মে মাস। এক শুক্রবারের সকাল। নাশতা খাওয়া শেষ হয়েছে। লিভিং রুমে এসে বসেছে ছোট পরিবারটির সবাই। হাসান বেহজাদ, স্ত্রী শিরিন, ছেলে শেহজাদ ও মেয়ে বুশরা। টিভি চলছিল। হঠাৎই স্ক্রিনে ভেসে উঠল: জরুরি ঘোষণা। ইরানের মহামান্য প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেবেন।
টিভি স্ক্রিনে পরমুহূর্তে ভেসে উঠল জাতীয় পতাকা। বেজে উঠল ইরানের জাতীয় সঙ্গীত। তা শেষ হতেই দেখা গেল প্রেসিডেন্টকে। গম্ভীর চেহারা। সবাইকে সালাম পেশ করে তিনি বললেন: টিভির নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য আমি দুঃখিত। পর্দায় আমাকে দেখে নিশ্চয়ই আপনারা বিস্মিত হয়েছেন। এটা জানানোর জন্য আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি যে আমাদের প্রতিবেশী একটি দেশ আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। আপনারা জানেন যে কয়েক সপ্তাহ আগে তেহরানে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। দু’দেশের মধ্যে বিরোধ নিয়ে বচসার কারণে আমাদের এক নাগরিক প্রতিবেশী দেশের এক নাগরিককে হত্যা করে। এটা এক বিব্রতকর ঘটনা। আমরা কেউই তা সমর্থন করতে পারি না। এ ঘটনার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করেছি। কিন্তু এর জন্য প্রতিবেশী দেশটি আমাদের দেশকে আক্রমণ করে বসবে তা অকল্পনীয় ছিল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এ হামলার প্রথম ধাক্কায় আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে আমরা প্রতিরোধের কঠিন প্রাচীর গড়ে তুলেছি। আমাদের সশস্ত্রবাহিনী এ অন্যায় হামলার সমুচিত জবাব দেবে। আর শত্রুরা উচিত শিক্ষা পাবে বলে আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, অচিরেই আমরা বিজয়ী হবো।
টিভি আবার নিয়মিত অনুষ্ঠানে ফিরে যেতেই হাসান বলে উঠলেন-
: কি দুঃসাহস শত্রুর, আমাদের দেশের ওপর হামলা করেছে তারা! এর ফলে দেশ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আমার এখন ঘরে বসে থাকলে চলবে না। যুদ্ধে যোগ দিতে হবে।
শেহজাদের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার বয়স এখন তেরো। বালক বয়স পেরিয়ে সবে সে পা দিয়েছে কৈশোরে। এখন কিছু কিছু বিষয় বুঝতে শিখেছে সে। যুদ্ধটা যে খারাপ তা সে জানে। এদিকে টিভিতে আবার নতুন ঘোষণা এসেছে। ঘোষক বলছেন: ইরান আজ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। রণাঙ্গনে শত্রুর মোকাবেলা করছে আমাদের বীর সেনাবাহিনী। সব ইরানি জেগে উঠুন। এ মুহূর্তে সক্ষম ব্যক্তিদের কেউ ঘরে বসে থাকবেন না। সব ইরানিকে এখন ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হবে। প্রতিটি শহরে রিক্রুটিং সেন্টার খোলা হয়েছে। ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের সব তরুণ ও যুবকদের সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে নিকটস্থ রিক্রুটিং সেন্টারে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
বাবার মুখের দিকে তাকাতেই তার মনে হয়, তিনি এই ঘোষণা শুনে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ভয় পেয়ে যায় শেহজাদ। বাবা যুদ্ধে যাওয়া মানে সাংঘাতিক ব্যাপার। খারাপ কিছুও ঘটে যেতে পারে। আর তাহলে তো তাদের সর্বনাশ! কারণ, বাবাই তাদের পরিবারের প্রধান। তিনিই সব।
টিভিতে নতুন ঘোষণা শুরু হয়েছে: যুদ্ধে যোগদানকারী স্বেচ্ছাসেবকদেরকে জনপ্রতি মাসিক ১শ’ ডলার সমমানের ইরানি মুদ্রা ভাতা দেয়া হবে। এক পরিবার থেকে যতজন যোগদান করবে প্রত্যেকে আলাদা ভাতা পাবে। সকল স্বেচ্ছাসেবককে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত রণাঙ্গনে দায়িত্ব পালন করতে হবে তাদের। আগ্রহীদের তাই সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
ঘরের সবাই এ ওর দিকে তাকায়। কেউ কোনো কথা বলে না।
হাসানই প্রথম কথা বলেন-
: আমার মনে হয় আমার আর দেরি করা……
তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন শিরিন-
: না, তোমার যুদ্ধে যাওয়া হবে না। আমাদের একা রেখে কোথায় যাবে তুমি? যুদ্ধে যাওয়া মানে জীবনের বিরাট ঝুঁকি নেয়া। তাছাড়া তুমি একা নও। তোমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আছে। একটা পুরো সংসার তোমার ওপর নির্ভরশীল। তুমি না থাকলে তা কিভাবে চলবে? অতএব ভুলে যাও যুদ্ধে যোগ দেয়ার কথা।
শেহজাদ বুঝতে পারে, এ বিষয়ে বাবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিতে চাইছেন না মা। কিন্তু বাবা আবার কথা বলার চেষ্টা করেন-
: আমি বলছি কি দেশের……
এবার তীক্ষ কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন শিরিন-
: না, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। যুদ্ধে যাওয়া হবে না তোমার। কিছুতেই না। যাদের ঘর-সংসার নেই তারা যেতে পারে, তুমি পার না।
বাবা অস্থির গলায় বলেন-
: দেখ, দেশের এই সংকটের সময় আমি চুপ করে বসে থাকতে পারি না। এ মুহূর্তে আমাকে দেশের প্রয়োজন। এ দেশ আমাদের জন্মভূমি। দেশের প্রতি আমার কর্তব্য আছে। তা পালন করতে হবে।
শিরিনের আর কোনো কথা শোনা যায় না।
শেহজাদ ও বুশরা উঠে দাঁড়ায়। লিভিং রুমের সাথে বারান্দা। তার মাথায় শেহজাদের ঘর। দু’জন চলে আসে শেহজাদের ঘরে। ঘরে ঢোকার আগে বাবার কথা কানে আসে-
: তুমি যতই বাধা দাও শিরিন, যুদ্ধে আমি যাবই। আমাকে যেতেই হবে। তাতে যদি আমার মৃত্যু হয়, তবুও।
মায়ের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পায় তারা। তারা বুঝতে পারে, হাসান কোনো বাধা মানবেন না। শুনবেন না তিনি মায়ের নিষেধ। তারপর নীরবতা।
বুশরার মুখ দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে সে। বলে-
: আচ্ছা ভাইয়া, বাবা যুদ্ধে যেতে চায় কেন? তাহলে আমাদের ছেড়ে থাকতে হবে। তখন আমাদের জন্য বাবার মন কাঁদবে না?
নয় বছরের বুশরার কথার কোনো জবাব দিতে পারে না শেহজাদ।
তাদের বাড়িটি একতলা। মোট পাঁচটি ঘর নিয়ে বাড়িটা। তিনটি বেডরুম ও একটি লিভিং রুম। মেহমানদের থাকার জন্য একটি আলাদা রুম রয়েছে। দু’টি বাথরুম। কিচেনটা এক পাশে। বাড়ির সামনে ও পিছনে বেশ খানিকটা করে খোলা জায়গা। তাদের এ পাড়ার সব বাড়িতেই তাই।
শেহজাদ বইতে যুদ্ধের কথা পড়েছে। যুদ্ধ মানেই খারাপ ব্যাপার। যুদ্ধে বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল-বিদ্যু কেন্দ্র ধ্বংস হয়, বহু মানুষ জীবন হারায়। বিশেষ করে শিশুদের জীবনে যুদ্ধ ভয়াবহ অভিশাপ ডেকে আনে। বাবা এখন তাতে যোগ দিতে যাচ্ছে। তাদের সবাইকে এখন যুদ্ধাবস্থার মধ্যে বাস করতে হবে। একটি সামান্য ঘটনা ও তাতে এক ব্যক্তির মৃত্যু যুদ্ধের সৃষ্টি করেছে যাতে জড়িয়ে পড়েছে দু’দেশের কয়েক কোটি মানুষ।
বুশরা মেঝেতে বসে পড়েছে। পানি টলমল করছে তার চোখে। তাকে দেখে শেহজাদের খুব মায়া হয়। বলে-
: তুই মন খারাপ করিস নে বুশরা। দুনিয়ার নানা জায়গায় এখন যুদ্ধ হচ্ছে। সব জায়গাতেই খারাপ মানুষরা যুদ্ধ বাধায়।
: কিন্তু আমাদের এখানে কেন হবে? বাবা তো যুদ্ধে চলে যাবে। তখন আমরা বাবাকে কোথায় পাব?
