“বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের লাল-কুকুরে
সে কি বাস্ করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি
ও বাবা, মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে!”
বন্ধুরা, কেমন লাগছে ‘লিচু চোর’ এর কাহিনী পড়তে? তোমরা কি জান এ ছড়া-কবিতাটি কার লেখা? জানবে না কেন? এ তো তোমাদেরই প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের, যিনি প্রতিদিন তোমাদের সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেন-
‘ভোর হলো দোর খোল
খুকুমণি ওঠরে,
ওই ডাকে জুঁই শাখে
ফুল খুকি ছোটরে’ বলে।
শুধু তাই নয়, তিনি নিজেই তো সকাল বেলার পাখি! তিনি বলেছেন-
‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি।
সূর্য্যমিামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে
হয়নি সকাল ঘুমো এখন- মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি-আলসে মেয়ে, ঘুমিয়ে তুমি থাকো
হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে নাকো?
আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।’’

কী চমৎকার এই কবিতাটি! কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। তিনি সবার জন্যই কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন। বিশেষ করে মানবতার জন্য লেখা তাঁর কবিতা ও গানগুলোর কোনো তুলনা-ই হয় না। তিনি গেয়েছেন সাম্যের জয়গান। তোমরা হয়তো জানো, নজরুলকে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলেও ডাকা হয়। আসলেই তাই। কাজী নজরুল ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে কারাবরণ পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি তোমাদের কথা, মানে ছোট্ট সোনামণিদের কথা ভুলে যাননি। ভুলতে পারেননি শিশু-কিশোরদের মানসিক চাহিদার কথা। তাইতো তিনি লিখেছেন-
‘‘আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হতো খোকা,
না হলে তার নামতা পড়া মারতাম মাথায় টোকা।
রোজ যদি হতো রবিবার
কী মজাটাই হতো যে আমার
কেবল ছুটি! থাকতো নাকো নামতা লেখা জোখা
থাকতো নাকো যুক্ত অক্ষর, অঙ্কে ধরতো পোকা।’’

কাজী নজরুল ইসলাম কোথা থেকে এসেছেন? আমরাই বা কোথা থেকে এলাম? আগে ছিলাম কোথায়? এমন প্রশ্ন তিনি করেছিলেন তাঁর মাকে এভাবে-
‘মা গো! আমায় বল্তে পারিস কোথায় ছিলাম আমিÑ
কোন্ নাÑজানা দেশ থেকে তোর কোলে এলাম নামি’?

শৈশবে মা বা বৃদ্ধ দাদুর মুখে গল্প কে না শুনেছে। যখন ছোট্ট শিশুটি কাঁদে তখন মা বা দাদু কোলের ওপর মাথা রেখে পা দুলতে দুলতে ছড়া কাটে। সে ছড়ার মধ্যে থাকে কতো রাজা বাদশার কাহিনী। থাকে কল্পলোকের গল্প কথা। এসব শুনতে শুনতে এক সময় শিশুটি ঘুমিয়ে যায়।
‘‘ঘুমÑপাড়ানি মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো
বাটা ভরে পান দেবো গাল ভরে খেয়ো
ঘুম আয় রে, ঘুম আয় ঘুম।’’

কাজী নজরুলের স্কুলের বাঁধাধরা নিয়মের প্রতি বড় একটা শ্রদ্ধা ছিল না। স্কুলের বন্দিজীবন তাঁকে অসহিষ্ণু করে তুলতো। তিনি অনুভব করতেন, শিশুর মুক্ত মন ও স্কুলের গন্ডিবদ্ধ জীবনে বন্দি হতে চায় না। তার সাধ প্রজাপতির মতো হেসে-খেলে-নেচে অবাধে বিচরণ করবে-
“মোর মন যেতে চায় না পাঠশালাতে,
প্রজাপতি!
তুমি নিয়ে যাও সাথি করে তোমার সাথে।
তুমি হাওয়ায় নেচে নেচে যাও,
তোমার মত মোরে আনন্দ দাও।”

