আমার দেশ বাংলাদেশ। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্য ওঠা স্বপ্নের দেশ বাংলাদেশ। সুন্দর পরিপাটি রূপের দেশ বাংলাদেশ। হাছন, করিম, লালন কিংবা তিতুমীর আর শরিয়তুল্লার দেশ বাংলাদেশ। এখানে হাজারো নদী খাল-বিল হাওর-বাঁওড় ছড়িয়ে আছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে। চোখধাঁধানো ফসলি জমি। সবুজ গালিচা বিছানো ধানক্ষেত। যাতে রুমঝুম নূপুরের ধ্বনিতে ঝঙ্কার তুলে হিমেল বাতাস। দোল খাওয়া ধানের গা ছুঁয়ে অভিবাদন জানায় দূরের নীল আকাশ।
দেশের শ্যামল মাঠের পাশাপাশি বহে ছোট্ট খাল, অদূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আকাশছোঁয়া পাহাড়, পাহাড়ের বুক থেকে নাচতে নাচতে ছুটে চলে স্ফটিক পানির ঝর্ণাধারা। বিরামহীন এ ঝর্ণাধারা ছুটে চঞ্চল নদীকে লক্ষ্য করে। নদীর বুকে পাল তোলা নাও। নায়ের গলইয়ে বসা মাঝির দরাজ কণ্ঠে ভাটিয়ালি ‘সবর্নাশা পদ্মা নদী তোর কাছে সুধাই…’ কিংবা কোন এক রাখাল ছেলের জাদুর বাঁশির পাগলকরা সুর। গাঁয়ের বধূর তৈরি করা ভুবনখ্যাত নকশি করা কাঁথা। অথবা কাদা-মাটি দিয়ে মুড়ানো দুষ্টদলের মাছ ধরার কৌশল। আছে গাছে গাছে নাম না জানা হরেক রকম পাখির ওড়াউড়ি আর কিচিরমিচির গান। শুধু কি তাই? না, বন্ধুরা! এখানে নিত্য বসে রাতের আঁধারে বাঁশবনের তলে জোনাকি পোকার হাটবাজার, শুনা যায় অমাবস্যার দুপুর রাতে হুতুম প্যাঁচার বিশ্র ডাক। শেয়ালের হুক্কা-হুয়া। আছে পূণির্মা রাতে রুপালি চাঁদের ঝলমল জ্যোসনার প্লাবন। দিঘির পানিতে সদ্য ফোটা শাপলা আর কলমি ফুলের সমাহার। চাঁদের আলোয় ঝিলিক মারে দিঘির পানি। চিকচিক পানিতে ঢেউয়ের মৃদু ছন্দ। শাপলা পাতার ফাঁকে কয়েকটা ব্যাঙের ঘ্যাং.. ঘ্যাং চিৎকার।
নীরব নিস্তব্ধ প্রকৃতি তার খামখেয়ালি ভাব ছেড়ে কি জানি কিসের অপেক্ষায় প্রহর গুনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মনে হয় কার যেন বাণী শ্রবণ করছে একমন চিত্তে। এ সব-ই যেন কোন এক শিল্পীর তুলিতে আঁকা প্রকৃতির জীবন্ত রূপ। মনলোভা এসব দৃশ্য যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীকে ভাবিয়ে তুলবে সন্দেহ নেই। বন্ধুরা, ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে নিজ নিজ রূপ আর শোভা সম্ভার নিয়ে আবির্ভূত হয় এক একটি ঋতু। মনের গভীরে জাগে নতুন নতুন কল্পনার চর। চোখে ভাসে আবহমান বাংলার চিরচারিত রূপ। যেখানে প্রকৃতি হেসেখেলে চলে তার আপন লাবণ্য বিলিয়ে। বলতে বাধ্য হই, এমন দেশে জন্ম নিয়ে আমি সার্থক।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ তার রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিদায় নেয়ার পরপরই স্নিগ্ধ হেসে হাজির হয় সোনার শিষ ঝুম ঝুম ঋতু। কত জনে কত নামে ডাকে তাকে, কেউ বলে কৃষক মজুরের হাসিমাখা ঋতু, কেউ বলে অরুণ বরুণ কিরণ মতির কাল, কেউ ডাকে হিমঋতু আবার কেউ বলে সোনায় সোনায় হাস্যোজ্জ্বল ঋতু। বন্ধুরা, জানতে খুব ইচ্ছে করছে বুঝি, ঋতুটির নাম কী? হ্যাঁ বলছি, ঋতুটির নাম ‘হেমন্ত’। ষড়ঋতুর এই উল্লেখযোগ্য ঋতু হেমন্তকে নিয়েই তোমাদের সাথে আজকে আমার এক জমজমাট আড্ডা হয়ে যাক। কী বলো? এ আড্ডায় হেমন্তের রূপ ও বৈচিত্র্য নিয়ে জানা যাবে অনেক কথা।

