কী নির্মমতা!
কী নৃশংসতা!!
কী পাশবিকতা!!!
কোন শব্দ দিয়েই আরাকানে মিয়ানমারের গণহত্যাকে চিত্রায়িত করা সম্ভব নয়। দেশটির সেনাবাহিনী ও চরমপন্থীদের চালানো গণহত্যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী ও ছোট ছোট অবুঝ শিশুরা। রোহিঙ্গা শিশুদের নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যার অভিযোগও উঠেছে। স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করা হচ্ছে, প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত পুরুষকে ধরে নিয়ে গুম করে ফেলা হচ্ছে। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বসতভিটা। অমানবিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে ছুটে আসছে বাংলাদেশে। আসার পথেও নেই স্বস্তি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় নানা শঙ্কা আর আতঙ্ক নিয়ে। সীমান্ত এলাকায় পুঁতে রাখা হয়েছে স্থলমাইন, দেখলে গুলি করছে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীরা, শুধু তাই নয়, আকাশ পথে হেলিকপ্টার থেকে অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গুলি চালানো হচ্ছে। নদীপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গিয়ে অসহায় নারী আর শিশুদের সলিল সমাধি হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? কোথায় আজ মানবতা? কোথায় আজ বিশ্ববিবেক?
গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে শিশুদের : আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ চরমপন্থীদের চালানো গণহত্যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী ও ছোট ছোট অবুঝ শিশুরা। রোহিঙ্গা শিশুদের নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচে যাওয়াদের অনেকেই মিয়ানমারের সৈন্য ও বৌদ্ধ চরমপন্থীদের হাতে নির্যাতন ও নৃশংসতার লোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছেন।
পালিয়ে বেঁচে যাওয়াদের একজন আবদুল রহমান (৪১) জানান, তিনি চাত পাইযান গ্রামে বৌদ্ধ জঙ্গিদের ভয়াবহ হামলায় বেঁচে গেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তার পরিবারের সদস্যদের কেউ বাঁচতে পারেননি। একটি বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘরের ভেতর অন্যদের সঙ্গে তার ভাইকে আটকিয়ে রেখে ঘরটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। রহমান বলেন, আমরা আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ক্ষেতের মধ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পাই। তাদেরকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার দুই ভাতিজাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্য একজনের বয়স ছিল ছয় বছর এবং অন্যজন ছিল নয় বছর বয়সী। আমার বোন জামাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
একই গ্রামের সুলতান আহমেদ (২৭) বলেছিলেন, সেনাসদস্য ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের সশস্ত্র বৌদ্ধ জঙ্গিরা গলা কেটে হত্যাযজ্ঞ চালানোর সময় তিনি একটি ঘরের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন। সুলতান আহমেদ বলেন, আমরা আড়াল থেকে এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পর বাড়ির পেছন দিক দিয়ে দৌড়াতে থাকি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্তৃক প্রকাশিত স্যাটেলাইট ইমেজে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত চেন খার লি গ্রামের প্রায় ৭ শতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়।

স্বামীর খবর জানেন না তিনি: রামিদা বেগমের স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর তাদের বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার সপ্তাহখানেক পর পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ফলে স্বামীর খবর এখন জানেন না রামিদা। ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে যখন ছবিটি তোলা হয় তখন তার কন্যার বয়স ছিল ১০ দিন। তখনও মেয়ের কোনো নাম দেয়া হয়নি।

এই শিশুর বাবাকে হত্যা করা হয়েছে : স্বামীকে মিয়ানমারের সেনারা হত্যা করায় বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসে ১৮ বছরের নূর কায়েস। কোলে তার ২৬ দিনের সন্তান, যার এখনও কোনো নাম দেননি তিনি। ছবিটি ৯ ফেব্রুয়ারি তোলা।

সাত দিনের মেয়ে : ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে যখন ছবিটি তোলা হয় তখন আসমত আরার মেয়ের বয়স ছিল মাত্র সাত দিন। মাসখানেক আগে তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার আগে তার শ্বশুরকেও হত্যা করা হয়।

