শরৎ আমাদের সবার চেনা, কারণ শরৎ যে একটা ঋতুর নাম। শরৎ অসংখ্য কবিতার নাম। শরৎ আকাশের সাদা মেঘের ভেলার নাম। শরৎ পাখপাখালির মিষ্টি কণ্ঠের গান। বিলে ঝিলে সাঁতরানো আউশের ধান।
‘ভালবাসি ফুলনদী
পাখিদের গান
বিলে ঝিলে সাঁতরানো
আউশের ধান।
ধানে ধানে গোলা ভরা
জলে ভরা খাল
শাপলা শালুক ফোটে
গাছে গাছে তাল।
ষড়ঋতুর দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতুই হলো শরৎ। আম-কাঁঠালের মিষ্টি গন্ধ শেষ হতে না হতেই তালের সদাগন্ধে ভরে যায় গাঁয়ের প্রতিটি ঘর। ভাদ্র আর আশি^ন এ দু’মাস শরৎকাল। অবশ্য ঋতু এবং মাসের এ প্রকারভেদ অন্য স্থানে প্রযোজ্য নয়। কারণ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ছয় ঋতু নেই। সেখানে তিন ঋতু। যেমনÑ ধরো রাশিয়া। সেখানে বৃষ্টি হয় শীতকালে। শীতে ওখানকার সব পানি জমে বরফ হয়ে যায়। সহজেই অনুমান করা যায় শীতকাল। সে শীত হতে বাঁচতে পাখিরা পালিয়ে যায় দূর-দূরান্তে। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসে আমাদের বাংলাদেশেও। যাদের আমরা বলি অতিথি পাখি।
বর্ষার আগে আসে গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের এ দিনে ভীষণ রকমের গরম পড়ে। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে। গ্রীষ্মকালীন ঐ নিষ্ঠুরতার দেয়াল ভেঙে স্বস্তি দিতে আসে বর্ষা। আষাঢ় দিয়েই বর্ষার শুরু। গাঁয়ের শিশু-কিশোররা আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা আনন্দ লুফে নেয়। আমিও যখন তোমাদের মতো ছোট কিশোর ছিলাম তখন বটতলার খালে কত সাঁতার কেটেছি। গাছের ওপর থেকে ভরা খালের পানিতে লাফ দিয়েছি। সাঁতার কেটেছি। ডুব দিয়েছি। ছৈলা পানিতে সাঁতার কেটে কম আনন্দ পাইনি তখন।
তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বৃষ্টির ধার। এক সময় এমন হয় সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। খাল বিল পানিতে থৈথৈ করে। মাঠঘাট সব ভরে যায় কানায় কানায়। তখন বৃষ্টি আর বৃষ্টি-
বৃষ্টি এলো বিলে ঝিলে
শ্যামল সবুজ ছোট গাঁয়
বৃষ্টি এলো খালে বিলে
রহিম মিয়ার ছোট নায়।
বৃষ্টি এলো দখিন হাওয়ায়
নতুন বধূর ভিজলো শাড়ি
বৃষ্টি এলো সাছিমপুরে
ভিজলো ছাতা রিকসা গাড়ি।
আষাঢ় মাস শেষ হয়ে শ্রাবণে কদিন পার হয়ে গেলে আকাশ আর বিলের অবস্থা পাল্টে যায়। এক শান্ত, সমাহিত ভাব নেমে আসে। তখন আকাশে সাদা সাদা ভেজা তুলার মত মেঘ ভেসে বেড়ায়। বিলের পানির ঘোলা ভাবটা কমে যায়। পানির ঢেউ কম থাকে। তখন কাশফুলে নদীর কিনারটা ভরে যায়। মৃদু বাতাসে তখন বিলের পানি কাঁপে। কাঁপে বৃদ্ধের সাদা দাড়ির মতো নদীর কিনারের কাশফুলগুলো। মনে হয় যেন চিকন হেউলি পাতার নকশি হোগলা।
ভাটার টানে যখন প্রচুর কচুরিপানা নামে। তখন আমনের রোপা রোপণ চলে। মাঠে মাঠে কৃষকের সমাগম। ভোর রাতেই গাঁয়ের কৃষকরা জালা তোলার কাজে লেগে যায়। সকাল হলে মরিচ পোড়া আর শুঁটকি ভর্তা দিয়ে পেট ভরে পান্থা ভাত খায়। তারপর কাছা দিয়ে নামে ক্ষেতে। রোপা রোপণ করতে। কোথাও কোমর পানি, কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও আরো কম। তখন কৃষকরা কচুরিপানা নামিয়ে দেয় খালে। খাল বেয়ে এসব কচুরিপানা ভেসে যায় বড় বড় বিলে, যেখানে অনেক পানি। এসব বিলে এ মৌসুমে কোন ধান লাগানো যায় না। সব বিল মাছে ভরে যায়। বিলে এত কচুরিপানা জমে যায় মনেই হয় না এটা একটা বিল। মনে