শিশুমন স্কুলে যেতে চায় না, এর অন্যতম কারণ শিক্ষক-ভীতি; এবং এ বিষয়টিও তিনি চমৎকারভাবে লিখেছেন:
“সেথায় আবার থাকে
এক যে জুজু, গুরুমশাই বলে তাকে
নাকের ডগায় চশমা তাঁহার, মাথার ডগায় টিকি
হাতের ডগায় কঞ্চি বাঁশের, তাই দেখি আর লিখি।”

গ্রামবাংলায় বিকেল হলে কেমন সৌন্দর্য বিকশিত করে ঝিঙে ফুল? শিশু-কিশোরদের জন্য কবির ‘ঝিঙেফুল’ কবিতায় আপন স্বকীয়তায় শিশুমনের দৃষ্টিভঙ্গি আঁকা হয়েছে এভাবে-
“ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ঝিঙে ফুল
ঝিঙে ফুল
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল
ঝিঙেফুল।
প্রজাপতি ডেকে যায়
বোঁটা ছিঁড়ে চলে আয়
আসমানের তারা চায়
চলে আয় এ আকুল
ঝিঙেফুল।”

আসলে কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিশু-কিশোরদের খুবই ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন ছোটদের বন্ধু। না হলে কিভাবে তিনি ছোটদের জন্য এত মজার মজার কবিতা লিখতে পারলেন? একেবারে শিশুদের মনের কথাটাই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি তাঁর ‘খুকু ও কাঠবিড়ালি’ কবিতায়।
“কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি, পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়মুড়ি খাও? দুধভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?”

অনন্য অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ। কবির পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং ¯েœহময়ী মা ছিলেন জাহেদা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর পর চার ভাইয়ের মৃত্যুর পর জন্ম হয় কাজী নজরুল ইসলামের। দুঃখের পরে জন্ম বলে তাঁর আরেক নাম ‘দুখু মিয়া’। মাত্র আট বছর বয়সে ১৩১৪ বাংলায় কবি নজরুল পিতাকে হারান আর ¯েœহময়ী মাকে হারান ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে। ১৩১৬ বাংলায় নি¤œ প্রাথমিক পরীক্ষায় পাসের পর উক্ত মক্তবে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে নতুন জীবন শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই যোগ দেন লেটোর গানের দলে। স্ফুরণ ঘটে কাব্য প্রতিভার। শিশুদের ভালোবাসার অনুরাগে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
“পার হয়ে কত নদী, কত যে সাগর
এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর।
কোন রূপ লোকে ছিলি রূপকথা তুই
রূপ ধরে এলি এই মমতার ভূঁই।
কালো দিয়ে করি তোর আলো উজ্জ্বল
কপালেতে টিপ দিয়ে নয়নে কাজল।”

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় ইসলামী গান-কবিতার জগতে শীর্ষ স্থানটি দখল করে আছেন। তাঁর লেখা ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি ছাড়া এখনও কি আমরা ঈদ উদযাপন করতে পারি? কবি নজরুল বলেছিলেন-
“থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে…’’।
তিনি ঘুরতেই তো চেয়েছিলেন এবং ঘুরেছেনও। তবে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধির আক্রমণে তাঁর সাহিত্য সাধনায় ছেদ পড়ে এবং তিনি দীর্ঘদিন বাকশক্তি রহিত অবস্থায় জীবন যাপন করেন। বাংলাদশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ ঈসায়ী সালে কবিকে বাংলাদেশে এনে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তিনি হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। ১৯৭৬ ঈসায়ী সনের ২৯ আগস্ট কবি পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি জমান ওপারের ভুবনে। কবি লিখেছিলেন- ‘মসজিদের ওই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’ তাঁর কথামতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।

Share.

মন্তব্য করুন