শেহজাদ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে-
: বাবা কি করবে বল? আমাদের দেশটাকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে হবে না? তাই তো যুদ্ধে যেতে চাইছে বাবা। যুদ্ধ শেষ হলেই ফিরে আসবে।
হঠাৎ করে শিরিন চলে আসেন সেখানে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শেহজাদ বুঝতে পারে অনেক কেঁদেছেন তিনি। তাকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছে। শেহজাদের মনে হয়, গত বছর স্কুলে মাংকি বার থেকে পড়ে গিয়ে বুশরার হাত ভাঙার ঘটনার পর মাকে আর কখনো এত অস্থির দেখেনি সে। বুশরাকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। আদর করতে করতে বলেন-
: কেঁদো না মা, তোমার মত আমারও মন খুব খারাপ। তোমাদের বাবা একবার কোনো ব্যাপারে মন স্থির করলে তার সাথে আর কথা বলে লাভ হয় না। আমি তাকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার অনেক চেষ্টা করলাম। কোনো লাভ হলো না। তিনি আমার কথা শুনবেন না। এটা তার জেদ।
বুশরা বলে-
: সেই পাখির গোসলখানা তৈরির মত, মা?
: হ্যাঁ মা, সে রকমই।
সবাই হেসে ওঠে। মনে পড়ে হাসানের সেই ছেলেমানুষি জেদের কথা। একবার তার কি খেয়াল হলো, বাজার থেকে ডজনখানেক পায়রা কিনে আনলেন তিনি। পায়রাগুলোর থাকার জন্য রেডিমেড ঘরও এলো। কিন্তু তিনি এখানেই থেমে থাকলেন না। তারপর তার মনে হলো, পায়রাগুলোকে ভালো রাখতে হলে তাদের নিয়মিত গোসল করাতে হবে। তাই, তাদের গোসল করানোর জন্য একটা বাথটাব তৈরি করার কাজে নিজেই লেগে পড়লেন তিনি। ক’দিনের মধ্যে তা তৈরিও হয়ে গেল। কিন্তু তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন তেমনটি হলো না। পায়রাগুলো তাদের ঘর থেকে উড়ে এসে বাথটাবে গোসল করতে এলো না। কয়েকটাকে ধরে এনে তিনি এক-দু’দিন গোসল করালেন। তারপর উৎসাহ হারিয়ে যায় তার। সে বাথটাব এখন অযথা পড়ে আছে।
মাকে জিজ্ঞেস করে শেহজাদ-
: বাবা কি করছে এখন ?
: সে টেলিফোনে সবার সাথে কথা বলছে, তার যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা সবাইকে জানাচ্ছে। কিছুতেই তার এ ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছি না।
দীর্ঘশা্স ফেলেন মা। তারপর বলেন-
: তোমরা রেডি হয়ে নাও, স্কুলে যাবার সময় হয়ে গেছে।
মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বেঁকে বসে বুশরা-
: আমি স্কুলে যাব না ভাইয়া। তাহলে বাবা আমাকে ফেলে চলে যাবে।
শেহজাদ বোনকে বলে-
: স্কুলে না গেলে আম্মু রেগে যাবে। আর আমাদের না বলে বাবা যাবে না দেখিস। যা, শিগগির রেডি হয়ে নে।
তার কথায় নিজের ঘরের দিকে চলে যায় বুশরা।
বাবা-মার সাথে দেখা করে স্কুলের উদ্দেশে রওনা হয় তারা। একই স্কুলে পড়ে দু’জন, স্কুলও কাছেই।
২.
বেলা আড়াইটায় স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাসায় ফেরে শেহজাদ ও বুশরা। বাড়িতে ঢুকতেই নাকে আসে মশলাদার স্প্যাগেটির সুবাস। তাদের জন্য তৈরি করছে মা। স্প্যাগেটি তাদের দু’জনেরই ভীষণ প্রিয়। বুশরা খুশিতে লাফাতে লাফাতে ছোটে রান্নাঘরের দিকে। মায়ের গলা ভেসে আসে-
: ছেলেমেয়েরা, তোমরা স্কুলের পোশাক পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এসো।
হাত-মুখ ধুয়ে বাবাকে খুঁজে বের করে তারা। লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছিলেন তিনি। তিনজন এক সাথে খাবার টেবিলে পৌঁছে। ততক্ষণে শিরিনও হাজির।
শিরিন তাদের দিকে চেয়ে বললেন-
: তোমাদের বাবাকে অনেক বোঝালাম, কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে যুদ্ধে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। আমি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারলাম না।
দু’জন অসহায়ভাবে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে।
শিরিন বলেন-
: এখন শোনো, তোমাদের বাবাকে বিদায় জানাতে কাল বাড়িতে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের আত্মীয়রা প্রায় সবাই এ অনুষ্ঠানে আসবেন।
শেহজাদ বলেÑ
: অনেকদিন পর দেখা হবে সবার সাথে।
: হ্যাঁ, সবাইকে এক সাথে দেখতে পাওয়া বেশ আনন্দের। তার আগ পর্যন্ত তোমাদের বাবাকে নিয়ে যতটা বেশি সম্ভব সময় আমরা একত্রে কাটাতে চাই। পরশুই তিনি চলে যাবেন।
ওড়নার প্রান্ত দিয়ে চোখের পানি মোছেন শিরিন।
হাসান বেহজাদ বললেন-
: আমি যুদ্ধে যাচ্ছি বলে তোমরা কেউ খুশি নও তা আমি জানি। কিন্তু কি করবো বল! এ অবস্থায় তো আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না, তাই না?
: বাবা, তুমি আমাদের ছেড়ে যুদ্ধে যেও না। করুণ স্বরে বলে বুশরা।
হাসান একটু বিরক্ত হয়ে বুশরার দিকে তাকালেন। বোঝা গেল, তার কথার মাঝখানে বাধা দেয়া পছন্দ করেননি তিনি। শেহজাদ বাবার এ দৃষ্টি চেনে । তাই সে কোনো কথা বলল না। তিনি বলতে থাকলেন-
: এটা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটা আমার, দেশের আরো মানুষের ঘরবাড়ি-সম্পদ রক্ষা, দেশের মাটি রক্ষার ব্যাপার। আমি কি করে চুপ করে থাকি, বল? আর হ্যাঁ, আমি যুদ্ধে গেলে সরকার মাসিক একশ’ ডলার ভাতা দেবে। তা দিয়ে তোমাদের কোনো রকমে দিন চলে যাবে।
এটা ঠিক যে হাসানের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। তিনি একজন ট্রাক চালক। নিজের নয়, অন্য লোকের ট্রাক চালান। তা থেকে তার যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে যায়, তবে কোনো সঞ্চয় হয় না। শিরিন কোনো কাজ করেন না। সাধারণ গৃহিণী তিনি। শেহজাদ জানে তারা বিত্তবান নয়, তবে একেবারে গরিবও নয়। ঈদুল ফিতর ও নওরোজে তারা নতুন পোশাক পায়। বাড়িতে ভালো রান্না হয়।
শেহজাদও চাইছিল না যে বাবা যুদ্ধে যান। তিনি আহত হতে পারেন বা আরো খারাপ কিছু হতে পারে। এ খারাপ দিকটার কথা সে ভাবতে চায় না।
হাসান বললেন-
: খারাপ কিছু ঘটে যেতেও পারে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যেতে পারি। আবার সহি-সালামতে ঘরে ফিরতেও পারি। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনিই আমাদের জীবন-মরণের মালিক।
: না বাবা, তুমি যেও না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বুশরা। তারপর দৌড়ে তার ঘরের দিকে চলে যায়।
: বুশরা! বুশরা! এদিকে এসো- ডাকেন হাসান।
বুশরা চেঁচিয়ে জবাব দেয়-
: তুমি যাবে না বলো। তাহলে আসবো।
হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন- ও শিশু মাত্র। কিছুই বোঝে না। ওকে বোঝাতেও পারব না আমি।
মা রেগে গিয়ে বলেন-
: এতটুকু শিশু সেও তোমাকে যুদ্ধে যেতে দিতে চায় না। তোমার এটা বোঝা উচিত। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমি আমাদের বাড়ির হাসিখুশি পরিবেশকে বিষন্ন করে তুলেছ। আমি এত অনুরোধ করলাম, তাও তুমি শুনলে না। শোনো, আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। আর বসে থাকতে পারছি না। ঘরে যাচ্ছি আমি। একটু শুয়ে থাকতে চাই।
খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যান শিরিন। হাসান চুপ করে বসে থাকেন। শেহজাদও কোনো কথা বলে না। খানিকটা সময় পেরিয়ে যায়। অবশেষে নিজের ঘরে চলে যায় সে। বিছানায় শুয়ে পড়ে কাঁদে। বাবা তাদের ছেড়ে কোনোদিন কোথাও যাননি বা থাকেননি। কে জানে, যুদ্ধে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসবেন কিনা। বাবা নেই- এ কথা ভাবতেও পারে না সে। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে শেহজাদ।
৩.