হয় যেন বিশাল একটা দিঘি। কচুরিপানার বিগুনি ফুল তখন হালকা বাতাসে দুলতে থাকে। ঢেউয়ের দোলায় বাহারি সে দৃশ্য। এ সময় কিছু লোক ডিঙি নৌকা আর হেলন জাল নিয়ে নামে বিলে। কচুরিপানার নিচে সেই জাল দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরে। ধরে নানা জাতের মাছ। তখন সারা বিলে একটা মেলা মেলা ভাব জমে যায়। আমি যখন গাঁয়ে ছিলাম তখন তালের কোঁদা ভাসিয়ে লগি মেরে চলে যেতাম বিলে। রঙ্গু, কালামিয়া, আলান্যার সাথে কত মাছ ধরেছি। এসব মনে হলে এখনো মন আনন্দে নেচে ওঠে। দুপুর হলে ক্ষিদায় যখন পেট চোঁ চোঁ করতো তখন ডুলা ভর্তি মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। মা দেখে কত যে খুশি হতেন। দিনের শেষে যখন আবছা আঁধার নামতো তখন চাঁদের পাশাপাশি জোনাকি পোকাদের আলোর প্রতিযোগিতা দেখতাম, কত মজাই না লাগতো তখন।
ভাসিয়ে দিয়ে বিলের জলে নাও
গানে গানে প্রাণটা যেতো ভরে
যার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও
ওসব স্মৃতি মনটা উদাস করে।’
শ্রাবণ শেষ হতে না হতেই বাতাসে বাতাসে ভাদ্রের আগমন বার্তা আসতে থাকে। ভাদ্র মাসের দুপুর যেমন খুব আনন্দের, আবার ভেপসা গরমও। দুপুর হলে গোসল সেরে তাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেতাম। তারপর মা ঘুম পাড়িয়ে দিতেন, কিন্তু এত গরমে কি ঘুম আসে? এক দিকে ভাদ্রের গরম অন্য দিকে তালের গরমতো আছেই। এক সময় একটু ঠা-ার জন্য উত্তরপাড়ার খালের বাঁশের সাঁকোর উপরে উঠে বসে থাকতাম। আমি কালা, চান্দু, রহিম বসে বসে গল্প করতাম। তখন হালকা বাতাস শরীরে ধাক্কা দিতো। ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ভেসে আসা এই ঠা-া বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিতো ভুলে যেতাম গরমের কথা।
আবার ঝির ঝির করে বৃষ্টি এসে এক দিক থেকে অন্য দিকে চলে যেতো। গাঁয়ের লোকেরা বলতো কুত্তা দুড়াইত্যা জাড়ি আইছে। আমরা এক দৌড়ে চলে আসতাম কাচারি ঘরে। হাবি কাকু কাচারি ঘরে বসে বসে আন্তা, ছাই, হারল এসব মাছ ধরার সরঞ্জাম তৈরি করতেন, আর পুরনো দিনের কিচ্ছা বলতেন। আমরাও সারা বিকেল অবধি আড্ডায় মেতে থাকতাম। পুকুরপাড়ের তালগাছটা থেকে যখন ধপাস করে পাকা তাল পড়তো, তখন সবাই দৌড় দিতাম। প্রতিযোগিতা লেগে যেতো সবার মধ্য। কে আগে গিয়ে বগলদাবা করবে পাকা তালটি। কী আনন্দই না হতো তখন।
তখনো গাঁয়ে ভাদ্র আসে। পুকুরপাড়ের লম্বা তাল গাছটা হতে তাল পড়ে। কেউ হয়তো কুড়ায়ে নেয়। আবার কারো অজান্তে হয়তো খালের পানিতে ভেসে যায় দূর-দূরান্তে। ওসব কথা যখন মনে পড়ে তখন মনের অজান্তে হারিয়ে যাই। অচিনপুরে। মন চলে যায় পুকুরপাড়ের সেই তাল গাছটার নিচে। তাল গাছটি এখন আর আগের মত যৌবন নেই। এখন সে বৃদ্ধ।
আমি এক সময় গাঁয়ে ছিলাম। একেবারে গাঁয়ে। তখন ছিলাম আমি গেঁয়ো শিশু। আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে গাঁয়ের আলো বাতাসে। এ সময়টি ছিল আমার জীবনের মধুময় সময়। আমি বড় হয়েছি গাঁয়ের হাওয়ায়। গাঁয়ের আদরে। কিন্তু শহরে এসে এখন আর এর অনেকটা বুঝতে পারি না। এই শহরে আমি অনেক কিছুই টের পাই না। কখন আসে শরৎ, কখন চলে যায় ভাদ্র-আশি^নের বৃষ্টিমাখা দূর্বা ঘাসের হাসি। বুঝতে পারি না তাদের সদাগন্ধ। মায়ের হাতে তৈরি তালের পিঠা খেতে আর কেউ ডাকে না। গাঁয়ের রাখাল ছেলে ওমর আলী এখন আর ডাকে না জাল ক্ষেতে কাছা মেরে হাডুডু খেলতে। কারণ এ শহরেতো আর শরৎ নেই ভাদ্র নেই, নেই আশি^নের শিশিরমাখা হাসি। খালি পায়ে জড়িয়ে ধরে না শিশিরকণা। দেয় না পায়ের তালুতে কাতুকুতু।
