে বাইরে যাবে কী করে। মনের দুঃখে চিকা চিরদিনের জন্য বনের ভেতর চলে গেলো।

Share.

মন্তব্য করুন