হাজার ব্যস্ততার মাঝেও একটু মন চায় কোথাও থেকে ঘুরে আসতে। আসলে শহরে থাকলে মনটা কেমন যেন দূষিত হয়ে যায়। মনে হয় শরীরের মধ্যে মাকড়সার বাসা বেঁধেছে। এটা ছাড়ানোর কোনো উপায় থাকে না। তারপরও বাধ্য হয়েই এখানে পড়ে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে মনের ইচ্ছা জাগে ঘন গাছপালা, নদী, পাহাড় এসব জায়গা থেকে ঘুরে আসতে। কিন্তু সময় ও সুযোগ কোনোটাই হয়ে ওঠে না।
সামনে যেহেতু ঈদ। সেহেতু একটা চান্স নেয়াই যায়। আর ভালো লাগছে না আমার। মনটা কেমন ছটফট করছে। আমি নিজেও এর কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে কবে ঈদ আসবে আর কবে আমার খাঁচা থেকে বের হবো। আসলে ঢাকার বাসা বাড়িগুলো এমন অবস্থা যে কোনো খোলামেলা জায়গা নেই। যেখানে একটু প্রশান্তির বাতাস পাবো। একটু মন ভরে নিঃশ্বাস নেবো।
ঈদের দিন এলো। কিন্তু আগের মত সেই মজাটা নেই। কেমন যেন পানসে হয়ে গেছে। আগের মতো আর ভালো লাগে না। বাসায় আম্মু আর আব্বুজানকে বললাম আমি আজকে বাড়িতে যাবো। এক দু’কথায় রাজি হয়েও গেল। কিন্তু মনে হলো যেন তাঁরা সম্মতি দিচ্ছে না। কিন্তু এদিকে তো আমিও আর পারছি না। হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই পারমিশন দিয়েছে। যথারীতি রাত ৮টায় গাড়িতে ওঠার জন্য বাসা থেকে বের হলাম। মনের মধ্যে দোল খাচ্ছে কি মজা খাঁচামুক্ত হলাম অনেক দিন পর। ভাবতেই অনেক ভালো লাগছে।
কাউন্টারে যেয়ে বসে পড়লাম। অপেক্ষায় প্রহর গুনছি কখন গাড়ি আসবে। ঈদের দিন দেখে রাস্তায় সব দোকান বন্ধ। শুধু বাসের কাউন্টার খোলা আছে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এলো। গাড়িতে উঠেই আমার ছিটে বসে পড়লাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ি চলছে। ড্রাইভার রাস্তা খালি পেয়ে ইচ্ছে মতো টানছে। একদিকে যেমন ভালো লাগছে তেমন আবার ভয়ও হচ্ছে।
আমি হিসাব কষতে বসলাম। গাড়ি ছাড়লো রাত ৯টায়। তাহলে আমি পৌঁছাবো ভোর ৫টায়। তখন যেকোনো গাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে পারবো। কিন্তু আমার ধারণা একদম ভুল ছিলো। রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় আর জ্যাম না থাকার কারণে রাত আড়াইটায় আমাকে ঝিকরগাছায় নামিয়ে দিল। তখন নেমে চারিদিকে খুব ভালো করে তাকালাম। দেখলাম রাস্তায় তিনজন গার্ড ছাড়া আর কেউ নেই। আমার গা-টা কেমন যেন ছম ছম করতে লাগলো। কিন্তু এতো রাতে আমি কোনো বাহন পাবো না। তাহলে এই তিন ঘণ্টা আমি কোথায় থাকবো!