এই শহরে মন ছোটে না প্রকৃতির কাছে। মন ছোটে না ধানের ক্ষেতে। অথচ মন খোঁজে ভাদ্রের তালের সদাগন্ধ। মন খোঁজে মায়ের হাতে অতি যতেœ তৈরি তালের পিঠা। কিন্তু তা খুঁজে পাই না। মা কখনো কলা পাতায় তাল মাখানো আটা জড়িয়ে পাটিসাপটার মতো, আবার কখনো বড় বাসনে তালের সাথে চালের গুঁড়া মিশিয়ে বড় একটা পিঠা বানিয়ে কেটে কেটে খেতে দিতেন এসব এখনো মনে পড়ে। মা ও পিঠাকে বলতেন সানকি পিঠা, কিন্তু এখন আর এসব খুঁজে পাই না।
ভোর হলে মা ঘুম থেকে ডেকে দিতেন। বলতেন তাড়াতাড়ি উঠে মক্তবে যাও। এ সময় দক্ষিণ পাড়ার মক্তবে বগুমাস্টারের ঘন্টাও বেজে উঠতো। তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধপাস করে উঠতো বগুমাস্টার একটু এদিক সেদিক হলে কঠিন শাস্তি দিতেন। একদিন মক্তবে না গেলে দশ ঘা বেত। কান মলা আর আঙুলে পেন্সিল চিপাতো আছেই। বগুমাস্টারের এক দিনের শাস্তি সারা জীবন মনে থাকবে। বিছানা ছেড়ে উঠাতেই মা বাসন ভর্তি সানকি পিঠা খেতে দিতেন। ওসব খেয়ে ঘর হতে বের হতাম। তারপর উঠান, রাস্তা পার হতেই দেখা হতো শরতের সাথে। যেতে যেতে প্রাণ ভরে উপভোগ করতাম শরৎ।
আমি তো ছিলাম গাঁয়ের কিশোর। গাঁ যে আমার মা। মুরগাঁও গ্রাম যেন আমার হৃদয়। ভালোবাসার স্থান। এজন্যই আমার বুঝতে দেরি হতো না কখন আসে ভাদ্র, কখন আসে আশি^ন। কারণ আমিতো শরৎ খুঁজতাম, নবান্ন খুঁজতাম, আমি খুঁজতাম বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র। আমি খুঁজতাম গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত।
তোমরা যারা গ্রামে থাকো, তারা ভাদ্র মাসের চিত্র দেখ। তাল পড়ার ধপাস শব্দ তোমাদের কানে ভেসে আসে। মন ভরে তালের গন্ধে। প্রাণ ভরে খেতে পারো মায়ের হাতের তৈরি তালের পিঠা। তোমরা সবাই বুঝতে পারো। কারণ গ্রামে যে প্রাণ আছে। জীবন আছে। আছে তাদের মুন্সীর সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসা ফজরের আজান ধ্বনি, আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম।
আমি যখন গাঁয়ে ছিলাম, তখন ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতাম। ক্ষেতে তখন কোমর দোলাতো সবুজ ধান। হেলে দুলে নাচনা করতো সোনালি পাট। এসব দৃশ্য দেখে মন আনন্দে নেচে উঠতো। যখন পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়তো তখন ধীরে ধীরে মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়তো আমার গাঁয়ের ওপর। আকাশের দিকে তাকালে মনে হতো সাদা সাদা মেঘ যেন পাহাড়ের মতো সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে এই বালক উঠে এসো। প্রাণটা জুড়ায়ে নাও।
এখনো যখন একা একা থাকি তখন মন উড়ে যায় দূর গাঁয়ে। মনের অজান্তে হারিয়ে যাই গাঁয়ের মেঠোপথে। গাঁয়ের বনবনানীতে শীতল বাতাস গায়ে মেখে নিতে ইচ্ছে করে। আবার কল্পনার পুকুর পাড়ের লম্বা বৃদ্ধ তাল গাছটার টসটসে লাল তাল পড়ার শব্দে চেতন ফিরে পাই।
দিনের শেষে আবছা আঁধার
যখন নামে রাত
কাশের বনে জোনাক জ¦লে
বাতাস বাড়ায় হাত।
মন চলে যায় অন্তবিহীন
দূর আকাশের গায়
একটি চাঁদের অবাক করা
লক্ষ জোছনায়।
সবাই যখন ব্যস্ত কাজে
স্বপ্নে দেখি আমি
লাল কমল আর নীল কমলে
নীরব অনুগামী।

Share.

মন্তব্য করুন