বেলা দুটো বাজতে না বাজতেই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। শুধু পঞ্চম শ্রেণির ছাত্ররা রয়ে গেল ক্লাসে। রিজু একটা কিছু ভাবতে ভাবতে স্কুলের বারান্দা পার হয়ে থমকে দাঁড়ালো। রহিম ও জব্বার এসে বললো, কিরে, থামলি কেন? রুমে যাবি না?
– যাবো। কিন্তু আমি আরিফের কথা ভাবছি। আরিফ তো দশ বারো দিন স্কুলে আসে না। ওর মায়ের অসুখটা কি বেড়েছে! না কি ওরই কোনো বিপদ হলো। সেই যে গেল আর ফেরার নাম নেই। কোনো খবরও পাঠালো না। অথচ এদিকে পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে।
রহিম বললো, আর এক সপ্তাহ পরই তো ফাইনাল পরীক্ষা।
জব্বার বললো, ও না এলে আমরা কী করবো? আচ্ছা ওর বাসায় কি মোবাইল আছে? রিজু বললো মনে হয় নাই। আরিফ বলেছিল ওরা মধুবাগ বাজারের পেছনে থাকে। বাসে গিয়ে নামতে হয় মগবাজার চৌরাস্তায়। সেখান থেকে রিকশা করে যাওয়া যায়। ছোট ছোট টিনের ছাপরায় নাকি ওরা থাকে। কি করি বলতো? রহিম আর জব্বার কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেল ছাত্রাবাসের দিকে।
স্কুলটি গরিব মেধাবী ছাত্রদের জন্য। এখানে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দান করা হয়। ছাত্রদের থাকা খাওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করে কর্তৃপক্ষ। স্কুল প্রাচীরের মধ্যেই রয়েছে ছাত্রাবাস।
অন্য ছেলেদের মতো আরিফও এক গরিব বাবার ছেলে। ছেলেটি মেধাবী বলে ওর বাবার ইচ্ছা ছিল কোনো ভালো স্কুলে ভর্তি করা। কিন্তু টাকা পয়সার অভাবে তা সম্ভব হয়নি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সে রিকশা চালায়। একদিন এক সাহেবের কাছে নিজের ব্যর্থতার কথা বলতেই সাহেব তাকে স্কুলটির কথা বলেন, এবং তিনিই আরিফের ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন।
আরিফ গত বছর তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তারপর বার্ষিক পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠে। রিজু অবশ্য বরাবরই প্রথম হয়ে আসছে। রিজুর সঙ্গে আরিফের মনের মিল হওয়ায় ওরা দু’জন খুব ভালো বন্ধু। শুধু পড়ালেখার ব্যাপারেই নয়, ওরা নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখের কথাও বলাবলি করে। আরিফের বাবা মাঝে মাঝে আরিফকে দেখে যায়। এ-রকম অনেক বাবারাই আসে। স্কুলের বাইরে গেটের পাশেই গার্জিয়ানদের বসার ব্যবস্থা আছে।
কিছুদিন আগে আরিফ ওর মায়ের অসুখের কথা শুনে বাবার সাথে বাসায় চলে আসে। মাকে দেখাশুনা করার জন্য ঘরে কোনো আপনজন নেই। আরিফের ছোট্ট একটি ভাই আছে। সে কি আর সব কিছু পারে। বাবাকে প্রতিদিন রিকশা নিয়ে বের হতে হয়। তা না হলে সংসার চলে না।
আরিফ ভালো ছেলে। স্কুলের সবাই ওকে পছন্দ করে। কিন্তু সামনে ওর বার্ষিক পরীক্ষা- অথচ ও কিছুই জানে না। এ ব্যাপারে কেউ কোনো কথাই বললো না। শুধু রিজুর মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠলো বন্ধুর জন্য। বার বার ওর মনে হতে লাগলো তা’হলে কি আরিফের মা মারা গেল? অথবা আরিফের কোনো বিপদ হলো। আরিফ আর রিজু পাশাপাশি থাকে। একই টেবিলের পড়ালেখা করে। ও না থাকায় রিজুও মন দিয়ে পড়ালেখা করতে পারছে না। মনটা কেমন বিষণœ হয়ে থাকে।
নানান কথা ভাবতে ভাবতে কাউকে কিছু না বলেই ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে পড়ে রিজু। নিজের কাছে দশ পনেরো টাকা ছিল তা নিয়েই বাসস্ট্যান্ডে গেল ও। বাসে উঠে হেলপারকে বলে রাখলো মগবাজার চৌরাস্তায় নামিয়ে দিতে। রাস্তার জ্যাম-জট মারিয়ে মগবাজার নামলো রিজু। রাস্তার পাশের দোকানদারদের জিজ্ঞেস করলো, আঙ্কেল, আমি মধুবাগ বাজারে যাবো কোন রাস্তায়? দোকানদাররা পথ দেখিয়ে দিলে রিজু সেই পথে হাঁটতে শুরু করলো। কিছু দূর গিয়ে ভাবলো একটা রিকশা নিলে সহজেই বাজারে পৌঁছানো যাবে। তা ছাড়া জনে জনে শোনারও দরকার হবে না।
পথের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে একটা রিকশা দাঁড়ানো দেখে এগিয়ে গেল রিজু। রিকশাওয়ালাকে বললো, আঙ্কেল মধুবাগ বাজারে যাবেন? আঙ্কেল খানিকটা বিরক্তি ঝেড়ে বললো, না- তুমি অন্য রিকশা দেখো। তারপরও ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বললো, যেতে পারি, ভাড়া পঁচিশ টাকা। রিজু ভাড়া শুনে একটু চমকে উঠলো। ভাবলো বাজারটা তা’হলে অনেক দূর। কিন্তু আমার কাছে তো অতো টাকা নেই। শেষে আবার হাঁটা শুরু করলো। কিছুদূর যায়, আবার পথচারীর কাছে জেনে নেয় বাজারের কথা।
এভাবে চলতে চলতে নিভে গেল দিনের আলো। চারিদিকে জ্বলে উঠলো ইলেকট্রিসিটি। রিজুর মনের মধ্যে কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। একা একা এতো দূরে সে কখনো যায়নি। কিন্তু উপায় কি। এখন তো আর ফিরে যাওয়া যাবে না। যেমন, করেই হোক আরিফের ঠিকানা পেতেই হবে। ভয় ভাবনা ঝেড়ে ফেলে রিজু আরো দ্রুত হাঁটতে লাগলো। আরেকটু এগিয়ে বাজার দেখতে পেয়ে মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। মুদি দোকানের এক ছেলেকে বললো, আচ্ছা ভাই, এই বাজারের পেছনে টিনের ছাপরায় আরিফ নামের একটা ছেলে থাকে। ওর বাবা রিকশা চালায়। তাকে আপনি চেনেন?