শনিবার সকালে শেহজাদের ঘুম ভাঙে বুশরার ডাকে-
: এই ভাইয়া, ওঠ। আম্মু ডাকছে। আজকে সব লোকজন আসবে না! তাই বাড়িঘর গোছগাছ করছে মা। তোকে ডাকছে। কি যেন করতে হবে।
শেহজাদ চোখ খুলে বুশরার দিকে তাকায়। লাল জমিনে লতাপাতার সবুজ ছাপ দেয়া একটি জামা পরেছে সে। মাথার লালচে চুলগুলো পনিটেল করা। তাকে ভারি মিষ্টি দেখাচ্ছে। তার ছোট হাতটি ধরে কাছে বসায় শেহজাদ। জিজ্ঞেস করে-
: বাবা কি বাড়িতে আছে রে?
: হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেয় বুশরা। শেহজাদ বুঝতে পারে, কাল বাবার উপর সে রাগ করলেও আজ আর রাগটা নেই। ছোটরা মনে রাগ পুষে রাখতে পারে না। চট করে ভুলে যায়।
ইরানে ঝড়-বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। আবহাওয়া শুষ্ক। তাই এ সব অনুষ্ঠানে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না। সবার বসার আয়োজন করা হয়েছিল। খাবারও প্রস্তুত। আত্মীয়-স্বজনরা সব আসতে শুরু করেছেন। শেহজাদের ফুফু রুদাবা এসে গেলেন। খুব ভালো মহিলা। তিনি গাজরের হালুয়া নিয়ে এসেছেন। এটা তৈরিতে তার খুব সুনাম আছে পাড়ায়। তারপরই এলেন তাদের দাদি। তিনি এনেছেন স্যুপ। মুশকিল হচ্ছে, এর আগেও স্যুপ এনেছেন তিনি। কিন্তু তা এতই বিস্বাদ হয় যে কেউ খেতে পারে না। বয়সের কারণে তাকে কিছু বলতেও পারে না কেউ। তাই ভদ্রতার খাতিরে তা খেতে বসলেও তিনি চোখের আড়ালে যাওয়া মাত্র সেগুলো ফেলে দিয়ে বেঁচেছে তারা। আজও হয়ত সে অবস্থাই হবে- ভাবে শেহজাদ।
শেহজাদের মামা ফররুখ শাহপুর এসেছেন। তাকে দেখে তারা দু’ ভাই-বোন খুশি হয়ে ওঠে। বেশ নাম করা এক পত্রিকার সাংবাদিক। একটিই মামা তাদের। তিনি যেমন তাদের খুব ভালোবাসেন তেমনি তারাও খুব ভালোবাসে তাকে। যখনি আসেন তখনি দু’জনের জন্য, বিশেষ করে বুশরার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। ফররুখ দু’জনকে কাছে ডেকে বললেন-
: আমার গাড়িতে বুশরার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসো তো দেখি সোনামণিরা।
মামার গাড়িটা তাদের বাড়ির আঙিনায় রাখা। দু’জন দৌড় দেয় সেদিকে। দরজা খোলা রয়েছে গাড়ির। পেছনের সিটের ওপর রাখা একটি বারবি ডল। ভারি সুন্দর। দেখেই বোঝা যায় অনেক দামি। কোলে তুলে নিয়ে ফিরে আসে বুশরা। তার বয়সী আরো তিন-চারটি ছেলে-মেয়ে এসেছে। বারবি ডলটি সবাইকে দেখিয়ে সে বলে-
: আমার মামা এনেছে। খুব সুন্দর, তাই না? নিজের কথায় সমর্থন পাবার আশায় সবার দিকে তাকায় সে। শিশুর দল হাততালি দেয়। সবাই সমস্বরে বলে-
: খুব সুন্দর।
শিরিন রাগ করেন ভাইয়ের উপর-
: তুই এটা আনতে গেলি কেন? শুধু শুধু এতগুলো পয়সা খরচ করা। কাজটি ঠিক হয়নি।
বড় বোনের রেগে যাওয়া দেখে মৃদু হাসেন ফররুখ। চলে যান অন্যদিকে। ভাবেন, বুশরার জন্য তিনি যা আনেন তা ভালোবেসেই আনেন। এর জন্য যে ব্যয় হয় সেটুকু করার সামর্থ্য তার আছে। শিরিন তার একমাত্র বোন। তার বাচ্চাদের জন্য তিনি কিছু গিফট আনবেন না তা কি হয়?
সবাই খেতে বসে। শেহজাদ, শিরিন ও হাসান মেহমানদের এটা ওটা এগিয়ে দিতে থাকেন। রান্না খুব ভালো হয়েছে। তৃপ্তি করে খায় সবাই। সবার খাওয়া হয়ে গেলে তারপর বাবার সাথে খেতে বসে শেহজাদ।
খাবার পর্ব শেষ হলে লিভিং রুমে গিয়ে বসে সবাই। যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কথা চলতে থাকে। ফররুখ সবার আগে বিদায় নেন হাসানের কাছ থেকে। অফিসে জরুরি কাজ আছে তার। চলে যান তিনি।
সবাই বিদায় নিতে রাত নয়টা বেজে যায়। অনেক খাবার বেঁচে আছে। ভালোই হয়েছে। ফ্রিজারে রেখে দু’তিন দিন খাওয়া যাবে। মায়ের আর নতুন করে রান্না করতে হবে না। তাতে কিছুটা হলেও তার কষ্ট কমবে, ভাবে শেহজাদ।
দাদির স্যুপ আজ খাওয়া হয়নি। স্যুপ বোলের মধ্যে পুরোটাই রয়ে গেছে। কি করা যায়, একটুখানি ভাবেন শিরিন। তারপর শেহজাদকে বলেন-
: চট করে গিয়ে পাশের বাড়ির বাহরুজ দাদু ও আফসারী দাদিকে দিয়ে এসো স্যুপটা। তারা তোমার দাদির স্যুপ খেতে পছন্দ করেন।
শেহজাদ দেরি না করে স্যুপটা নিয়ে চলে যায়।
৪.
সকাল সাড়ে সাতটায় সামরিক ঘাঁটিতে গিয়ে হাসানকে রিপোর্ট করতে হবে। একটি ট্যাক্সি ডেকে আনলেন হাসান নিজেই। তাকে পৌঁছে দিতে সাথে গেল সবাই। মন ভারি হয়ে আছে শেহজাদ ও বুশরার। শিরিন কাঁদছিলেন। কিন্তু হাসান একেবারে চুপ। তিনি এ সব পছন্দ করেন না। শিরিনের সাথে কোনো কথাও বললেন না। শেহজাদের মনটা বাবার ব্যবহারে আরো খারাপ হয়ে যায়। বাবার উচিত ছিল মাকে সান্ত¡না দিয়ে কিছু বলা। তার মনে খারাপ ভাবনাটা আবার ফিরে আসে। যুদ্ধে গিয়ে বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তাদের কি হবে? তাদের পড়াশোনার খরচ কিভাবে চলবে? মা কি সংসার সামলাতে পারবে? বাবা ছাড়া তারা বড় হয়ে উঠবে কিভাবে? শেহজাদ আর ভাবতে পারে না।
সামরিক ঘাঁটির গেটে গিয়ে গাড়ি থামে। আর ভেতরে যাওয়া যাবে না। গাড়ি থেকে নেমে পড়েন হাসান, তার পর বাকি সবাই। শেষবারের মত কথা বললেন হাসান শিরিনের সাথে-
: আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হবে। শেহজাদ, বুশরার জীবনটা কঠিন হয়ে উঠবে। তবে আমার বিশ্বাস, ইনশাআল্লাহ সব সামলে নিতে পারবে তুমি। আমি তোমার উপর সব দায়িত্ব দিয়ে গেলাম।
শিরিন চোখ মুছে বলেন-
: চিন্তা করো না। আমার সাধ্যমত সব কিছু সামাল দেয়ার চেষ্টা করবো। তুমি ফিরে এসে দেখবে সব ঠিকমতই আছে। তাদের দোয়া করে যাও।
শেহজাদের দিকে চেয়ে হাসান বললেন-
: মায়ের সব কথা শুনে চলো বাবা। সে একা সব কিছু করে উঠতে পারবে না। সব বিষয়ে তাকে সাহায্য করো। পড়াশোনায় কোনো ফাঁকি দিও না। বুশরাকে দেখো। ঠিক আছে?