জামার ছবিই সান্ত¡না : মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আছে এই দলে। এত দিনের সবকিছু ফেলে প্রায় শূন্য হাতে অচেনা একটা দেশে অনিশ্চিত জীবন তাদের। পেছনে আগুন, গুলি, হত্যাকা-ের দুঃসহ স্মৃতি আর সামনে আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে সে শঙ্কা। বিবিসি মুখোমুখি হয়েছিল এমন তিনজনের।
তাদের একজন শিশু আয়েশা বিবি। সাজতে সে ভীষণ পছন্দ করে। মিয়ানমারে থাকতে সাজগোজ করার অনেক জিনিস ছিল তার। কিন্তু আই লাইনার, পাউডার আর চুড়ি ছাড়া সে আর কিছু নিয়ে আসতে পারেনি। কেন? প্রশ্ন করতেই সে বলল, ‘চার পাশে সবাইকে মেরে ফেলছিল। ভয়ে সবাই পালাচ্ছিল। তাই সঙ্গে করে তেমন কিছু আনার সময় পাইনি। এমনকি আমার পছন্দের হলুদ জামাটাও আনতে পারলাম না!’
রেহানা নামের এক গৃহবধূ জানালেন, ‘আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। আমার এক ভাই আগুনে পুড়ে মারা গেল চোখের সামনে। এরপর প্রাণভয়ে পালিয়েছি। সঙ্গে কিছু আনতে পারিনি। নিজের স্বর্ণের জিনিসগুলোও না। জানি না কিভাবে সামনের দিনগুলো কাটবে।’
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বৃদ্ধ নূর মোহাম্মদ বলছিলেন, তার হাঁটতে কষ্ট হয়। তারপরও প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছেন। কৃষিকাজ ছিল তার। বাড়ির গরু, ছাগলসব ফেলে এক কাপড়ে চলে আসতে হয়েছে। নগদ কিছু অর্থ ছিল, সেটাই এখন সম্বল। তবে অর্থের পরিমাণ এত কম যে এ দিয়ে বেশি দিন চলবে না। তারপর কী হবে, তিনি জানেন না।
আয়েশা, রেহানা ও নূর মোহাম্মদেরা সহিংসতার কারণে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। ফেলে এসেছেন চিরচেনা চারপাশ, সঙ্গে তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদ আর পছন্দের জিনিস।
ঝুঁকির মুখে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু : মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মুখে আছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ গত ১২ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।
ইউনিসেফ-বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা ইউনিটের প্রধান জঁ লিবির দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়, যেভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়েছে, তা অভাবনীয়। শুধু ৪ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর এই ছয় দিনে ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ এসেছে বাংলাদেশে। এ ঢল যে কমবে, এর কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। এটি একটি বড় মানবিক বিপর্যয় আর এর বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা।
প্রাথমিক তথ্য থেকে বলা যায়, মিয়ানমার থেকে যত রোহিঙ্গা এসেছে, এর মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। গত ২৫ আগস্ট থেকে অন্তত ৩ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
ইউনিসেফের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, যেসব শিশু এসেছে, তারা কয়েক দিন ধরে নির্ঘুম। তারা ক্ষুধার্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ও বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা দরকার। পালিয়ে আসা শিশুরা অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বলে ইউনিসেফ জানায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি মনে করে, এসব শিশুর সুরক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা দরকার।
জঁ লিবি বিবৃতিতে বলেন, যেসব শিশু মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আমার বড় শঙ্কা তাদের নিয়ে। এখন পর্যন্ত আমরা ১ হাজার ১২৮ শিশু পেয়েছি, যারা মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে এসেছে। আগামী দিনগুলোতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আমাদের ধারণা।
মানবিক বিপর্যয় : হঠাৎ পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক এই রোহিঙ্গা শরণার্থীর জীবনে নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়। আর এর কেন্দ্রে রয়েছে শিশুরা। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত হেঁটে বা দৌড়ে বাংলাদেশে আসতে গিয়ে পূর্ণ বয়স্কদের পাশাপাশি অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে পৌঁছানো শরণার্থী শিশুদের এখনই জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন।
