গত মাসে নাম ঠিকানাবিহীন একটা পার্সেল আব্দুর রহমান সাহেবের ঠিকানায় এলো। রহমান সাহেব শিক্ষিত লোক। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অসাধু কর্মচারীদের পাল্লায় পড়ে নিজেও অসাধু হয়ে গেছেন। পূর্বে তিনি নিয়মিতই নামাজ আদায় করতেন, রোজা রাখতেন, জাকাত দিতেন। কিন্তু এখন তিনি, সবকিছু ভুলে গিয়ে দুনিয়াবি স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিভাবে সম্পদের পাহাড় গড়বেন, এই চিন্তা নিয়েই তিনি ব্যস্ত। পৃথিবীতে সম্পদ তৈরির জন্য মূল কাজকে ভুলেই গিয়েছেন।
তার নামে যে পার্সেলটা এসেছিল, তাতে কয়েকখানা ইসলামিক বই এবং একটা চিরকুট ছিল। চিরকুটে লেখাÑ
কষ্ট করে বইগুলো যদি মনোযোগ সহকারে পড়েন, এতেই আমার সার্থকতা। বইগুলো পড়লে হয়ত পৃথিবীতে এসে আমাদের কাজ কি তা আপনার স্মরণ হবে। ইনশাআল্লাহ…
চিরকুটখানি পড়ে রহমান সাহেব একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন। পৃথিবীতে আসার মূল উদ্দেশ্য কী? নানা ধরনের প্রশ্ন তার মাথায় জাগল।
কয়েকদিন ধরে বইগুলো পড়ছ্নে। এগুলো পড়ে তার খুব ভালো লাগল। নিয়মিত নামাজ পড়াও শুরু করেছেন। নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন। আয়াতসমূহের অর্থ পড়েন। সে অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করেন। আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতার ভয় তার মনে জাগে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে তিনি নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দেন। আর কদিন থেকে তিনি অফিসে গিয়েও ভাবুক মনে বসে থাকেন। তার এরই অবস্থা দেখে মাঝে মাঝে অফিসের অন্যান্য কর্মচারীরা কানাঘুষা করে। কাউকে যদি ইসলাম সম্পর্কে বুঝাতে চেষ্টা করেন, তাহলে ওরা অন্যমনস্ক হয়ে কথা কাটিয়ে যায়। আবার পেছন থেকে উনি পাগল হয়ে গেছেন ভাবে।
তিনি একাকী বসে একদিন ভাবছেন মানুষ এখন আমাকে পাগল বলে। কিন্তু আমি তো এতদিন সত্যিকারের পাগল ছিলাম। এখন আমি সুস্থ হয়ে গেছি। আর যারা আমাকে পাগল বলে তারাই তো মূল পাগল, তারা নির্বোধ।
এমন সময় হঠাৎ জামান সাহেব এসে তার রুমে ঢুকেন।
দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। তাকে দেখে আব্দুর রহমান সাহেবের মনটা একটু বিষণœ হয়ে গেল। কারণ তিনি জানেন লোকটা খারাপ। আর সে এসেছেও বোধ হয় কোন খারাপ চিন্তা নিয়ে। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। মি. জামান বললেন একটা লোক এসেছিল তার কাছে চাকরির জন্য। তো ঐ লোকটার কাছ থেকে কত টাকা ঘুষ নেয়া যায়? সে বিষয়ে কথা বলার জন্য মি. জামান এসেছেন আবদুর রহমানের কাছে। কিন্তু জামানের প্রস্তাবে তিনি রাজি না হয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি জামানকে বললেন, “আপনি কি সারা জীবন পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন? আপনি তো অনেক সম্পদ কামিয়েছেন। কিন্তু অখিরাতের জন্য কী কামিয়েছেন? মৃত্যু যেকোনো সময় আপনার দ্বারে এসে উপস্থিত হতে পারে। এখন ঘুষ খাওয়ার কথা না ভেবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিন। নামাজ পড়ুন কোরআন পড়ুন। ইসলামকে জানার চেষ্টা করেন। এবং তা মেনে চলুন। ভালো কাজ করে উপার্জন করার চেষ্টা করেন। অবসর সময়ে এইসব খারাপ চিন্তা করে মনে শান্তির জন্ম না দিয়ে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করুন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়বেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন তওবা করবেন। আর সব সময় ভালো কাজ করার চেষ্টা করবেন। যেমন আপনি টেনশন দূর করার জন্য ধূমপান করেন তখন ধূমপান না করে যদি কোরআনের আয়াতসমূহ অর্থসহ পড়েন তাহলে আপনার সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবেন। অন্য দিকে আপনার শরীরও সুস্থ থাকবে। কে শুনে কার কথা। ওদিকে মি. জামান বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, এবার উঠি। ওনি চলে গেলেন। আবদুর রহমান ভাবতে লাগলেন মানুষের কথা।
“হায় মানুষ! একবার ভাবতে চায় না তার মূল গন্তব্যের কথা। মৃত্যুর কথা তো ওরা ভুলেই গেছে। কাকে আমি এত কথা বললাম। কাকে বুঝালাম…
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। রিং শুনে তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাকে সালাম দিল। তিনি সালামের উত্তর দিলেন। লোকটার কণ্ঠ তাঁর কাছে অচেনা মনে হলো। লোকটা শুধু বলল, “আলোর পথে আপনাকে অভিনন্দন।” লাইন কেটে দিল। সাথে সাথে তিনি ঐ নম্বরে ফোন করলেও তিনি সংযোগ পেলেন না। কে ফোন করল তারও কোনো হদিস পেলেন না। তবে তিনি অনুমান করলেন “যে লোকটা পার্সেল পাঠিয়েছিল সেই হবে এই লোক।
দু’দিন পর আবার তাঁর মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ এলো। মেসেজে শুধু লেখা ‘দেখা হবে জান্নাতে। আল্লাহ হাফেজ।’
ঐ নাম্বার থেকেই মেসেজটা এসেছে। কোনো কিছু বুঝতে পারলেন না। ঐ নম্বরে তিনি ফোন করলেন। ফোন রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে অন্য একজন তাকে সালাম জানালো। তিনি যখন ফোনটার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে বলল, “ওনি দুই তিন মিনিট আগে মারা গেছেন।” পরে তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন অচেনা সেই কণ্ঠটি ছিল তাঁর ছোটবেলার বন্ধু আব্দুল হকের।
লেখাপড়া চলাকালীন অবস্থায় শহরে আসার পর থেকে কোনো যোগাযোগ হয়নি। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত একসাথে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছেন।
আজ তার ভাবতে অবাক লাগছে যে যাকে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, সেই বন্ধুই আবার অন্ধকার থেকে তাকে ফিরিয়ে আনলেন। পৃথিবীতে আর সেই অচেনা কণ্ঠের মানুষটির সাথে শেষ দেখাটুকু হল না।

Share.

মন্তব্য করুন