১.
এইমাত্র মঙ্গল গ্রহের বুকে ল্যান্ড করলো নাসার স্পেসশিপ। তিন তরুণ বিজ্ঞানী- ফাহমিদ, জাফর ও জারিফকে নিয়ে টিম তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। ধীরে ধীরে মঙ্গলের মাটিতে পা রাখলো জারিফ। পা দেয়ার সাথে সাথে কাদার মতো খানিকটা দেবে গেলো। লাল মাটিতে নেমে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলো ও।
ফাহমিদ, জাফর, জারিফ- তিন বন্ধু, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ তিন তরুণ বিজ্ঞানী। জাতীয় বিজ্ঞানমেলায় পরিচয়। আবিষ্কারের নেশা ওদের তিনজনকে খুব সহজেই এক সুতোয় গেঁথে দেয়। ২ বছর আগে, ২০৩৫ সাল থেকে নাসার নবীন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেয় এই তিনজন। এ বছর সকল বিজ্ঞানীর সম্মতিক্রমে এই তরুণ ত্রয়ীকে দল গঠন করে মঙ্গলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জারিফের দায়িত্ব ছিলো মঙ্গলে পদার্পণ করার। জাফর ছিলো ইঞ্জিনে, আর ফাহমিদের ভাগে ছিলো নমুনা সংগ্রহ করার দায়িত্ব। অনেকটা কাদামাটি আর তার ওপর লাল পাউডারের আস্তর পেরিয়ে হাঁটতে লাগলো জারিফ। ওপর থেকে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে ফাহমিদ।
হঠাৎ পায়ে কাঁটার মতো কী একটা বিঁধলো জারিফের। সাথে সাথে নভোযানে ফিরে এলো ও। মঙ্গলের প্রায় ২ ইঞ্চি পুরু বিশেষ পোশাক ভেদ করে কিভাবে কাঁটা বিঁধলো তা সবাইকেই বিস্মিত করলো। এরপর আরো কিছু কাজ করে আবার পৃথিবীর বুকে রওনা হলো তিন বিজ্ঞানী।

২.
আজ তিনদিন ধরে প্রচ- জ্বর জারিফের। মঙ্গলে কী এক অমঙ্গল পেয়ে বসেছে তাকে, সেখান থেকে এসে থেকে তার শরীর সেই যে অসুখে পড়লো, আর কমছেই না। শুধু জ্বর হলে কথা ছিলো না। জারিফের সারা শরীরে লাল লাল ছোপ ছোপ দাগে ভরে গেছে। অথচ রক্ত পরীক্ষায় এমন কিছুই ধরা পড়েনি, যা এই অসুখের কারণ হতে পারে। ইতোমধ্যে নাসার প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ডা. ফজল জারিফের পায়ে ফোটা সেই কাঁটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। ডা. ফজল নাসায় একই সাথে বিজ্ঞানীদের চিকিৎসা এবং মঙ্গলের আবহাওয়া ও মাটির নমুনা নিয়ে গবেষণারত আছেন প্রায় তিন যুগ ধরে।
৫ দিন কেটে গেছে। জারিফের জ্বর একটুও কমেনি। সকাল ৯টায় ডা. ফজলের ফোন পেয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলো ফাহমিদ ও জাফর। তাদের দেখে বসতে বললেন ডা. ফজল। এরপর বললেন-
“তাড়াতাড়ি এসে ভালো করেছো। তোমাদের বন্ধুকে নিয়ে বেশ বিপদে পড়েছি।”
“কেন স্যার?”
“তোমরা যেই কাঁটাটা দেখেছো, সেটা শুধু কাঁটা না।”
“তাহলে কী স্যার?” অবাক হয়ে বললো জাফর। আশঙ্কার মেঘ ওর মুখে।
“অতো ভয়ের কিছু এখনো হয়নি। তবে ওর অসুখ দিন দিন যেই কাঁটার জন্য খারাপের দিকে যাচ্ছে, সেটা খুব অদ্ভুত ধরনের বিষ।”
“সেটা কেমন স্যার?”
“আমি এখন পর্যন্ত কাঁটার উপাদানের মধ্যে যা যা পেয়েছি, তার মধ্যে সীসা, আর্সেনিক ও কার্বন মনো অক্সাইড এই তিনটি বিষাক্ত উপাদান খুব বেশি পরিমাণে আছে। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতেই পারছি না…” চুপ হয়ে গেলেন ডা. ফজল। দুইজন তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে ডা. ফজল চলে গেলেন অন্য প্রসঙ্গে- “যা হোক, ওর চিকিৎসার ব্যাপারে আমি কোনো মেডিসিন দিতে পারছি না। আপাতত মধু ও কালোজিরা মিশিয়ে তিনবেলা ওকে দিচ্ছি।”
“স্যার, মধু আর কালোজিরা কি এই বিষ সারাতে পারবে?” বললো ফাহমিদ।
“কেন, আল্লাহর রাসূলের হাদিস শোনোনি? মৃত্যুরোগ ব্যতীত সকল অসুখের চিকিৎসায় মধু ও কালোজিরা অব্যর্থ। আর যেহেতু এক্ষেত্রে এই দাওয়াই কাজ দিচ্ছে, সেহেতু জারিফ সুস্থ হয়ে ওঠার আশা দেখছি আমি। তোমরা শুধু দোয়া করো, আর ওর দিকে নজর রেখো।” এই বলে ডা. ফজল আবার চলে গেলেন সালাম দিয়ে। সময় হাতে নেই বেশি, কিন্তু কাজ এখনো যে অনেক বাকি।