মাথার মধ্যে যেন কোনো প্ল্যান আসছে না। কিছুক্ষণ পর কিছু টহল পুলিশ এসে বললো, আপনি কোথা থেকে এসেছেন। আমি বললাম ঢাকা থেকে। আমাকে বললো কোথায় যাবেন! আমি বললাম বাঁকড়া। তারা আর কিছু না জিজ্ঞেস করে চলে গেলো। রাস্তার পাশে একা বসে আছি। কেউ নেই।
কিছুক্ষণ পর একটা গার্ড এসে আমার মুখে লাইট মেরে বললো এখানে বসা যাবে না! আমি একটু হতভম্ব হয়ে বললাম কেন? কোনো সমস্যা আছে নাকি। তিনি বললেন এটা ব্যাংক এখানে বসা যাবে না। সামনে যেয়ে বসুন। আমি অসহায়ের মত সেখান থেকে উঠে গেলাম। আর চিন্তা করতে লাগলাম কী করা যায়। এখান থেকে বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা অনেক দূরে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে লাগলাম। খানিকটা বাদেই একজন লোক এসে বললো, আপনি কোথায় যাবেন। আমি প্রথমে না শোনার ভান করলাম। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন আমি মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালাই। আপনি কোথায় যাবেন আমাকে বলুন। আমি আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। প্রথমে আমি রাজি না হলেও পরে চিন্তা করে দেখলাম যা হওয়ার তা হবেই। একটা রিক্স নিয়ে নেই। জীবনে চলার পথে কতই না বিপদ-আপদে পড়ে থাকি। এটা আর এমন কী।
এবার ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি চললো কিছুক্ষণ। ৫০ টাকার জায়গায় ৩০০ টাকা দিয়ে তার মোটরসাইকেলে উঠে পড়লাম আল্লাহর নাম নিয়ে।
যাচ্ছি তো যাচ্ছি, পথ তো শেষ হচ্ছে না। গা ছম ছম করছে। কোনো বিপদ হবে নাতো। আর বিপদ হলেও কিছু করার নেই। আবার ভাবছি আমার কাছে ভাঙাচোরা মোবাইল, অল্প কিছু টাকা আর জামা কাপড় ছাড়া তো কিছুই নেই। যদি আমার কাছ থেকে এগুলো নিয়ে নেয় তাহলে তিনি তো ঠকেই যাবেন। এগুলো বিক্রি করলে তার ৫০০ টাকা আসবে না। সেসব চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিলাম। আমার মনে কোনো দুশ্চিন্তাও আর রাখলাম না। বরং খুব ভালো লাগছে। এরকম অ্যাডভেঞ্চার কখনো করিনি। চারিদিকে ঘন অন্ধকার। দুই পাশে মাঠ আছে না বন-জঙ্গলে ভরপুর কিছুই বুঝতে পারছি না। রাস্তায় শুধু আমি আর ড্রাইভার। তিনি চলছেন আর গল্প করছেন। আমিও তার সাথে গল্পে মেতে গেলাম। গল্প করতে করতে কখন যে আমার এলাকায় চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।
আমার দাদার বাড়ি যাওয়ার আগে বাঁকড়া বাজার পড়ে। তিনি আমাকে বাজারে নামিয়ে দিয়ে বলেন, আমি আর সামনে যাবো না! আমি একটু চমকে উঠি। বাড়ি পর্যন্ত কনটাক্ট করলাম এখন আপনি এ কথা কেন বলছেন। তিনি জবাবে বললেন, সামনের রাস্তায় সমস্যা আছে। আমি বললাম কি সমস্যা। তিনি বললেন বাপু তোমায় বললে তো তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় পাবে। আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, আমি ভয় পাই না। তিনি বললেন আমি যেতে পারবো না। আমাকে টাকা দিয়ে দাও আমি চলে যাচ্ছি।
কী আর করা। আমি তাকে টাকা দিলাম। তিনি চলে যাওয়ার সময় আমাকে একটা গ্যাস লাইট দিয়ে দিলেন, বললেন এ পথে যাওয়ার সময় লাইটারটা জ্বালিয়ে তারপর হাঁটা দেও। এ কথা শুনেই আমি বুঝতে পারলাম আমার সাথে কি হতে চলেছে। আল্লাহর নাম নিয়ে আমি হাঁটা দিলাম আমার ভারী ব্যাগটা নিয়ে। প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। কিভাবে যাবো সেই চিন্তায় বাঁচি না। তারপরও বিসমিল্লাহ বলে হাঁটছি আর আগুন জ¦ালিয়ে রেখেছি। যতই বলি ভয় পাই না ততই ভয় আমার কাছে এসে বলছে কিরে ভয় পাচ্ছিস নাকি!
কিছুদূর যেতে না যেতেই ধপাস ধপাস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো মানুষ পুকুরে ঝাঁপ দিচ্ছে। আমার ভয়টা আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কোনো দিকে আমি তাকাচ্ছি না। শুধু চিন্তা করছি কখন ফজরের আজান দেবে। এইভাবে চলতে চলতে সামনে দেখলাম মানুষ আকৃতির কিছু দেখতে পাচ্ছি। ওদিকে না তাকিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি। আর এদিকে আমি লাইটার এক নাগাড়ে জ¦ালিয়ে রাখার কারণে আমার আঙুল পুড়ে গেছে। সেদিকে আমার কোনো হুঁশ নেই। শুধু চিন্তা কখন বাড়ি পৌঁছাবো।
কিছুদূর যেতে না যেতেই আবার সেই একই শব্দ। কোনো দিকে কান না দিয়ে এক নাগাড়ে হাঁটা শুরু করলাম। মোবাইলে চার্জও কমে যাচ্ছে। আল্লাহ আল্লাহ করে ঘরে ঢুকতে পারলে হয়। একটু পরে শুনতে পেলাম ফজরের আজান দিচ্ছে। যাক মনের ভয়টা একটু হলেও কেটেছে। হাঁটতে হাঁটতে পা দুটো ব্যথা হয়ে গেছে। অল্প কিছুদূর আছে বাড়িতে পৌঁছানোর। আল্লাহর রহমতে পৌঁছিয়ে গেলাম। যেয়ে দেখি উঠোনে একটা খাট বিছানো আছে। আমার ক্লান্তিটা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। বুকের ভেতর ধুপ ধুপ করে এখনও আওয়াজ হচ্ছে। বসে না থেকে হাত মুখ ধুয়ে সেই ময়লা খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি আমার খেয়াল নেই। হঠাৎ ভরা কণ্ঠে একটা আওয়াজ কানের কাছে ভেসে আসছে। আওয়াজটা হলো এরকমÑ ‘এ কিডারে, কিডা তুই! এ ছ্যামরা কথা বলিস নে ক্যান। বাড়ি কনে, এখানে কি করতে আইছিস। নাহিদ নাই তুই কনতে আসলিরে ভাই!’