হেমন্তের রূপ ও বৈচিত্র্য
শরতের কাঁচা হলুদের মতো সোনালি রোদ আকাশ ভেদ করে যখন ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তে তখন থেকেই যেন মনে হয় আমাদের ষড়ঋতুর দেশে হেমন্ত আগমন করছে অত্যন্ত ধীরলয়ে। বাংলাদেশের প্রকৃতি তখন হেমন্তের আগমন ধ্বনি জানান দেয় সগৌববে। বর্ষায় ভাসা রাস্তা-ঘাট মাথা উঁচু করে উঁকি মারে। কনকনে হিমেল বাতাস মৃদু ছন্দে দোল খায় গাছের শাখে। ঝর ঝর ঝরে মরা পাতা। গাছে গাছে হালকা বাতাসের ঢেউ। শরীরে শির শির শীতের অনুভূতি অনুভব হয়।
অর্থাৎ হেমন্তে সত্যিকারের রূপের যে চিত্র আমাদের চোখের সামনে হাজিরা দেয় তা হলো হিম হিম ঠা-া বাতাস, গাঢ় নীল আকাশ, নদীকূলে সদ্য ফোটা থোকা থোকা কাশ, হালকা মেজাজের মিষ্টি রোদ, দল বেঁধে সাদা বকের ওড়াউড়ি, শিউলিবনের তলে সদ্য ঝরা ফুল আর পাকিল ধানের মৌ মৌ গন্ধ। এক চমৎকার ঋতু এই হেমন্ত। হেমন্তের আগমনে গ্রামীণ পল্লীজীবনে কৃষাণ-কৃষাণীর মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। নতুন স্বপ্নে বিভোর এ শ্রেণীর মানুষ অনাগত দিনগুলোর সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আশা বুকে ধারণ করে আগামী জীবন সুখময় করতে শত কষ্ট মানিয়ে নেয় হাসি মুখে।
এ সময় আকাশ ভেঙে ঝরে না অঝোর ধারায় বৃষ্টি কিংবা গ্রীষ্মের মতো গরমের কোনো তাপও এ সময় অনুভব করা যায় না। পথঘাটও থাকে শুকনো ঝরঝরে।
হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু, যা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দুই মাস নিয়ে গঠিত। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। মোগল সম্রাট আকবর বাংলা পঞ্জিকা তৈরির সময় ‘অগ্রহায়ণ’ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ‘অগ্র’ অর্থ ‘ধান’ আর ‘হায়ণ’ অর্থ কাটার মৌসুম অর্থাৎ এ দুই অংশের অর্থ যথাক্রমে ধান ও কাটার মৌসুম।
কার্তিকে জমিনের ধান পূর্ণতা পায় এবং ধান কেটে ঘরে তোলার পরিপক্বতা লাভ করে, সেই পরিপক্ব ধান কাটতে কৃষকরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন অগ্রহায়ণ মাসে। আর এ মাসেই শুরু হয় গ্রামের ঐতিহ্যবাহী উৎসব নবান্ন। অর্থাৎ হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন মানেই মাঠে মাঠে ভিন্ন রকম পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। কৃষক আর কৃষাণীর মুখে খই ফোটা হাসির ঝলক। মাঠে মাঠে গ্রাম্য বালক-বালিকার অবাদ বিচরণ দৌড়ঝাঁপ, নন্দাই, কানামাছি, গোল্লাছুট আর কত কি খেলা! আয়োজন করা হয় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পালা গান, বাউল গান, নাগরদোলা, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা, লাঠি খেলা, হা-ডু-ডু ইত্যাদি। গ্রামের মাঠে বসে জমজমাট বিরাট গ্রাম্যমেলা। যেখানে বিক্রি হয় হরেক রকম খেলনা, বাঁশের বাঁশি, নানা রকম পুতুলসহ রকমারি খই, মুড়ি, চিঁড়া ইত্যাদি।
গৃহস্থবাড়িতে গৃহিণীর কর্মব্যস্ত দিন। পিঠা, পুলি, পায়েস তৈরিতে ব্যস্ত। কখন যে সূর্যটা ইতি টেনে নীল নীলিমা ভেদ করে পশ্চিম আকাশে ডুব দেয় তা কি বলা যায়? গৃহিণীর হাতে তৈরি করা নতুন ধানের পিঠা-পায়েসের মিষ্টি গন্ধে জিবে পানি আসে মনের অজান্তে। হেমন্তের এ শাশ্বত রূপ অনাধিকাল থেকে মিশে আছে আমাদের রক্তের সাথে। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এমন সৃজনশীল উৎসব উপহার দেয়ার জন্য হেমন্তকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। তাই তো বাঙালির হৃদয় জুড়ে হেমন্ত এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। কবি- সাহিত্যিকদের ভাবের খোরাকে টোকা দিতে পেরেছে এই হেমন্ত। মনের মাধুরী দিয়ে হেমন্তকে তুলে ধরেছেন প্রায় সকল কবি, ছড়াকার আর সাহিত্যিক।

