এক রাতে আবির আর তার মামা তানিম বাসার ছাদের ওপর বসে গল্প করছিল। আকাশ খুবই পরিষ্কার। অবশ্য আবিরের মামা একজন বিজ্ঞানের ছাত্র। আবির আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মামা চন্দ্রপৃষ্ঠে সর্বপ্রথম মনুষ্যবাহী অবতরণকারী মহাকাশযান এপোলো-১১। চন্দ্রপৃষ্ঠে সর্বপ্রথম পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। মামা! একটি মহাকাশ যাত্রা কিভাবে সুসম্পন্ন হয়?
মামা : এই প্রশ্ন! এই পর্যন্ত মহাকাশে যারা গেছেন, তারা মাত্র কয়েকজন ভাগ্যবান। তবে এমনটি বেশি দিন থাকবে না। তুমি যখন বড় হবে তখন আরো অনেকে মহাকাশে যাবে, নিয়মিতই যাবে। হয়তোবা তুমিও সেদিন মহাকাশে পাড়ি দেবে নানান কাজে। এমনকি দিনের শুরু হিসেবে মহাকাশে একটা পাকাপোক্ত ল্যাবরেটরি বানাবার কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ল্যাবরেটরি মহাকাশে থাকবে আর পৃথিবী থেকে নানান বিজ্ঞানী দরকার মতো সেখানে গিয়ে কিছুদিন থেকে কাজ করবেন আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। যেমন করে দেশের বিজ্ঞানীরা বিদেশের ল্যাবরেটরিতে কিছুদিন কাটিয়ে আসেন, অনেকটা তেমনি। একদিন যেহেতু যেতেই পার তাহলে মহাকাশ যাত্রা কিভাবে সম্পন্ন হয় সেটা তো জেনে রাখতে হবে।
আবির : হ্যাঁ, মামা। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন যে আমি একদিন মহাকাশে যাবো।
মামা : হয়তো সে স্বপ্ন পূরণ হবেই। আচ্ছা আগে জেনে নিই কিভাবে যাত্রা সম্পন্ন হয়। তোমার যাত্রা শুরু হবে এক ধরনের ফেরি রকেটে। পুরো সফরের তুলনায় এটা তোমাকে নিয়ে যাবে সামান্য পথ পৃথিবী থেকে কাছেই একটা মহাকাশ স্টেশনে। স্টেশনটা পৃথিবীর চারদিকে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, যেমন চাঁদের মতো। তবে ফেরি রকেটটি অবশ্য খুব শক্তিশালী হতে হবে। পৃথিবীর টানটুকু কাটানো চাই। এতে এসে বসতেই সিটের সাথে বেল্ট দিয়ে তোমাকে ভালোভাবে বাঁধা হবে যাতে কিছুতেই না ছিটকিয়ে যেতে পারো। এবার রকেটের দরজা বন্ধ হতেই মহা গর্জনে প্রচ- বেগে ওপরে ওঠার পালা। ওঠার শক্তিটা এত বেশি হবে যে, তা তোমাকে সিটের মধ্যে একদম চেপে রাখতে চাইবে। অবশ্য রকেটের বেগ একবার বেড়ে যাবার পর তেমন খারাপ লাগবে না। মহাকাশ স্টেশনের কাছাকাছি এলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বেশ মজার জিনিস দেখবে। চিনতে মোটেই ভুল হবে না। ওই বিরাট বলের মতো জিনিসটা নীল-সবুজ রঙের বলটিই তো আমাদের পৃথিবী। মহাদেশ আর মহাসাগরগুলো সেখানে বেশ আলাদা চোখে পড়বে। তবে বাংলাদেশ দেখাটা কষ্টকর হবে। হয়তোবা ছোটখাটো টেলিস্কোপও লেগে যেতে পারে। অবশ্য দেখার মধ্যে মেঘগুলো কিছু গোলমাল করতে পারে।
ঘাটে লঞ্চ ভিড়াবার মতোই একটু কায়দা কসরত করে তোমার ফেরি রকেটটি গিয়ে লাগবে মহাকাশ স্টেশনের সাথে। তুমি যদি আরো দূরের যাত্রী হও তবে স্টেশনে তোমাকে অন্য একটি যান বদলাতে হবে। চড়তে হবে আরো একটা বড় মহাকাশ যানে। কত বড় হবে সেই মহাকাশ যান? তা নির্ভর করবে কত দূরে তুমি যাচ্ছো তার ওপর। যদি কাছেই চাঁদে যেতে হয় তাহলে মহাকাশ যানটি ছোটই হবে। তবে মঙ্গল যদি হয় তোমার গন্তব্য তাহলে মহাকাশ যানটি হতে হবে যথেষ্ট বড়।
