সুন্দর একটা দেশে এসে পৌঁছেছে স্বনন। পৃথিবীতে এত সুন্দর দেশ আছে আগে ওর কল্পনায়ও আসেনি। কি সুন্দর কলকল রবে রুপোলি নদী বয়ে চলেছে। পাশে কি সুন্দর একটা বন। বনের মাথায় স্নিগ্ধ-কোমল চাঁদ উঠেছে। মৃদু-মন্দ হাওয়া বইছে। কি যে এক মুগ্ধ পরিবেশ। মনে হচ্ছে এটা কোনো একটা দ্বীপ।
বিদেশি একটি কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল স্বনন। পুরস্কারস্বরূপ বিদেশ ভ্রমণের টিকিট পায় ও। ও ভাবতেও পারেনি যে এমন একটা সুন্দর দেশ ভ্রমণের জন্য ওকে টিকিট দেয়া হবে।
হঠাৎ ও দেখল দূরে কতগুলো ভেড়া-ছাগলের মতো জীব বই-খাতা নিয়ে যেন ওর দিকেই আসছে। ওদের হাঁটার ভঙিটা ঠিক মানুষের মতো। অর্থাৎ দু’পায়ে ভর করে মানুষের মতো হেলে-দুলে হাঁটছে। ওরা স্বননের দিকে একটু অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। ওদের মানুষের মতো হেলে-দুলে হাঁটতে দেখে স্বননের হাসি পাচ্ছিল। হাসি সামলিয়ে ও বলল, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, লেস্কু।
স্বনন এর মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। ভাবল হয়ত ওর কথা বুঝতে পারেনি ওরা। স্বনন কিছুদূর হাঁটতেই দুটো মানুষের মতো জীব দেখতে পেল। কাছে গিয়ে দেখল ওদের গায়ে মানুষের মতো পোশাক নেই, আবার বনমানুষের মতো লোমও নেই। হয়ত বর্বর ধরনের মানুষ ওরা। মানুষ দুটোর কাঁধে একটা জোয়াল ও লাঙল বাঁধা। লাঙলের হাল ধরে আছে একটা বলদ। মানুষ দুটো একটু অন্যমনস্ক হলেই সপাং সপাং করে চাবুক মারছে বলদটি।
এ দৃশ্য দেখে আক্কেল গুড়–ম হয়ে গেল স্বননের। সব কিছুই কেমন যেন উল্টা-পাল্টা লাগছে। চাবুকের সপাং সপাং শব্দে ওদের কাছে এগিয়ে গেল। এ রূপ করুণ দৃশ্য দেখে ও আর স্থির থাকতে পারল না। বলল, ও হে বলদ ভাই, ওদেরকে এভাবে মারছ কেন?
ওর কথা শুনে বলদ একটু মুখ খিঁচিয়ে বলল, তেতা রামাতো কী?
বলদ কি জবাব দিলো স্বনন কিছুই বুঝতে পারল না। তবে বলদের মুখভঙি দেখে বুঝতে পারল ও ওর পর রেগে গেছে।
রাত প্রায় দুপুর হয়ে আসছিল কিন্তু কোথাও রাতের চিহ্নমাত্র নেই। সব জায়গাতেই কেমন দিনের মতো কলরব। স্বননের খুব ক্ষুধা পাচ্ছিল। চারপাশে কোনো লোকালয় দেখতে না পেয়ে ও ফল-মূলের খোঁজে একটা ঝোপের দিকে এগুতে লাগল। ঝোঁপের কাছে আসতেই শব্দ শুনে ও একটু কান সজাগ করে একটা গাছের থেকে উঁকি দিলো। দেখল- রাজকীয় পোশাক পরে সিংহাসনে বসে আছে একটা গাধা। সামনে হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে আছে শীর্ণকায় একটা মানুষ। আর কোট-টাই পরা একটা কুকুর কুর্নিশের ভঙিতে ওদের ভাষায় আরজি জানাচ্ছে, হুজুর ঐ সংখ্যালঘু মানুষের বাচ্চারা এখনো আমাদের ‘কুকুরের বাচ্চা’ ‘গাধার বাচ্চা’ বলে গালি দেয়। ওরা সংখ্যায় কমে গেলেও ওদের সাহস এখনো কমেনি; সেই সাথে পুরনো অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারেনি। এর একটা বিহিত করুন হুজুর?