চোখের সামনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিপুল ধ্বংসলীলা, খুন, ধর্ষণ এবং নিপীড়ন দেখে শিশুরা মানসিকভাবেও ভয়ানক বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা সেবাও এখন দরকার।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে অনেক প্রসূতি মা রয়েছেন। অনেকেই আবার পথিমধ্যে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বাংলাদেশে আসার পরে অনেক রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। সব মিলিয়ে জরুরি সেবার প্রয়োজন এমন শিশুর সংখ্যা দুই লাখের বেশি।
শরণার্থীদের ঢল না থামায়, ক্যাম্পের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ক্যাম্পে মৌলিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ খাবার পানির সংকট বেড়ে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা বৃদ্ধ, শিশু ও নারীরা পানিবাহিত রোগের ঝুঁকিতে বেশি রয়েছেন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ভয়ঙ্কর চিত্র : মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী বহু অপরাধ করেছে বলে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যালয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন ও সহিংসতার ভয়ঙ্কর সব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশে আসা ২০৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জাতিসংঘ রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছে।
রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া সামরিক অভিযানের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, এলাকা নির্মূল অভিযানে কয়েক শ’ মানুষ নিহত হওয়ার ধারণা করা যায়। এতে আরো বলা হয়, সম্ভাবনা অনেক বেশি যে, মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা বিভীষিকাময় দমন-পীড়নের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাদের অভিযোগ, সেনাবাহিনী ও পুলিশের পাশাপাশি মিয়ানমারের অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক যোদ্ধারা এসব নির্যাতন চালিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৮ মাস বয়সী এক শিশুকে হত্যার পাশাপাশি তার মাকে গণধর্ষণ করে নিরাপত্তা বাহিনীর ৫ সদস্য।
জাতিসংঘ আরো বলেছে, তাদের কাছে ৬ বছরেরও কম বয়সী তিন শিশুকে ছুরি দিয়ে হত্যা করার রিপোর্ট আছে। এর মধ্যে একজনের বয়স ৫। মেয়েটির মা জানান, তার ছোট্টমেয়েটি তাকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে এক ব্যক্তি বড় একটি ছুরি দিয়ে গলা কেটে মেয়েটিকে হত্যা করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ বিন রা’দ জেইদ আল হুসেইন এক বিবৃতিতে বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তা অবর্ণনীয়। যেসব এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান শেষ করেছে, সেই সব এলাকায় শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘কোন ধরনের ঘৃণা একজন মানুষকে মায়ের দুধের জন্য কাঁদতে থাকা শিশুকে ছুরিকাঘাত করাতে পারে? আর ওই মাকে নিজ চোখে কোলের শিশুকে হত্যার দৃশ্য দেখতে হচ্ছে, যখন তাকে গণধর্ষণ করছে সেই নিরাপত্তা বাহিনী, যাদের কিনা তাকে সুরক্ষা দেয়ার কথা। এটা কী ধরনের নির্মূল অভিযান? এতে জাতীয় নিরাপত্তার কোন লক্ষ্যমাত্রা উদ্ধার হতে পারে?’
জেইদ আরো বলেন, মিয়ানমারের নেতৃত্বকে এমন সামরিক অভিযান বন্ধের আহ্বান জানাতে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাচ্ছি তাদের সর্বশক্তি নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দিতে। এসব অভিযোগের গভীরতা আর মাত্রা বিশ্ব সম্প্রদায়ের তরফে বলিষ্ঠ প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে।