: হ্যাঁ বাবা। আমাদের জন্য চিন্তা করো না।
হাসান শেহজাদের মাথায় হাত রাখেন। বলেন-
: তুমি বড় হয়ে উঠছ। আমি ফিরে এসে তোমাকে আরো বড় দেখতে চাই।
বাবার গলা ভারি শোনায়। শেহজাদ তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। হাসানের চোখে পানি টলমল করছে। জীবনে প্রথমবারের মত বাবার চোখে পানি দেখল সে।
শেষ কথা বলেন হাসান-
: আমি তোমাকে, বুশরাকে, তোমাদের মাকে খুব ভালোবাসি।
বুশরাকে কাছে নিয়ে বললেন-
: মায়ের সব কথা শুনে চলো মা। মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। ভাইয়ার কাছ থেকে সাহায্য নেবে।
সবাইকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। শেহজাদ ও বুশরাকে চুমু খেলেন। তারপর ঘুুরে গেট দিয়ে ঢুকে গেলেন ভেতরে। প্রায় একশ’ গজ পথ সোজা হেঁটে গিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে আড়াল হয়ে গেলেন। সবার দৃষ্টি তার পিঠের উপর আটকে রইল। কিন্তু একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না তিনি।
বুশরা শিরিনকে জিজ্ঞেস করে-
: বাবা সেখানে ভালোই থাকবে, তাই না?
প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন শিরিন। তারপর বললেন-
: ইনশাআল্লাহ। তুমি ও শেহজাদ বাবার জন্য দোয়া করবে যেন তিনি ভালোভাবে বাড়ি ফিরে আসেন। চল, আমরা বাড়ি রওনা হই।
একটি ট্যাক্সি ঠিক করে সবাই তাতে উঠে বসে।
গাড়িতে শেহজাদের সাথে কথা বলছিলেন শিরিন-
: আমাদের সামনে কঠিন সময় এসে গেল। তোমার বাবা কোনো সঞ্চয় করেননি। কোনো নগদ টাকা পয়সা দিয়ে যাননি তিনি আমার হাতে। সংসারের খরচ চালাতে আমাকে এখন কোনো একটা কাজ করতে হবে। পত্রিকার পাতায় চাকরির বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে হবে যে সেখানে আমার করার মত কোনো কাজ মেলে কিনা।
: কিন্তু কি ধরনের কাজ তুমি করবে মা? তাহলে বাড়িতে থাকবে কে? আমরা কার কাছে থাকব? প্রশ্ন করে শেহজাদ।
শিরিন বলেন-
: আগে দেখি, সুবিধামত কোনো কাজ মেলে কিনা। যদি পাওয়া যায় তখন দেখা যাবে কি করলে ভালো হয়।
শেহজাদের এ সময় মনে পড়ে সকালে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে সে একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিল। পাশের পাড়ায় এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে মহিলা শিক্ষিকা চেয়েছে। তাদের স্কুল ছাত্রী দু’মেয়েকে পড়াতে হবে। আকর্ষণীয় বেতন। মাকে কথাটা জানায় সে। শিরিন খুশি হন। বলেন-
: ঠিক আছে।। চলো, বাড়ি গিয়ে বিজ্ঞাপনটা ভালো করে দেখি।
বাকি পথ নীরবে পাড়ি দেয় তারা।
রাতে খেতে বসে অনেক কথা মনে হচ্ছিল শেহজাদের। এই প্রথম বাবাকে ছাড়া রাতের খাবার খাচ্ছে তারা। তিনি এখন কি করছেন, রাতে কি খেয়েছেন কে জানে। শিরিন সামান্য কিছু খাবার খেলেন। তার মন খারাপ। এদিকে বুশরা আজ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শেহজাদ নিজেও খুব ধীরে ধীরে খাচ্ছিল। ভাবছিল তাদের জীবনটা এখন অন্য রকম হয়ে গেল। বাবা কবে ফিরবে ঠিক নেই। মাকে কোনো একটা কাজ করতে হবে। সেই এখন বাড়ির একমাত্র পুরুষ। তার এখন অনেক দায়িত্ব। মা যখন কাজে যাবে বুশরাকে দেখাশোনার দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে। মা হয়ত আগের মত আর সময় দিতে পারবে না তাদের। বাড়িঘর দেখাশোনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে তাকেও হাত লাগাতে হবে। যতটা পারা যায় সাহায্য করতে হবে মাকে।
শেহজাদের বলা সেই বিজ্ঞাপন দেখার পর শিরিন বিজ্ঞাপনদাতার সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন। ওই বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন এক বিরাট ব্যবসায়ীর স্ত্রী। শিরিনকে দেখা করতে বলেছিলেন তিনি। যেহেতু খুব কাছে, তাই পরদিন সকালেই দেখা করেন শিরিন তার সাথে। মাঝ বয়সিনী মহিলা অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান। তবে নানা বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজ-খবর রাখেন তিনি। অতি সম্প্রতি তার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে স্বামীর ব্যবসা পরিচালনার জন্য এখন অনেক বেশি সময় দিতে হয় তাকে। তাই তার দশ ও আট বছর বয়সী দু’ মেয়ের জন্য শিক্ষিত ও দায়িত্বশীলা একজন শিক্ষিকা কাম গাইড চাইছিলেন তিনি। সপ্তাহে পাঁচ দিন দুপুর দু’টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা তাকে তাদের সাথে থাকতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি মেয়ে দু’টির দেখাশোনাও করতে হবে। শিরিন স্নাতক পাস। ভালো ছাত্রী ছিলেন তিনি। তবে শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। ঘরে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনায় সাহায্য করেন। যাহোক, শিরিনের সাথে কথা বলার পর তাকে পছন্দ করেছেন মহিলা। বেতন মাসে পাঁচশ’ ডলার। বেশ ভালোই মনে হচ্ছে কাজটা। একটু স্বস্তি বোধ করেন শিরিন। পরদিন থেকেই কাজ শুরু হবে তার।
শিরিন কথা বলছিলেন শেহজাদের সাথে-
: তোমাকে এখন অনেক দায়িত্ব নিতে হবে বাবা। তোমরা যখন স্কুল থেকে ফিরবে, আমি তখন থাকব না। ফিরব রাত আটটারও পরে। তাই তোমাকে নিজের দিকে ও বুশরার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে নেবে তোমরা। তারপর হোমওয়ার্কের কাজগুলো সেরে ফেলবে। বিকেলে আঙিনায় খেলা করবে। বাড়ির বাইরে যাবে না। বুশরা যেন বেশিক্ষণ টিভি না দেখে। আর তার শরীর কিন্তু খুব দুর্বল। একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ও যেন বেশি দৌড়াদৌড়ি না করে। আমি ফিরে এসে আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করব। অবশ্য ফ্রিজে যে খাবার রয়ে গেছে তা দিয়ে আরো দু’দিন চলবে।
৫.