ছেলেটি বললো, আরিফ কি পড়ালেখা করে?
– হ্যাঁ, পড়ালেখা করে।
– তোমার কিছু হয়?
– আমার বন্ধু। আমরা একই ক্লাসে পড়ি।
– চিনি। তুমি একা যেতে পারবে?
– না। এদিকে কখনো আসিনি তো! একটু এগিয়ে দিলে উপকার হয়।
– তা’হলে একটু অপেক্ষা করো। একটা ছেলে দোকানে রেখে তবেই যাবো।
রিজুর বুকে অনেকটা আশা জন্মালো। ও চুপচাপ দোকানের পাশে দাঁড়াল। একটু পরই একটা ছেলে এলো। তাকে দোকানে রেখে দোকানদার ছেলেটি রিজুকে নিয়ে গেল আরিফদের ঘরের কাছে। ছেলেটি বাইরে থেকে বললো, আরিফ তোর স্কুলের বন্ধু এসেছে।
আরিফ ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। এসেই রিজুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ক’দিন ধরে তোর কথাই বার বার মনে হচ্ছিলো। আমি ঘর থেকেই বুঝেছি তুই এসেছিস।
বলতে বলতে আরিফের চোখ দুটো আবেগে ভিজে উঠলো। ও বললো আয় ঘরে আয়। রিজু বললো, তোর মায়ের অসুখটা ভালো হয়েছে?
– আগের চেয়ে একটু কম। ওপাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। শরীরটা খুব দুর্বল। তবুও বাবাকে দিয়ে একবার স্কুলের খোঁজখবর জানতে চেয়েছিলাম। তুই এসে খুব ভালো করেছিস।
– আমাদের পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে। সাতদিন পরই পরীক্ষা শুরু হবে। না এসে কি করি বল! তুই নেই বলে আমিও ভালো পড়তে পারছি না।
– আমিই বা কি করব! দুর্বল শরীর নিয়ে মা একা একা কিছুই করতে পারে না। বাবা সকালে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যায়। তুই এসে খুব ভালো করেছিস।
তারপর পরীক্ষার রুটিন লিখে দিয়ে রিজু বললো, বেশি রাত করা যাবে না আরিফ। তুই কি আমাকে একটু এগিয়ে দিবি? তারপর বাসে উঠলেই চলে যেতে পারবো। আরিফ হাসতে হাসতে বললো, তুই চিন্তা করিস না। বাবা হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে। ওরা কথা বলতে বলতেই আরিফের বাবা এলো। বাবাকে দেখেই আরিফ বললো, বাবা দেখো কে এসেছে? আমার বন্ধু, আমার স্কুলের খবর নিয়ে এসেছে।
আরিফের বাবা ভেতরে ঢুকে রিজুকে দেখে বড় বড় করে চেয়ে থাকলো। আরিফ বললো, বাবা এর নাম রিজু। এর কথাই তো আমি গল্প করি। আমরা এক রুমে থাকি। এক সাথে পড়ালেখা করি। ও আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। রিজুও নির্বাক চেয়ে আছে আরিফের বাবার দিকে। রিজু মনে মনে বললো, আমি তো এই আঙ্কেলের রিকশাতেই আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু…
হঠাৎ আরিফের বাবা রিজুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে বললো, বাবা, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। তুমি আমার আরিফের বন্ধু। কতদূর থেকে কত কষ্ট করে খবর নিয়ে এসেছো।
– তাতে কি হয়েছে। কিন্তু আঙ্কেল আমাকে যে এক্ষুনি ফিরতে হবে। আমি স্কুলে বলে আসিনি।
– তুমি চিন্তা করো না বাবা। আমি তোমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসবো। তোমাকে একটি পয়সাও দিতে হবে না।
তারপর আরিফের বাবা মনে মনে বললো, বাবা আমি না বুঝে তোমার কাছে অনেক বেশি ভাড়া চেয়েছিলাম। আর কখনো বিপদ গ্রস্ত কারো কাছে বেশি ভাড়া দাবি করবো না। পারলে সাহায্য করবো। আমাকে তুমি ক্ষমা করো। শেষে হাসতে হাসতে বললো, তুমি আমার আরিফের বন্ধু। বন্ধুর বাড়িতে এসে না খেয়ে যেতে হয় না। তাতে বন্ধু কষ্ট পায়।
Share.