গাধা ঘাড় নেড়ে গাম্ভীর্যের চালে বলল, কঠি ছেআ।
এরপর গাধার হুকুমে শীর্ণকায় মানুষটিকে দশবার নাক ধরে উঠবস করানো হলো এবং কুকুরকে পাঁচবার লেজ ধরে উঠবস করানো হলো।
স্বনন দেখল এদের সব কিছুই কেমন যেন উল্টো উল্টো। তাহলে এদের কথাগুলোও তো উল্টো হতে পারে? তাই সে গাধার কথাটিকে উল্টো করে বিশ্লেষণ করল। ‘কঠি ছেআ’ মানে ‘ঠিক আছে”। এই তো পেয়ে গেছি! তাহলে ঐ বলদের কথাগুলোরও তো মানে করা যায়- ‘তেতা রমাতো কি?’ অর্থাৎ ‘তাতে তোমার কি?’সেই মানুষটি ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। স্বনন ওদের ভাষায় বলল, যেই এ ইভা ননুশু।
ওর কথায় মানুষটি থমকে দাঁড়াল। অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখল স্বননকে। নিজের দিকে তাকাল একবার আরেকবার স্বননের দিকে। চেহারায় হুবহু মিল আছে। পার্থক্য শুধু এই অচেনা মানুষটির সুন্দর চাকচিক্য পোশাক রয়েছে আর ওর তা নেই।
স্বননের তখন ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছিল। ও মানুষটিকে চুপ থাকতে দেখে ওদের ভাষায় বলল, এতরাতে কিছু খাবার পাই কোথায় বলুন তো?
ওর কথা শুনে মানুষটি হেসে ফেলল। বলল, রাত কোথায়? এখন তো দিন। একটু পরেই সাঁঝ নেমে আসবে; তখন আমরা ঘুমাবো।
স্বনন মনে মনে বলল, ঠিকই তো! এদের সবই তো আমাদের দেশের উল্টো। প্রকাশ্যে বলল, তাহলে খাবার..
– ঠিক আছে। আমার বাসায় চলুন।
স্বনন শীর্ণকায় মানুষটির পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। অনেক ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে শীর্ণকায় মানুষটি একটা খুপরি ঘরের ভেতর স্বননকে বসাল। ওকে বসিয়ে রেখে মানুষটি অন্য একটি ঘরে ঢুকল। একটু পরে একটা কচুপাতায় করে কিছু নোংরা উচ্ছিষ্ট খাবার, মৃত পশুর দুর্গন্ধ মাংস ও কিছু ঘাস আর বিচালি নিয়ে এলো। এগুলো ওর সামনে দিয়ে বলল, খাও।
ওগুলো দেখেই স্বননের কেমন বমি বমি লাগছিল। ও বলল, না, এগুলো আমি খেতে পারব না।
কিন্তু মানুষটি নাছোড়। সে চোখ লাল করে বলল, খাও। নইলে আমি তোমাকে এগুলো জোর করে খাইয়ে দেবো।
স্বনন চোখ বুজে জোরে চিৎকার দিলো, না, আমি এগুলো কক্ষনো খাব না।
– কিরে, ওমন চিৎকার করছিস ক্যানো?
মায়ের হাতের স্পর্শে স্বননের ঘুম ভেঙে যায়। দেখে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আজ বিকেলেই তো প্লেনে উঠবি। সকাল সকাল সব কিছু গুছিয়ে নে।