শিরিন কাজ শুরু করেছেন। তাই দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পর বাড়ি এখন ফাঁকা লাগে শেহজাদের কাছে। স্কুলে তার সহপাঠী দু’তিনটি বন্ধু আছে। তারা বিকেলে খেলাধুলা করে কিংবা এদিক ওদিক বেড়াতে যায়। আগে শেহজাদ সে রকম কিছু করেনি। বাবা ও মা তার বাইরে গিয়ে খেলা করতে বা বন্ধুদের সাথে মিশতে দেননি। এখন ছোট বোন বুশরাকে একা রেখে বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। যে দু’দিন মায়ের ছুটি থাকে, তার কথা ভেবে বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না তার। আহা! তিনি কত কষ্ট করছেন। বাবা যুদ্ধে না গেলে তো এ কষ্ট তাকে করতে হতো না। এখন মাকে যে কোনো ভাবে হোক একটু সাহায্য করতে চায় শেহজাদ। আর সুযোগ পেলেই তা করে। তা করে তার ভালো লাগে।
শেহজাদ বুঝতে পারছে, তাকে এখন একটু একটু করে সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। বিভিন্ন কাজ করা শিখতে হবে। এভাবেই একদিন বড় হয়ে উঠবে সে। তখন আরো বড় কাজ করতে হবে তাকে। তাই আগামী দিনগুলো ক্রমেই তার জন্য পরিবর্তন বয়ে আনতে চলেছে। তাকে তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
হাসান যুদ্ধে গেছেন বেশ কিছুদিন হলো। মাঝে কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি। তাতে নিজের কথা, যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন। একটি সেনানিবাসে তাদের সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথাও লিখেছেন। তিনি এখনো রণাঙ্গনে যাননি। জানিয়েছেন, হাজার হাজার ইরানি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়েছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রচ- যুদ্ধ চলছে। তারা হয়ত খুব শিগগিরই যুদ্ধে যোগ দেবেন। শত্রুরা এখন পিছু হটতে শুরু করেছে। তাই যুদ্ধটা তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যেতে পারে বলে তার ধারণা। সব চিঠিতেই তিনি শেহজাদ ও বুশরার কথা জানতে চান। তাদের পড়াশোনার দিকে ভালো করে খেয়াল রাখতে অনুরোধ করেন শিরিনকে। শিরিন জবাবী চিঠিতে তাদের জন্য চিন্তা না করতে ও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসতে অনুরোধ জানান হাসানকে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলা হয়ে যায় শেহজাদের। তার কানে আসে মায়ের কান্নার শব্দ। চমকে ওঠে সে। মা কাঁদছে কেন? দৌড়ে গিয়ে হাজির হয় সে তার ঘরে। খাটের উপর বসে কাঁদছেন শিরিন। ভাঁজ করা একটি বড় ইরানি জাতীয় পতাকা তার হাতে। দেশের পতাকা মায়ের কাছে কেন? কিছুই বুঝতে পারে না শেহজাদ। মায়ের কান্না দেখে তার বুকের মধ্যেও কান্না উথলে ওঠে। খারাপ কিছু হল নাকি? ব্যাকুল কণ্ঠে শিরিনকে জিজ্ঞেস করে-
: কি হয়েছে মা? কাঁদছ কেন তুমি? বুশরার কিছু হয়েছে? বুশরা কোথায় ?
শিরিন হাতের পতাকা দেখিয়ে বলেন-
: একটু আগে দু’জন সৈন্য এসে দিয়ে গেছে এটা।
: পতাকা দিয়ে গেল কেন? পতাকা দিয়ে কি হবে? অবাক হয়ে বলে শেহজাদ।
শিরিন বলেন-
: তারা বলে গেল, তোমাদের বাবা…
কথা শেষ না করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
: বাবা! কি হয়েছে বাবার মা? বল, বল, কি হয়েছে বাবার।
শিরিন চিৎকার করে বলেন-
: তোমাদের বাবা আর নেই। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন।
কাঁদতে থাকে শেহজাদও। মা-ছেলের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে বাতাস।
ততক্ষণে বুশরা এসে মা’র কাছে দাঁড়িয়েছে। সে তখনো কিছু বুঝতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর কান্না একটু প্রশমিত হলে সৈনিকদের কাছে যতটুকু শুনেছেন তা বললেন শিরিন। হাসানদের ইউনিটকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছিল। তারা রণাঙ্গনে পৌঁছার পরপরই তাদের উপর আকস্মিক হামলা চালায় শত্রুরা। আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পাননি তারা। এ হামলায় তোমাদের আব্বা মারাত্মকভাবে আহত হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান তিনি। এমন অবস্থা যে তাকে শনাক্ত করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল।
বুশরা জিজ্ঞেস করে-
: মা, বাবা কি সত্যিই আর আসবে না?
শিরিন তাকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে ওঠেন। তার সাথে শেহজাদও কাঁদতে থাকে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। শিরিনের কান্না থেমেছে। শেহজাদকে কাছে টেনে নিয়ে তিনি বলেন-
: বাবা, আমাদের জন্য দুনিয়াটা খুব কঠিন হয়ে গেল। তোমাকে অনেক কাজ করতে হবে এখন। বুশরা একেবারেই ছোট। তাকে বড় করে তুলতে হবে। আমি জানি না এ চাপ কতটা সইতে পারবে তুমি। আমি পাশে আছি। তোমাকে এখন অনেক চাপ সইতে হবে। শক্ত হতে হবে। দুর্বল হয়ে পড়লে টিকতে পারবে না।
: হ্যাঁ মা, আমি বুঝতে পারছি। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়াব। সব শক্তি দিয়ে জীবনে বড় হওয়ার জন্য লড়াই করব। সকল ক্ষেত্রে তোমাকে সাহায্য করব। তুমি আমাকে দোয়া করো।
শিরিন ছেলের মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন।
৬.
প্রথম প্রথম স্কুল থেকে ফিরে শিরিনকে না পেয়ে দু’জনের খুব কষ্ট হতো। এখনো মন খারাপ হয়ে থাকে। তবে তা আর আগের মত কষ্ট দেয় না। স্কুলের পোশাক ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে বুশরাকে নিয়ে পড়তে বসে শেহজাদ। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি বোনের দিকেও খুব খেয়াল রাখে সে। বিকেলে দু’জন আঙিনায় খেলে। বাইরে থেকে ওদের দু’জনের স্কুলের বন্ধুরা এলে বেশি আনন্দ হয়। মাগরিবের আজানের আগে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যায়। তারা বই-খাতা নিয়ে এসে লিভিং রুমে বসে। টিভি চালিয়ে দেয়। নিজেদের পড়াশোনা সারে।
লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছিল দু’জন। কাজ থেকে ফেরেন শিরিন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। শেহজাদ তা লক্ষ করে। গভীর ভালোবাসায় ভরে ওঠে তার মন। আহা! মাকে এখন কত কষ্ট করতে হচ্ছে। দরদ ভরা গলায় জিজ্ঞেস করে সে-
: মা, একটু বস না এখানে। তোমাকে যেন কেমন দেখাচ্ছে। শরীরটা ভালো আছে তো?
ছেলের কথা শুনে মায়ের মনের ভেতরটায় যেন ঝড় বয়ে যায়। এতটুকু ছেলে হলেও মা’র অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে। তিনি একটু ধরা গলায় বললেন-
: হ্যাঁ বাবা, আজ অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তো! একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
আর কিছু না বলে চলে যান তিনি। আজ বেশ বিরক্তিকর ব্যাপার ঘটেছে। তবে তা ছেলেকে বলা উচিত মনে হলো না তার। তিনি যেখানে কাজ করেন সে মহিলার অনুরোধে অনেক কাজ করতে হয়েছে তাকে। রাত নয়টায় তার বাড়িতে কি এক পার্টির আয়োজন করেছেন তিনি। অনেক লোকজন আসবে। তাই আজ মেয়েদের পড়ানোর বদলে বাড়ি গোছগাছ আর রান্নার সব আয়োজনে তাকে সাহায্য করার জন্য শিরিনকে অনুরোধ করেন তিনি। ভদ্রতার খাতিরে এবং অনুরোধ না রাখলে সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে আশঙ্কায় তিনি কিছু বলতে পারেননি। সে কাজে আসলেই বেশ ধকল গেছে তার। মহিলা বারবার তাকে রাতে তার বাড়িতে থেকে যেতে বলেন। এমনকি জোরাজুরিও করেন। কিন্তু শিরিনের পক্ষে ছোট ছেলে- মেয়েকে একা রেখে সেখানে রাতে থাকা সম্ভব ছিল না। এতে মহিলা বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এদিকে শিরিনেরও মহিলার এ ধরনের অনুরোধ ভালো লাগেনি। তাই মনটা বেশ অস্বস্তিতে ভরে আছে। পোশাক পাল্টে গোসল করতে গেলেন তিনি।
শিরিন চলে যাওয়ার পর বুশরা ভাইকে জিজ্ঞেস করে-
: মা কি এমনি করেই কাজ করবে ভাইয়া?
তার কথার মধ্যে মন খারাপের বিষয়টি ধরা পড়ে।
শেহজাদ বলে-
: হ্যাঁ, আমরা বড় না হয়ে ওঠা পর্যন্ত মাকে এভাবে কষ্ট করতে হবে। শোন, মাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। এখন থেকে মা যখন বাসায় থাকবে না তখন বাড়ির সব কাজ আমরা করে রাখব। তাহলে কাজ শেষে বাড়িতে এসে তাকে আর কিছু করতে হবে না। মা একটু আরাম পাবে। কি, ভালো হবে না সেটা? তুই কি বলিস?