৩.
ডা. ফজলের চলে যাওয়ার পর দৌড়ে জারিফের বেডে গেলো ফাহমিদ ও জাফর। ওদের দেখে স্মিত হাসতে চাইলো জারিফ। কিন্তু ঠোঁটের দু’পাশের ঘা তার হাসি থামিয়ে দিলো। মন খারাপ হয়ে গেলো দুই বন্ধুর। জাফর বললো, “কিরে, এখন কেমন আছিস? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে কি?”
জারিফ এবার কথা বললো, “না রে। আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করছি। আমার শরীরে বেশ কিছু জায়গায় আলপিনের মতো শক্ত জিনিস খুব নাড়াচাড়া করছে। অনেকটা ঐ কাঁটার মতোই।”
“কি বলিস? ফজল স্যারকে জানিয়েছিস?”
আমি না, উনিই আমাকে জানালেন যে আমার এমন হতে পারে। আমি পরশুদিন তাকে জানালে তিনি শুধু মাথা নেড়ে চলে গেলেন।”
“তার মানে?”
“হয়তো তিনি খুব মারাত্মক কিছু ভাবছেন। আবার এমনও হতে পারে তিনি কিছু গবেষণা করছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না।” জাফরকে বুঝালো ফাহমিদ। জারিফের বেশি কথা বলাতে চাইছে না ও। এরপর দুইজন কিছুক্ষণ ওর সাথে গল্প করে চলে এলো।
জাফর খুব আবেগী। মনটা বেশ খারাপ ওর। আসার পথে বললো ফাহমিদকে- “ওর এই অবস্থার জন্য আমরাই দায়ী, তাই না ফাহমিদ?” পানিতে চোখ টলমল ওর। ফাহমিদ বললো- “না তা হবে কেন? আল্লাহ এটা ওর ভাগ্যে রেখেছিলেন। আর তাছাড়া ও নিজে মঙ্গলে নামার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলো। এখানে আমাদের কিছুই করার ছিলো না।” “তবুও আমরা গেলে কি হতো?” “শোন জাফর। আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। দেখ না, এই অসুস্থতার বিনিময়ে আল্লাহ কি রেখে দিয়েছেন ভবিষ্যতে। তার চেয়ে আমরা ওর জন্য দোয়া করি এই ভালো। আর ফজল স্যার তো আছেনই। তিনি নিশ্চই একটা সমাধান বের করবেন।” ফাহমিদের কথায় একটু স্বাভাবিক হলো জাফর। দুইজনে ডা. ফজল স্যারের কক্ষ ত্যাগ করলো দোয়া করতে করতে।