আধুনিক কবি মোশাররফ হোসেন খানের কবিতায় হেমন্তের বৈশিষ্ট্যরূপ খুবই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ঠিক এভাবে। তিনি লিখেছেন-
“ভোর সকালে হিম হিম
সারা বাংলা জুড়ে,
হেমন্তের হাওয়া বেয়ে
হিমটা এলো উড়ে।

হিমটা এলো উড়ে-
কুয়াশার ছাতা মেলে
হিমালয় ঘুরে।

হেমন্ত প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে আমাদের পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতার ছন্দে। মাঠে মাঠে পড়ে থাকা হলুদ পাকা ধানের ছড়াছড়ি। উত্তুরে বায়ুর সাথে ধাক্কা লেগে ধানে ধানে যে বাজনা বাজে তার নির্মল চিত্র দেখতে ও শুনতে কত যে মজা, তা স্বচক্ষে না দেখলে কারো বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। কবি সে দৃশ্য দেখেছেন খুব কাছ থেকে। মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে। তাই তিনি লিখতে পেরেছেন-
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমিলতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রানাথ ঠাকুর অবশ্য হেমন্তকালকে একটু ভিন্ন চোখে দেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি হেমন্তকালকে বরণ করেছেন একান্ত নিজের মতো করে তিনি তাঁর গানে গাইলেন, হিমের রাতে এই গগনে দ্বীপগুলোর হেমন্তিকা করল গোপন, আঁচল ঘিরে ঘিরে, ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো জ্বালো জ্বালো আপন আলো সাজাও আলো ধরিত্রীরে।
অবিশ্বাস্য হেমন্তের রূপ। যতই দেখি ততই ভালো লাগে। এমন ভালো লাগার দৃশ্য বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। এখানে ভোর হয় সাদা কুয়াশা মুড়ানো হিমেল ঠা-া বাতাসের ওপর ভর করে। ঘাসের ডগায় শিশিরের কণাগুলো ঝিলিক মারে সূর্যের আভায়। সকালের রোদে শীতলপাটি পেতে ছোট্ট সোনাদের বর্ণমালার পাঠ অথবা শিশিরভেজা ধান ক্ষেতের মেঠোপথ ধরে কিশোরের দল গরুরপাল নিয়ে বের হয়। খাল-বিল, নদী-নালা আর হাওর বাঁওড়ে দেখা যায় লাল-সাদা পদ্ম ফুলের মেলা। তখন উল্লেখযোগ্য হারে পানি নেমে যায় নদী, নালা, খাল বিল থেকে। আটকে পড়ে শত প্রজাতির মাছ। অসহায় মাছ তখন ধরা পড়ে জেলেদের জালে। শান্ত নদীতে এপার ওপার হয় ডিঙি।
দূর থেকে দূরান্তরে ভাসে পাল তোলা পানসী আর ঘুমটি নাও। হেমন্তের শেষ দিকে সুদূর সাইবেরিয়াসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে দল বেঁধে ছুটে আসে নাম না জানা হাজার হাজার অতিথি পাখি। শীত বা তুষারপ্রবণ অঞ্চল থেকে এসব পাখি ছুটে আসে আমাদের দেশের হাওর-বাঁওড় আর বিলে-ঝিলে।
অতিথি পাখির বিচরণ সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে দেশের হাওরাঞ্চলে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত হাকালুকি হাওর, কাউয়াদিঘির হাওর, কাইনজার হাওর সর্বোপরি পাখির অভয়াশ্রম বাইক্কাবিলে। শীতের আগমনীর শুরুতেই বাইক্কাবিলে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় ও অতিথি পাখি আসতে শুরু করে। শীত যত ঘনিয়ে আসে ততই ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি এ বিলে আশ্রয় নেয়। শীতে এই বিলে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসা অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ আর কলকাকলি নজর কাড়বে পাখিপ্রেমীদের। এদের মধ্যে গেওয়ালা বাটান, মেটমোথা টিটি আর কালাপাখ ঠেঙ্গির দেখা মিলবে অহরহই। এদের বাইরে বাইক্কাবিলের স্থায়ী বাসিন্দা ধলাবালি হাঁস, শঙ্খচিল, ভুবনচিল আপনাকে আনন্দ দেবে সন্দেহ নেই। আবার আঞ্চলিক অতিথি পাখিরাও আপনাকে অভিবাদন জানাবে কণ্ঠের নানা কারুকাজে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাতি সরালি, রাজ সরালিসহ অসংখ্য পাখি। বিদেশি পাখিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাইবেরিয়া থেকে আসা মরচেরং, ভূতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস এবং ল্যাঞ্জা হাঁস ইত্যাদি। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর বিশ্বপরিচিত এক নাম। হেমন্তের শেষ বেলায় প্রকৃতির সব উপসর্গ ধরা পড়ে এ হাওরে। এই হাওরে রয়েছে সবুজ গাছগাছালি, মাছ আর নানা প্রজাতির পাখি। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক স¤পদে ভরপুর ১০ হাজার হেক্টর আয়তনের টাঙ্গুয়ার হাওর হেমন্তের শেষ বেলায় লাখ লাখ অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে। হেমন্তে হাওরে বেড়াতে এসে খুব ভোরে কুয়াশা দেখবেন। এখানের অতিথিবৎসল মানুষের আন্তরিক ব্যবহার আপনাকে মুগ্ধ করবে।