: খুব ভালো হবে। আমাকে কি কাজ করতে হবে বলে দিস ভাইয়া। বুশরা বলে।
স্কুল থেকে আসার পর থেকে রাতে শিরিন ফিরে না আসা পর্যন্ত বাড়ির অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে শেহজাদ। বাড়ির আঙিনা থেকে ঘর পরিষ্কার রাখার সব কাজই করে সে। ফলে শিরিনকে বাড়ি ফিরে প্রায় কিছুই করতে হয় না। অবশ্য পড়াশোনার ব্যাঘাত হতে পারে বলে এত কাজ করতে শেহজাদকে নিষেধ করেছেন তিনি। কিন্তু সে তাকে বলেছে, পড়াশোনার কোনো সমস্যা না করেই এগুলো করছে। তার জন্য অন্তর থেকে দোয়া করেন শিরিন। এদিকে কাজ থেকে ফেরার পর ইদানীং বেশ ক্লান্তি বোধ করেন তিনি। ব্যবসায়ীর স্ত্রী প্রথমে শুধু তার মেয়েদের পড়ানো ও দেখাশোনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই ঘটনার পর থেকে তিনি শিরিনকে দিয়ে নিজ সংসারের অনেক কাজ করিয়ে নেন। যেমন এখন প্রায়ই তার বাড়ির রান্নার কাজ তাকে দিয়ে তদারক করান। দু’-এক সময় স্বামীর ব্যবসার আংশিক হিসাবও পরীক্ষা করান তাকে দিয়ে। বাধ্য হয়ে শিরিনকে তা করতে হয়। কারণ, এ সময় এই ৫শ’ ডলার তার খুবই প্রয়োজন। হাসানের বাবদ এখনো মাসে সেই একশ’ ডলার পান তিনি। হাসান যেহেতু কোনো নিয়মিত সৈনিক ছিলেন না তাই সরকার আর কোনো প্রকার সহায়তা পরিবারকে দেয়নি। স্বামীর দিকে তেমন কেউ নেই যারা তাদের আর্থিক সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে। তবে তার ছোট ভাই ফররুখ অত্যন্ত উদার হৃদয়। সে বিভিন্ন সময়ে তাকে বলতে গেলে জোর করেই সাহায্য করে। তার আন্তরিকতার কারণে নিঃসংকোচে সে সাহায্য গ্রহণ করেন শিরিন।
গত কয়েক মাসে আগের চেয়ে শিরিনের ক্লান্তি বেড়েছে। তবে মনোবল হারাননি তিনি। পিতৃহারা দু’টি শিশুকে বড় করে তোলার কঠিন দায়িত্ব তাকে একাই পালন করতে হবে। এটা এখন তার জন্য আসলে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসান কোনো অর্থ সঞ্চয় করেননি। থাকার মধ্যে শুধু এ বাড়িটা আছে। ছেলে-মেয়েরা স্কুল পাস করার পর তাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন হবে। সে ব্যবস্থা আগে থেকেই তাকে করে রাখতে হবে যাতে তাদের কোনো সমস্যা না হয়। তাই এ সামান্য আয় থেকেই কিছু অর্থ সঞ্চয় করতে শুরু করেছেন শিরিন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর মোনাজাতে আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করেন তিনি যেন ছেলে ও মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত তিনি তার হায়াত দান করেন।
৭.
এক বছর পর হাসানের লেখা একটি চিঠি পেলেন শিরিন। হাসানেরই এক বন্ধু চিঠিটি ডাক মারফত পাঠিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, যেদিন সকালে হাসান যুদ্ধে যান তার আগের রাতে তিনি এ চিঠিটি বন্ধুকে দিয়েছিলেন বাড়ির ঠিকানায় পাঠানোর জন্য। ব্যস্ততার কারণে বন্ধুটি সেদিন সকালে চিঠিটি পোস্ট করতে পারেননি। দুপুরের দিকে হাসানদের ইউনিটের উপর শত্রুদের আকস্মিক হামলার খবর আসে। তাই তাকেও জরুরি ভিত্তিতে ইউনিটের বাকি সদস্যদের সাথে রণাঙ্গনে চলে যেতে হয়। তার জিনিসপত্রের সাথে চিঠিটিও তিনি রেখে যান ব্যারাকে। কিন্তু তাকেও দুর্ভাগ্য ছাড়েনি। শত্রুদের হামলার শিকার হয়ে তিনিও আহত হন। মাথায় গুরুতর আঘাতের কারণে সাময়িক স্মৃতিভ্রষ্টতা ঘটে তার। অতি সম্প্রতি সুস্থ হয়ে উঠে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। প্রথমে যান তাব্রিজে নিজের বাড়িতে পরিবারের কাছে। তখন এ চিঠির কথা মনে পড়ে তার। দ্রুতই ব্যারাকে ফিরে এসে চিঠিটি খুঁজে বের করে তারপর পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ বিলম্বের জন্য শিরিনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বারবার।
শিরিন চিঠিটি পড়তে শুরু করেন:
প্রিয় শিরিন,
তোমাদের কথা যে কি ভীষণ মনে পড়ছে! সবাইকে ছেড়ে দূরে থাকা বড় কষ্টের। তোমাদের কথা ভেবে আমার ঘুম হয় না। এখানে আমাদের প্রশিক্ষণ চলছে। আমরা যেখানে আছি, রণাঙ্গন থেকে এ জায়গা বেশি দূরে নয়। আমার মত শত শত, হাজার হাজার মানুষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে আমাদের। দু’টি গ্রুপ ইতোমধ্যে লড়াইয়ে যোগ দিতে চলে গেছে। আমাদের গ্রুপ ও আরেকটি গ্রুপ পিছন থেকে তাদের সমর্থন দিতে রওনা হচ্ছে। মিথ্য বলব না, আমি খুব নার্ভাস বোধ করছি। শেহজাদ ও বুশরার কথা খুব মনে পড়ছে। কবে যুদ্ধ শেষ হবে বা কবে বাড়ি ফিরতে পারব, জানি না। ভীষণ মনে পড়ছে তোমার কথাও। তোমাদের জন্য কোনো অর্থের সঞ্চয় রেখে আসিনি আমি। জানি, আমার যুদ্ধে আসাটা তুমি পছন্দ করনি। কিন্তু আমি যে না এসে পারিনি। দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারি। আমার পক্ষে এখন আর ফেরা সম্ভব নয়।
যখনি সময় পাব, তোমাকে লিখব। আমার জন্য চিন্তা করো না। মন শক্ত রেখো। ছেলে-মেয়ের দিকে খেয়াল রেখো। মনে রেখো, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। আমার জন্য দোয়া করো। ইতি হাসান।
শিরিন বুঝতে পারলেন, এই তার শেষ চিঠি। অন্তত এ সময় পর্যন্ত তিনি যুদ্ধে যাননি, সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। তবে এর পরই তিনি যুদ্ধে চলে যান। চিঠিতে তার সব কথা নেই। যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা কিছু বলেননি। হয়ত তাদের চিন্তায় ফেলতে চাননি বলেই কিছু লেখেননি হাসান।
সন্ধ্যার সময় টিভি দেখছিল শেহজাদ। স্যাম অ্যান্ড ক্যাট কার্টুন সিরিজ দেখছিল। হঠাৎ কার্টুন দেখানো বন্ধ হয়ে যায় : স্ক্রলে ভেসে ওঠে ব্রেকিং নিউজ। তারপরই জরুরি খবর পাঠ করতে শুরু করেন সংবাদ পাঠক। আপনাদের জন্য বিশেষ যুদ্ধ সংবাদ হচ্ছে এর আগে আমাদের সৈন্যদের প্রথম দলটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণের পর তাদের সাহায্যে বাকি সৈন্যদেরও প্রেরণ করা হয়েছিল। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে যুদ্ধে আমাদের পঞ্চাশ জনেরও বেশি সৈন্য নিহত বা আহত হয়েছেন। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা আজ অথবা কাল তাদের প্রিয়জনদের লাশ দেখার সুযোগ পাবেন। আর যারা আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে গিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। আমাদের কাছে এই ছিল সর্বশেষ জরুরি খবর। আবার নতুন কোনো বিশেষ খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা আপনাদের সামনে হাজির হবো।
যুদ্ধ ক্রমেই প্রচ- হয়ে উঠছে। এই যুদ্ধের ফল কি হবে শেহজাদ তা বুঝে উঠতে পারে না। বহু মানুষ মারা যাচ্ছে দু’পক্ষেই। নিহতদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, বাড়ছে আহতদের সংখ্যাও। ডাক্তার-নার্সরা সবাই ব্যস্ত। ডাক্তাররা আহতদের চিকিৎসা ও নার্সরা সেবা-শুশ্রুষা করছেন। সে সাথে নিহতদের ক্ষত-বিক্ষত দেহগুলো যতটা সম্ভব ঠিকঠাক করে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। কত মানুষ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে আর তাদের পরিবারগুলোর আকাশে ঘনীভূত হচ্ছে অনিশ্চয়তার মেঘ। শেহজাদরা যেমন বাবাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে- এ রকম আরো কত পরিবার, কত নারী-শিশু অসহায় হয়ে পড়েছে সে জানে না। কেন এ যুদ্ধ যে যুদ্ধ তার কাছ থেকে, তার মত আরো অনেক ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে তাদের বাবাদেরকে চিরতরে কেড়ে নেয়? যুদ্ধ বাধায় বড়রা। তার অভিশাপ বইতে হয় ছোটদেরই বেশি। তাদের ভবিষ্যৎ ঢেকে যায় অন্ধকারে। শেহজাদ ভাবে, আচ্ছা! বড়রা কি যুদ্ধ এড়াতে পারে না? যুদ্ধের ফলে এত ধ্বংস, এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কি তাদের মনে কষ্টের সৃষ্টি করে না? মনে কোনো অনুশোচনাবোধ জাগায় না?