জাতিসংঘের সাক্ষাৎকার নেয়া ৪৭ শতাংশ ব্যক্তি বলেছেন, তাদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য এ অভিযানে নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের সঙ্গে কথা বলা ২০৪ জনের বেশিরভাগই হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করার কথা জানিয়েছেন। ২০৪ জনের মধ্যে ১০১ জন ছিলেন নারী। এদের অর্ধেকের বেশি ধর্ষণের শিকার বা অন্য ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধ : গত মার্চে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংঘি লি স্পষ্ট করেই বলেন, মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গারা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ শিকার। এর আগে গত নভেম্বরে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) বলেছিল, মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ‘খুব সম্ভবত’ মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার। আর ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনেও বলা হয়, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন সম্ভবত মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ডব্লিউএফপির সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনা অভিযান সত্ত্বেও যেসব রোহিঙ্গা রাখাইন ছেড়ে পালাননি, তারা খাদ্য-সংকটের মধ্যে দিন যাপন করছেন। অভিযানের সময় রাখাইনের মোংডুর বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এখানকার এক-তৃতীয়াংশ বাড়ির লোকজন চরম খাদ্য-সংকটে রয়েছেন। চরম খাদ্য-সংকট বলতে বাড়িতে কোনো খাবার না থাকা অথবা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একবারও না খাওয়াকে বোঝানো হয়েছে।
কুতুপালং এ আর্তনাদ : কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুপালং এ আশ্রয় নেয়া অধিকাংশ রোহিঙ্গাই নারী ও শিশু। স্থানীয়রা বলছেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্বামী-সন্তানহারা। রাত নামলেই এসব স্বজনহারাদের কান্নায় বস্তির পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
মিয়ানমারের মংডু সিকদারপাড়া থেকে পালিয়ে এসে কুতুপালং বস্তির এ ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমের ঝুপড়ি আশ্রিত স্বামী-সন্তান হারা বয়োবৃদ্ধ জুহুরা খাতুন (৬০) জানান, মগ সেনারা তার ছেলে আবু তৈয়বকে (২২) নির্মম নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করেছে। চোখের সামনে তার মেয়ে রওশন বানু (৩০) ও বেগম বাহারকে (২৬) গণধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে। যাওয়ার সময় তারা বসতবাড়িটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ নির্মম পৈশাচিকতার বর্ণনা দিয়ে জুহুরা খাতুন বারবার কেঁদে উঠছিল। সে জানায়, দিনের বেলায় কোনরকম সময় কাটালেও রাতে সে ভয়াবহ দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে। যে কারণে কান্না থামাতে পারি না।
মংডু পোয়াখালী ছালিপাড়া থেকে আসা ইলিয়াছ (৩৫) জানায়, সেখানকার সেনাবাহিনী ও পুলিশ তার পিতা আব্দুস শুক্কুরকে জবাই করে হত্যা করেছে। এ সময় তার স্ত্রী রহিমাকে (২৫) লক্ষ্য করে গুলি করলে ভাগ্যক্রমে সে বেঁচে যায়। গুলিবিদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে অনেক কষ্টে এপারে চলে এসেছি। সে আরো জানায়, তার পাশের বাড়িতে থাকা বোন, তার স্বামী ও ছেলে মেয়েসহ ৫ জনকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তারা বেঁচে আছে কিনা জানি না।
শফিউল আলম (৩৫), স্ত্রী নুর বেগম (২৮) ও ৪ ছেলে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মংডুর পোয়াখালী গ্রাম থেকে। সে জানায়, সেনাসদস্যরা আসতে দেখে সে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। তারা চলে যাওয়ার পর বাড়ি এসে দেখে বড় ভাই নুর মোহাম্মদের লাশ মাটিতে পড়ে আছে। পাশের বাড়ির আলী হোছন (৬০), আবুল বশর (২৮), লালু (৪০)কে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। পরে শুনেছি তাদেরকে নির্মম নির্যাতন করে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।
কুতুপালং বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিকসহ একাধিক বস্তিবাসী জানান, রাত নামলে বস্তিতে আশ্রয় নেয়া স্বজনহারা রোহিঙ্গাদের কান্নায় অন্যান্য বস্তিবাসী ঘুমাতে পারে না। তিনি বলেন, বস্তিতে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তারা কেউ না কেউ আত্মীয়-পরিজনকে হারিয়েছে। সহায় সম্বলহীন এসব রোহিঙ্গা একদিকে যেমন স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলতে পারছে না, অন্যদিকে আশ্রয়হীন অবস্থায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। যে কারণে রাত নামলেই নারী শিশুর কান্নায় বস্তি এলাকায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

 

Share.

মন্তব্য করুন