শেষ কথা
হেমন্তকালের প্রকৃতি আপাদমস্তক ভদ্র ও শালীন। শান্ত-শীতল হেমন্তের নেই কোন উত্তাপ উচ্ছৃঙ্খল আচরণ। এ সময় বর্ষা কিংবা ভাদ্র মাসের মতো অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে না। ঝলমল থাকে চারদিক। পথঘাট প্রান্তর থাকে ঝরঝরে শুকনো। আবার গ্রীষ্মের মতো গরমের কোনো তাপ এ সময় অনুভব হয় না। এক মিষ্টি আবহাওয়া বিরাজ করে সব সময়। এ সময়ে মাঠে মাঠে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-বন বাদাড়। মায়ের হাতে লাগানু আঙিনা বা উঠোনের মাচানে লাউ কুমড়াগুলো ঝুলে থাকে। বাড়ির সামনের শস্যক্ষেতে লাল শাক ধনে শাক আলুসহ ভিন্ন ধরনের ফসলের সমাহার।
মিষ্টি রোদের মায়াময় দিনের বিকেলে নানা রঙের প্রজাপ্রতি ও ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি। এসবই যেন হেমন্তকে এক উঁচু মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। যদিও ঋতুরাজ বসন্তের আহামরি ফুলের গন্ধ নেই হেমন্তে নেই পাখির তেমন কলকাকলি আর কিচিরমিচির গান, অথবা গ্রীষ্মের প্রখর খরতাপ, কালবৈশাখী ঝড়, কিংবা বর্ষার তীর ভাঙা ঢেউ অথবা কূলে কূলে ভরা নদী-নালা, অথবা দিনব্যাপী ঝমঝম বৃষ্টির মাতম। এসব উপেক্ষা করে হেমন্ত জানান দেয়, সে তার নিজের মতোন করে। নীরবে নিঃশব্দে হেমন্ত তার সকল রূপের ডালা মেলে ধরে মানুষের কাছে। নিকষ কালো মেঘে ভর করে অথবা ঠা-ঠা পরা বিজলি জ্বালিয়ে মানুষকে ভয় দেখিয়ে ‘আমি এসে গেছি’ বলে হেমন্ত চিৎকার করে না। এখানেই সে তার সর্বোচ্চ ভদ্রতা ও শালীনতার প্রকাশ ঘটায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। তাই তো সে অনন্য। যদিও হেমন্তে থাকে না পাখির গুঞ্জন, ভরা বাদল দিনের রিমঝিম শব্দ, উদাস কোকিলের কুহু কুহু গান। মন মাতানো ফুলের বাহার। তারপরও এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, শাপলা, পদ্ম, কামিনী, হিমঝুরিসহ নাম না-জানা হরেক রকম ফুল। যা দেখলে মন ভরে ওঠে সন্দেহ নেই। হেমন্তের এই বাহারি রূপ আর মাঠভরা ফসলের হাসিতে যেমন সবার মনের আশা মিটে তেমনি চোখে ভাসে বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন। তাই তো বলতে ইচ্ছে হয়-
‘হেমন্ত যেই আসলো ধরায়-
মিটলো মনের সব আশা
সোনা রোদে রাখাল হাসে-
হাসে বাউল, আর চাষা।’

Share.

মন্তব্য করুন