৪.
আরো ২ দিন কেটে গেছে। ডা. ফজল টেবিলে বসে আছেন। তার চোখ নিমগ্ন টেবিলের ওপর, একটা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের দিকে। যন্ত্রের তলানিতে নিথর পড়ে আছে ছোট্ট একটা আলপিন, ‘মঙ্গলের কাঁটা’। সীসা, আর্সেনিক ও কার্বন মনো অক্সাইড যেই পদার্থে ভরে আছে। এরকম একটা বিষ কিভাবে এত বেড়ে যাচ্ছে কোনোভাবেই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। মধু ও কালোজিরার মিশ্রণে তৈরি ঔষধ জারিফের শারীরিক অবস্থার অবনতি রোধ করছে বটে, কিন্তু অসুখ সম্পূর্ণ সারাতে পারছে না। ডা. ফজল বুঝতে পেরেছেন, মধু বা কালোজিরার মিশ্রণে এমন কোনো উপাদান আছে, যা পৃথক ভাবে দিতে পারলে হয়তো জারিফকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু সেটা বের করা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অতো সময় তার হাতে নেই। ইতোমধ্যে জারিফের শরীরে প্রায় ৫৬টি আলপিন হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৫টি নাড়াচাড়া করছে। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে আলপিনগুলো। এদের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করেও লাভ নেই। কারণ সেগুলো মানবদেহের উপযুক্ত নয়। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন ডা. ফজল। এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসায় তার হার হয়নি। আজ কি তবে…
আর ভাবতে পারলেন না ডা. ফজল। লুটিয়ে পড়লেন সিজদায়। সাহায্যের শেষ আশ্রয়স্থল, পরম করুণাময়ের কাছে।

৫.
আজ ২ ডিসেম্বর। জারিফের অপারেশন। দীর্ঘ আট দিন ভয়ঙ্কর এক আলপিনের আক্রমণের আজ অবসান হতে যাচ্ছে। বরাবরের মতো এবারো আল্লাহর দরবার থেকে নিরাশ হয়ে ফেরেননি ডা. ফজল। মুনাজাতরত অবস্থায়ই বুদ্ধিটা তাঁর মাথায় আসে। ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা শরীরের রক্ত পরিবর্তন করার এই চিন্তাটাই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ালো অবশেষে। সম্পূর্ণ রক্ত পরিবর্তন, যা করতে হবে মিনিট দুয়েকের মাথায়। এ ধরনের প্রায় অসম্ভব কীর্তি এর আগে একজনই করেছেন। সেই ডা. ফজলই আজ আবার এই অপারেশন করতে যাচ্ছেন। সাধারণ প্রক্রিয়ায় পুরো শরীরের রক্ত পরিবর্তন করতে ৩০ মিনিট থেকে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে বিলম্বের সুযোগ নেই। বেপরোয়া আলপিনগুলো শরীরে প্রতি ২ মিনিটে বাড়তে আরম্ভ করেছে। এই ভয়ঙ্কর কাঁটামুক্ত করতে ২ মিনিটের কম সময়ের মধ্যেই ডা. ফজলকে সম্পূর্ণ রক্ত প্রতিস্থাপন করতে হবে।
সকাল ৯টায় অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলেন ডা. ফজল। বাইরে উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষমাণ জারিফের বাবা মা, সহকর্মী, আর সবচেয়ে কাছের বন্ধু- তার এতদিনের সহযাত্রী ফাহমিদ ও জাফর। আল্লাহর ওপর ভরসা করে জারিফকে অজ্ঞান করে নিলেন ডা. ফজল। পল পল করে বয়ে যেতে লাগলো সময়…
আল্লাহর ওপর ভরসা মিথ্যে হলো না। তবে অপারেশন সফল হওয়ার চাইতেও অন্য এক কারণে বেশি খুশি হলেন ডা. ফজল। তাঁর গবেষণার ফল তিনি পেয়ে গিয়েছেন। মঙ্গলের কাঁটা রহস্য এখন আর রহস্য নয় তার কাছে।

৬.
মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে জারিফ। গায়ের লাল লাল দাগগুলো মিলিয়ে গেছে প্রায়ই। তবে এখনো হাসপাতাল থেকে তাকে ছুটি দেয়া হয়নি।
একটু আগে জারিফের সাথে দেখা করতে এসেছে ফাহমিদ ও জাফর। সাথে এসেছেন ডা. ফজল। ফাহমিদ প্রশ্ন করলো তাকে, “স্যার, আমি কিছুই বুঝলাম না, একটা কাঁটা কিভাবে জারিফের এতো ক্ষতি করলো? আর সংখ্যা বৃদ্ধিই বা হলো কিভাবে?”
ডা. ফজল ছোট্ট করে বললেন- মঙ্গল কাঁটা এক ধরনের প্রাণী; আমাদের ভাষায়- এলিয়েন!

Share.

মন্তব্য করুন