স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে তারা আঙিনায় রাখা গাড়িটি দেখেই বুঝল যে রুদাবা ফুফু এসেছেন। তিনি সব সময় আসেন না। যখন আসেন সাধারণত সারাদিনের জন্য আসেন। বাড়ির মধ্যে ঢুকে রান্নাঘরে শব্দ শুনে তারা বুঝতে পারল মা কিছু রান্না করছে। এদিকে লিভিং রুমে রাখা ফোনে কথা বলছিলেন রুদাবা। তাদের দেখে বললেন-
: এই যে সোনারা! কেমন আছ তোমরা? স্কুলের পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে তো?
দু’জনে একসাথে জবাব দেয় –
: হ্যাঁ। আপনি কখন এসেছেন ফুপি?
: এই তো কিছুক্ষণ। যাও, তোমরা গিয়ে স্কুলের পোশাক পাল্টে নাও। তারপর খেয়ে তোমাদের সাথে গল্প করব। বলেন রুদাবা।
শেহজাদ লক্ষ করে তার ফুফুর মুখটা একটু মলিন হয়ে আছে। তাই জিজ্ঞেস করে-
: ফুফু! আপনার কি মন খারাপ?
তড়িঘড়ি করে বলেন রুদাবা-
: না না, তা কেন হবে? আমি ঠিক আছি।
আসলে একমাত্র ভাইকে খুব ভালোবাসতেন রুদাবা। তার মৃত্যুশোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। তারা ছিলেন দু’ভাই-বোন। তাদের বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন। তারপর ভাইও চলে যাওয়ায় তার পিতৃকুলে আর কেউ রইল না। এখন ভাইয়ের এ ছেলে-মেয়ে দু’টিই শুধু তার বংশের বন্ধন। তাদের জন্য ভীষণ মায়া অনুভব করেন তিনি।
বুশরা বলে-
: ফুপি! আমার মনে হচ্ছে তুমি কেঁদেছ। কেন ফুপি? বাবার জন্য? বাবা তো বেহেশতে চলে গেছে।
এ সময় শিরিন ঢোকেন লিভিং রুমে। জানতে চান-
: কি ব্যাপার! কি এত কথা বলছ তোমরা?
ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন-
: যাও, তোমরা পোশাক পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিংয়ে এসো। আমরা সেখানে গিয়ে বসছি।
শিরিনের শরীরটা খারাপ হয়ে পড়ে। এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে হাসপাতালে নিতে হয় তাকে। ডাক্তাররা চিকিৎসা করার পরও সুস্থ হচ্ছিলেন না তিনি। আসলে পরিশ্রম, ছেলে-মেয়ে-সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা বোধই তাকে অসুস্থ করে তুলেছিল। কয়েকদিন চিকিৎসার পর একটু ভালো হয়ে তিনি বাসায় ফেরেন।
ছোট বুশরা তেমন কিছু বোঝে না। বাবা যে নেই তা সে মেনে নিয়েছে। তারপরও প্রায়ই মন খারাপ করে সে। শেহজাদের কাছে এসে ব্যথা ভরা বড় বড় দু’টি চোখে জানতে চায় –
: ভাইয়া! বাবা কী সত্যিই আর আসবে না?
শেহজাদ সত্যি কথাই বলে তাকে-
: না রে বোন! বাবা যেখানে গেছে সেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসতে পারে না।
বুশরা তখন ক্ষুব্ধ হয়ে বলে-
: তাহলে বাবা গেল কেন?
এর কোনো জবাব শেহজাদের মুখে আসে না।
শেহজাদ বুঝতে পারে, বুশরাকে দেখে রাখার পাশাপাশি মায়ের উপর কোনো চাপ যাতে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তারা অবশ্য এমন কিছু করে না যাতে মায়ের জন্য কোনো সমস্যা হতে পারে। তারপরও এখন থেকে আরো সতর্ক থাকতে হবে সে ভাবে। কিন্তু তার পরিশ্রম করা তো বন্ধ করতে পারবে না সে। আর মা কাজ না করলে তাদের তিন জনের এ সংসারটা চলবে কি করে? বাবার জন্য যে একশ’ ডলার মাসিক ভাতা পায় তা দিয়ে কি সব খরচ চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং কাজ করা ছাড়া মা’র উপায় নেই। শেহজাদ নিজে এখনো উপার্জন করার উপযুক্ত হয়নি। তাছাড়া এ বয়সে কি কাজই বা সে করবে যা দিয়ে তাদের সংসার চালানো যাবে? বড় হতে হলে তাকে লেখাপড়া শেষ করতে হবে। আরো আছে বোন বুশরা। তার লেখা-পড়ার কোনো সমস্যা যাতে না হয় তা দেখতে হবে। তাকে বড় করে তুলতে হবে। মা কাজ করে টাকা আয় না করলে এ সবের কিছুই হবে না। তাদের সংসার চালানো ও লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব নেবে বা বিপদে পাশে এসে দাঁড়াবে এমন কোনো স্বজনও নেই।
৮.
স্কুল থেকে ফেরার সময় বুশরার মুখটা অন্যদিনের চেয়ে মলিন দেখাচ্ছিল। শেহজাদের কেমন যেন মনে হয়। জিজ্ঞেস করে-
: তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন রে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
বুশরা বলে-
: না ভাইয়া, ক্লাসে যেন কেমন লাগছিল। তেমন কিছু নয়।
আর কোনো কথা না বলে বাড়ি ফেরে তারা।
বুশরা কিছু খেতে চাইল না। স্কুলের পোশাক ছেড়ে ঘরের পোশাক পরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে সে। শেহজাদ খাবার খেয়ে এসে লিভিং রুমে বসে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করে। তার মনে হয়, বুশরা কি করছে তা গিয়ে দেখে আসা দরকার। তার ঘরে গিয়ে দেখে বুশরা একটি চাদর গায়ে শুয়ে আছে। পাশে বসে তার কপালে হাত রাখে। চমকে ওঠে। বেশ জ¦র তার গায়ে। কি করবে, বুঝতে পারে না। ডাক্তার ডাকবে? কিন্তু মাকে না জানিয়ে তা করা কি ঠিক হবে? তাছাড়া বোনকে একা রেখে ডাক্তারের কাছে যাবেই কি করে?