যেখানে যাও মহাকাশ স্টেশন থেকে যাত্রা করার সময় আগুনের ছটা ছাড়া আর কিছুই হবে না। যেমনটি হয়েছিল পৃথিবী ছাড়ার সময়। কারণ পৃথিবীর মতো বিরাট টানটুকু না থাকতে ওটা কাটাবার ঝামেলাও নেই। তাই অনায়াসে প্রচ- গতিতে পৌঁছে যাবে তোমার মহাকাশযান হয়তোবা ঘণ্টায় কয়েক লাখ মাইল বেগে। তুমি অবশ্য এই প্রচ- বেগের কিছুই টের পাবে না। শুধু বেগ বাড়া আর কমার সময়টি একটু টের পাবে। অবাক হচ্ছো! অবাক হবার কিছুই নেই। আমাদের পৃথিবী যে আমাদেরকে নিয়ে প্রচ- বেগে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে তা কি আমরা টের পাই নাকি? এবার মহাকাশযানের ভেতরে তোমার ক্যাবিনের অবস্থা একটু দেখা যাক। যদিও বাইরে জোরালো মহাকাশযানের ইঞ্জিন চলছে তার শব্দ কিন্তু তোমার কানে আসবে না। কারণ ওখানে শব্দ বয়ে আনার বাতাস যে নেই। শুধু মহাকাশযানের ভেতরের ছোটখাটো যন্ত্রগুলোর শব্দই তুমি কানে টের পাবে। ওখানে একটা বড় অসুবিধা বোধ করবে তা হলো তোমার ওজন বলতে কিছু থাকবে না। সিটের বেল্ট থেকে নিজেকে খুলে দিলেই দেখবে তুমি পালকের মতো ভাসতে চাইছো। একটু ধাক্কা খেলে তো চলে যাবে ক্যাবিনের ছাদের দিকে, কি দেয়ালের দিকে, খেলে আরেকটা ধাক্কা। বড় বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা ওটা। বিশেষ ধরনের জুতো তোমাকে পরতে হবে হাঁটার জন্য। চুম্বকের টানে হয়তো জুতোটা মেঝের সাথে লেগে থাকতে চাইবে। অথবা চটচটে কোন আঠার টানে লেগে থাকবে। খাবার-দাবারের কী হবে? হ্যাঁ বিমানে ভ্রমণের সময় যেমন ট্রেতে খাবার তোমার সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ওখানে কিন্তু তেমনটি হবার জো নেই। তাহলে খাবারগুলো ট্রে থেকে ওঠে এদিক ওদিক চলে যাবার আশঙ্কা আছে। এমনকি পানিও গ্লাসে থাকার নিশ্চয়তা নেই। তুমি তো আর সারা ঘর তড়িয়ে বেড়িয়ে খাবার খেতে চাইবে না। তাই বিশেষভাবে তৈরি খাবার টুথপেস্টের টিউবের মতো জিনিসের মধ্যে পরিবেশন করা হবে। ওটা টিপে টিপে খাবার বের করে তারপর তুমি মুখে পুরবে। কিংবা পকেটে থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে মুখে পুরবে। খাবার ব্যাপারটা না হয় মানা গেল। আরো একটা অসুবিধার ব্যাপার ঘটবে কিছু একটা ঘোরাতে গেলে। যেমন ধরো দরজার হাতলটা ডান দিকে ঘোরাতে চাইলে আর অমনি ওর প্রতিক্রিয়ায় তোমার পুরো শরীরটা বাম দিকে ঘুরতে শুরু করে দিল যেমনটা চাকার মতো। তোমাকে খাড়া রাখার জন্য ওখানে পৃথিবীর টান নেই। ওই চটচটা জুতো ছাড়া তোমার কোনো গতি নেই। এতোসব হাঙ্গামার মধ্যেই তোমাকে মহাকাশযানে কাটানোর অভ্যাস করে নিতে হবে। গন্তব্য সন্ধানে এই মহাকাশযান সরাসরি পৌঁছে দেবে না। মঙ্গলের কাছাকাছি যখন পৌঁছে যাবে তখন তোমাকে আবার মহাকাশযান বদল করে আরেকটা ফেরি রকেট ধরতে হবে। এই বদলা-বদলির জন্য ওখানেও আছে একটা মহাকাশ স্টেশন। ফেরি রকেট তোমাকে নিয়ে আস্তে গিয়ে নামবে চাঁদের বুকে কিংবা গ্রহের বুকে কোন এক নির্দিষ্ট স্থানে। ওই জায়গায় তখন হয়তো থাকবে কিছু মানুষের বসত। অন্তত কিছু বিজ্ঞানীর বসতি তো আছেই। অদ্ভুত এই সফরের পর ওখানে শুরু হবে তোমার আরো বহু মজার মজার অভিজ্ঞতা। এই সফরের শেষে গিয়ে আকাশে তাকিয়ে দেখে চমকে উঠে বলবে ওই যে পৃথিবী! আমাদের পৃথিবী! পৃথিবী গ্রহটা চাঁদ থেকে পরিষ্কার করে দেখা গেলেও মঙ্গল থেকে হয়তোবা খালি চোখে দেখা না-ও যেতে পারে।
আর আসার সময় ঠিক একইভাবে আসতে হবে।
আবির : বাহ্ মামা কি দারুণ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেমন সুন্দর ভ্রমণ।
মামা : খুবই সুন্দর এবং দারুণ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
আবির : জানি না, জীবনে এই স্বপ্নটা কোনোদিন পূরণ করতে পারি কি না?
মামা : তোমার জন্য দোয়া করি যাতে তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পার।

Share.

মন্তব্য করুন