এই শুনে আমার একটু ভয় লাগলো মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি সেই ধপাস ধপাস আওয়াজের। চোখ দুটো মেলতেই দেখি দাদীআপু আমার দিকে তাকিয়ে আছে ফ্যাল ফ্যাল করে। আমি সাথে সাথে উঠে দাদীআপুকে লম্বা সালাম দিলাম। আর বললাম ঈদ মোবারক। দাদী আমার দিকে তাকিয়ে হাউ মাউ করে চিল্লায়ে উঠলো। বলে উঠলো হায় হায় তুই কখন আসলি। বাড়ির সবাইকে ডেকে উঠালো। আমি তো হতবাক হয়ে গেলাম। আমি আসছি এতেই কি দাদী এমনটি করছে। নাকি ভয় পেয়ে সবাইকে ডেকে উঠাচ্ছে। আমি দাদী আপুর হাত ধরে খাটে বসালাম। বললাম শান্ত হন। আমি তো এখনই চলে যাচ্ছি না। এমন সময় দেখলাম আমার ছোট ফুফু চোখ ডলতে ডলতে আমার দাদী আপুকে বলছে ‘কিরে মা তুমি এতো জোরে চিল্লাচ্ছো কেন?
কি হইছে কি তোমার! আমি ফুফুর কাছে যেয়ে সালাম দিলাম আর ঈদ মোবারক জানালাম। ফুফু ঘুমের ঘুরে স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখে পানি দিয়ে বললো নাহিদ তো ঢাকায়। আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি। কিছুক্ষণ পর ফুফুকে যখন একটু আলতো করে ঝাঁকি দিলাম তখন অবাক হয়ে গেল। বললো তুই কনতে আসলি কখন আসলি। মোটামুটি এবারের ঈদটা আমার ভালোই কাটলো। সবাইকে কেমন চমকিয়ে দিলাম। আমিও বেশ মজাই পেলাম।
চাচাজানরা, দাদী আপু, চাচীরা, জামাই, ফুফু, ভাই-বোনেরা সবাই আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন ভিন গ্রহের কেউ একজন বসে আছে। নিজেকে একটু বড় বলে মনে হলো কিছুক্ষণের জন্য।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে না করতেই আব্বাজান আমাকে ফোন দিলেন আমি বাড়ি পৌঁছিয়ে গেছি কি না। আমি বললাম, হ্যাঁ সুস্থভাবেই পৌঁছিয়ে গেছি। আমাকে বললেন, কখন পৌঁছালে। আমি তখন আমতা আমতা করলাম। আব্বাজান এসব ক্ষেত্রে একটু ভয় পান। আমি আমার সাহসের কথা আর বললাম না। কোনো মতে ফোনটা রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমার চাচা আর দাদী আপুর কাছে শুনতে পেল এই ঘটনা। আব্বাজান আমাকে সাথে সাথে ফোন দিয়ে বললেন, যদি কোন সমস্যা হতো তাহলে কী করতে। আমি বললাম সমস্যা, দুর্ঘটনা সব তো আল্লাহ পাকই নির্ধারণ করেন। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেই আমি এই কাজটি করেছি। তখন আব্বাজান আর কিছু বললেন না।
তারপর তো বেশ কয়দিন খুব আনন্দেই কাটালাম। খাঁচামুক্ত পাখি উড়াল দিলাম ফসল ভরা মাঠে, কপোতাক্ষের বাঁকে, কচুর বিলে আরও কত জায়গায়। কিন্তু বৃষ্টিতে খুব বেশি ঘুরতে পারিনি। তারপরও যা ঘুরেছি তাতে এক বছর না গেলেও চলবে। তবে প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ না থাকলে কোনো মানুষই বাঁচতে পারে না।
আসার দিন খুব মনটা খারাপ হয়ে গেল। আবার সেই খাঁচার ভেতর চলে যেতে হবে। সেই খাঁচার ভেতর দিন-রাত থাকতে হবে এই ভেবে। আমার খাঁচাটা যদি আর একটু বড় হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। এসব চিন্তা করতে করতেই ঘরের পাখি ঘরেই ঢুকে পড়লো সেই ছোট্ট খাঁচার ভেতর।
Share.