প্রতি বছর বিশ্ব মুসলিমের ঘরে ঘরে কুরবানি বা ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হয় মহান আল্লাহর প্রতি ত্যাগ ও আনুগত্যের দৃষ্টান্ত নিয়ে। মুসলমানরা বছরে মাত্র দু’টি উৎসব উদযাপন করে- একটি ঈদুল ফিতর আরেকটি ঈদুল আজহা।
এই দু’টি উৎসবে সারা জাহানের মুসলিম উম্মাহ এক কাতারে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর প্রতি তৌহিদি বিশ্বাসে ত্যাগের, সাম্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ঈদুল আজহার প্রধান শিক্ষা হলো আমাদের ভেতরের লোভ-লালসার পশুশক্তিকে কুরবানি দিয়ে আত্মত্যাগের মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করা। সহজ ও সুন্দর জীবন চালাতে হলে কিছু মৌলিক চাহিদার প্রয়োজন হয়। চাহিদা অতিরিক্ত হলেই ভোগের মাত্রা বেড়ে যায়। লালসা বাসনা এসে জীবনকে কলুষিত করে। সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের মূলনীতি ও আদর্শ ভুলে উচ্ছৃঙ্খল ও অনৈতিক পথে আমরা হাঁটি। পরিবার ও সমাজে এভাবেই অশান্তির বীজ বপন হয়। মহৎ কোনো কাজ ত্যাগ, সংযম, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম ছাড়া করা যায় না। তাই তৌহিদবাদী মুসলমানদের ত্যাগী ও সংযমী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে পাক কুরআন। এই ত্যাগের মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন আল্লাহর প্রিয় বন্ধু আমাদের সর্বত্যাগী নবী হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ)। সেই আত্মত্যাগের ঘটনা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। ইবরাহিম (আ) সর্বপ্রথম কুরবানি করেছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ)কে।
মানব ইতিহাসের কঠিনতম ও মহত্তম এই আত্মত্যাগের স্মরণে ইসলামে ঈদুল আজহা উৎসব পালিত হয়। হজরত ইবরাহিম (আ)-এর মহান কুরবানি শুরু হয় আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে। এই কুরবানি ছিলো একজন অনুগত বান্দার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের পরীক্ষা। পবিত্র কুরআন পাকে বলা হয়েছে, ইহা ছিলো স্পষ্ট পরীক্ষা। (সূরা আস সাফ্ফাত : ১০৬)
তিনি ছিলেন খোদাভীরু মুসলমান। মুসলমান শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণকারী। আমরা নবী ইবরাহিম (আ)-এর আত্মসমর্পণকে স্মরণ করে মুসলিম জাতি হিসেবে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই দিনে পশু কুরবানি করে আত্মার তৌহিদি শক্তিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করি।
কুরআনুল কারিমে কুরবানির আদর্শ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমার সালাত আমার কুরবানি, আমার জীবন আমার মৃত্যু সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশে নিবেদিত।” পাক কুরআনের এই ধরনের অনেক বাণী আমরা সবসময়ে ওয়াজ মাহফিল বক্তৃতায় শুনে থাকি। এবং নিজেদের জীবনে প্রায় সময় উচ্চারণ করে থাকি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে আমরা পালন করি না। ফলে বিশ্বময় মুসলমানরা আজ ক্ষুদ্র স্বার্থ ও গোষ্ঠীগত দলাদলিতে নিমজ্জিত। দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাতে জর্জরিত। ক্রমশ জাতির মহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। ঈমানের দৃঢ়তা কমে যাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহর মহত্ত্বর কল্যাণ চিন্তার পরিবর্তে আমিত্বের ক্ষুদ্র স্বার্থে রাহুগ্রাসে জড়িয়ে পড়ছি নিরন্তর। এর মূল কারণ হলো আমরা ইবরাহিম (আ)-এর মত, আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নিজের মনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য পরিশুদ্ধ করতে পারছি না। শুধু মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বললেই আল্লাহর প্রতি প্রকৃত আত্মসমর্পণ হয় না। আত্মসমর্পণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাই আমাদের নবী-রাসূলের জীবন যাপনে।
হজরত ইবরাহিম (আ) আল্লাহর হুকুমে প্রিয় পুত্রকে কুরবানি দিতে এতোটুকু কুণ্ঠা বোধ করেননি। কুরআনের প্রদত্ত জীবনবিধান অনুযায়ী সমস্ত জীবন যাপন করেছেন। আল্লাহর ইবাদতের জন্য মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, বহু কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সে একমাত্র প্রাণের ধন পুত্রকে নিজ হাতে কুরবানি দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হয়েছিলেন।
সুতরাং ঈদুল আজহার তাৎপর্য বুঝতে হলে প্রকৃত ইসলামকে জানতে হবে। ইসলাম কায়েমের পথ সহজ নয়। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পথ মাড়িয়ে যেতে হয়। প্রকৃত মুসলমানকে এই সমস্ত কঠিন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে হবে। যে পথ হজরত ইবরাহিম (আ) অতিক্রম করে আল্লাহর বন্ধু হতে পেরেছেন।
কুরবানির প্রকৃত শিক্ষা আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া, সংযমী হওয়া। আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী ইহজীবনে পথ চলা। এই জীবনবিধানে মানবরচিত কোনো পরিবর্তন করা যায় না। যেমনটি ইবরাহিম (আ) আল্লাহর আদেশকে শিরোধার্য করে একমাত্র পুত্রকে কুরবানি দিতে ক্ষণকালের জন্যও মোহগ্রস্ত হননি।
কুরবানির বিশদ তাৎপর্য এই সামান্য কথাতে বলা সম্ভব নয়। কুরবানি সম্পর্কে আমার সংক্ষিপ্ত ও উপর্যুক্ত বক্তব্য শেষে বর্তমান বিশ্বের নবীন, প্রবীণ ভাইবোনদের প্রতি একান্ত আবেদন- মহান নবী ইবরাহিম (আ)-এর জীবনের শিক্ষা আমাদের জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হোক। নতুন করে আমরা ইসলামের শিক্ষায় অশান্ত পৃথিবীকে নতুন করে আবাদ করার চেষ্টা করি এবং বলি “আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ রাব্বুল আলামিনের জন্য।”
Share.