বুশরার জন্য ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে শেহজাদ। আবার তার কপালে হাত রাখে। জ্বর একই রকম। বাসায় থার্মোমিটার আছে। মায়ের ঘরে ফার্স্ট এইড বক্সে অন্যান্য উপকরণের সাথে সেটা রাখা। এক দৌড়ে গিয়ে বক্সটা নিয়ে আসে। থার্মোমিটারটা বের করে বুশরাকে ডাকে। সেটা তার জিভের নিচে রাখার পর তাকিয়ে থাকে ঘড়ির দিকে। ঠিক এক মিনিটের মাথায় সেটা বের করে এনে জ্বর দেখে। ১০২ ডিগ্রি। এতো অনেক জ্বর। মাকে এখুনি ব্যাপারটা জানানো দরকার। কিন্তু তাকে ফোন করতে গিয়েও থেমে যায় সে। মায়ের ডিউটি রাত ৮টা পর্যন্ত। তার আগে মা আসতে পারবে না হয়ত। শুধু শুধু চিন্তা করবে। থাক, তাকে চিন্তায় ফেলে লাভ নেই। তার চেয়ে রুদাবা ফুফুকে জানানোই ভালো। তিনি বুশরাকে খুব ভালোবাসেন। একটা ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন নিশ্চয়ই।
রুদাবা ফুফু ফোনে শেহজাদের কথা শুনে পেরেশান হয়ে পড়েও বললেন-
: একটুও চিন্তা করিস না বাবা। আমি এখুনি একজন ডাক্তারকে নিয়ে আসছি। ততক্ষণ একটা ছোট তোয়ালে ভিজিয়ে ওর কপালে পানিপট্টি দিতে থাক।
রুদাবা ফুফুর কথামত বুশরার কপালে পানিপট্টি দিতে থাকে শেহজাদ।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন রুদাবা ফুফু। ডাক্তার বুশরাকে দেখে বলেছেন, ভয়ের তেমন কিছু নেই। মনে হয়, বড় রকম কোনো মানসিক চাপ থেকে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দিন তিনেক বিশ্রামে থাকলে আর ঠিকমত ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যাবে। প্রেসক্রিপশন লিখে দেন তিনি। রুদাবা ফুফু ডাক্তারের ফি দিয়ে দিলেন। তারপর তাকে বিদায় দিয়ে নিজেই গিয়ে কিনে নিয়ে এলেন ওষুধগুলো। তখন থেকেই বুশরাকে ওষুধ খাওয়ানো শুরু হয়েছে। ফুফু সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। এর মধ্যে স্যুপ তৈরি করে খাইয়ে দিলেন তাকে। তারপর ওষুধ খাওয়ানোর সব নিয়ম-কানুন শেহজাদকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। মা ফিরে না আসা পর্যন্ত বুশরার মাথায় একটানা পানিপট্টি দেয় সে।
শিরিন বাড়ি ফিরে ব্যাপারটা জেনে তাকে কিছু না জানানোর জন্য প্রথমে শেহজাদের ওপর প্রচ- রেগে গেলেন। ততক্ষণে বুশরার জ¦র একটু কমে এসেছিল। তারপর তিনি একটু শান্ত হলে শেহজাদ নরম গলায় বলে-
: মা, তুমি খবর পেয়ে যদি আসতে না পারো তাহলে খুব চিন্তা করবে বলে তোমাকে জানাইনি। এ জন্য আমার উপর রাগ করো না।
বুশরা বলে-
: মা, ভাইয়া সব সময় আমার কাছে বসে থেকে কপালে পানিপট্টি দিয়েছে। কত কষ্ট করছে আমার জন্য। জ্বর তো একটু কমেছে। তুমি তার উপর রাগ করো না। আর রুদাবা ফুপিও এসে আমার খুব যত করেছে। আবার কাল আসবে বলে গেছে।
শিরিনের রাগ ততক্ষণে আর নেই। হ মাখা কণ্ঠে ছেলেকে বলেন, খেয়ে নিয়ে তুমি পড়তে বসো। আমি ওকে দেখছি।
শেহজাদ তাকে বুশরার ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম বুঝিয়ে দেয়।
তৃতীয় দিনে বুশরার জ্বর সেরে যায়। রুদাবা ফুফু আবারো ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, ঠিক হয়ে গেছে বুশরা। দু’একদিনের মধ্যেই তার শরীরের দুর্বলতা কেটে যাবে।
বুশরার অসুস্থতা অল্পের উপর দিয়ে কেটে যাওয়ায় অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করেন শিরিন। আল্লাহপাক পরম করুণাময়। তাই তাদের অসহায় পরিবারটি অধিক ভোগান্তির শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। শেহজাদকে অনেক দোয়া করেন তিনি। সে বুদ্ধি ও সাহসের সাথে বিপদ মোকাবেলা করতে শিখেছে। আর তাদের ফুফু রুদাবা যেভাবে বিপদের সময় এগিয়ে এসেছে তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। তার ভালোর জন্য অন্তর থেকে দোয়া করেন শিরিন।
৯.
যুদ্ধ বোধ হয় শেষ হতে চলেছে। সে রকমই একটি আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এতদিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এতদিন ধরে যুদ্ধ চললেও কোনো দেশই জয়ী হতে পারেনি। কেউই কারো ভূখ-ের তেমন কোনো এলাকা দখল করতে পারেনি যা তার জন্য বিজয় বলে গণ্য হতে পারে। দু’দেশেই বহু মানুষ হয়েছে নিরাশ্রয়। থেমে গেছে উন্নয়ন কর্মকা-। ইতোমধ্যেই দু’দেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। নির্বিচার বোমা বর্ষণে ব্যাপক ধ্বংসকা- ঘটেছে। ব্যাপক ধ্বংস ও মৃত্যুর প্রেক্ষিতে শুভাকাক্সক্ষী কিছু দেশ যুদ্ধ বন্ধে জোর উদ্যোগ নিয়েছিল। আর তাদের চাপে শেষ পর্যন্ত দু’দেশের প্রেসিডেন্টই যুদ্ধ বন্ধে একমত হয়েছেন। ফলে উড়েছে শান্তির শে^ত পায়রা। মাঝে থেকে বাবাকে হারালো শেহজাদ ও বুশরা এবং তাদের মত অসংখ্য ছেলে-মেয়ে। যুদ্ধ বন্ধ হলেও তাদের বাবারা তো আর ফিরে আসবেন না। সবার জন্যই কষ্ট ও বেদনা অনুভব করে সে। এ রকম ঘটনা যেন আর না ঘটে, বলে ওঠে তার মন।
দেশের জন্য যুদ্ধ করে যারা শহীদ হয়েছেন সরকার তাদের সবাইকে পৃথক স্থানে দাফনের বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। সে কারণে হাসানকে দাফন করা হয়েছে কৌম নগরীতে তৈরি শহীদী গোরস্তানে। আরো শত শত শহীদ সেনার সাথে সেখানে কবরে শুয়ে আছেন তিনি। তবে তাদের কোনো কবরেই নাম ফলক নেই, কিন্তু নম্বর আছে যা দেখে প্রতিটি কবর শনাক্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিরিনের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে শহীদদের পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারতের জন্য সরকারের ব্যবস্থাপনায় কৌমে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন তাদের পালা এসেছে। আগামী শুক্রবার সকাল ৭টায় বাড়িতে গাড়ি আসবে তাদের নিয়ে যেতে। পরিবারের অনধিক পাঁচজন যেতে পারবে কবর জিয়ারতে। ঠিক হয়েছে যে শেহজাদ, তার ফুফা শাহেদ জাহেদী ও মামা ফররুখ শাহপুর- এ তিনজন হাসানের কবর জিয়ারত করতে যাবেন।
তেহরান থেকে সড়কপথে কৌমের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কি.মি। গাড়ি মাঝারি গতিতে (ঘন্টায় ৬৫ কি.মি) গেলে আড়াই ঘন্টার মত লাগে। তাই সাড়ে ৯টার দিকে পৌঁছে গেল তারা। শহীদী গোরস্তানটি খুব সুন্দর। চারদিকে পরিকল্পিত সবুজের সমারোহ। গোটা গোরস্তান জুড়ে মাঝে মাঝেই নানান রকম ফুলের ছোট ছোট বাগান। হালকা বাতাসে ফুলের সুবাস ছড়ানো। দেখলেই বোঝা যায়, কর্তৃপক্ষ অকালে প্রাণদান করা দেশের বীর সন্তানদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাই, তাদের চির-বিশ্রামের স্থানটিতে একটি বেহেশতি পরিবেশ রচনা করার ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি রাখেননি তারা। সেই শান্ত, গ্ধ, মনোরম পরিবেশে গভীর নীরবতার মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন শহীদ বীরেরা। গোরস্তানের প্রবেশপথের সাথেই অফিস। দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে সরকারি চিঠি দেখাতেই তিনি কবরের নম্বর জানিয়ে দেন। একজন রক্ষীকে দেয়া হয় তাদের সাথে। তিনি যথাস্থানে গিয়ে কবর চিনিয়ে দিলেন। হাসানের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শেহজাদ। রক্ষী নিষেধ করে বলে : এখানে কান্না নিষেধ। শাহেদ ও ফররুখ সান্ত¡না দেন শেহজাদকে। দোয়া-দরুদ পাঠ করে হাসানের রূহের মাগফিরাত কামনার পর বেরিয়ে আসে তারা।
ফিরে আসার সময় নানা কথা ভাবছিল শেহজাদ। বাবার মৃত্যুর পর গত কয়েক মাসে তার শরীরের বয়স যত না বেড়েছে মনের বয়স বেড়েছে অনেক বেশি। মায়ের জন্য, বোনের জন্য তথা পরিবারের জন্য সে ভাবতে শিখেছে। মায়ের কাজ করার ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগে না তার, কিন্তু কিছু করার নেই। এখন সে পড়াশোনার দিকে আগের চেয়ে আরো বেশি মনোযোগী হয়েছে। জীবনে বড় হতে হলে ভালো লেখাপড়া ও ভালো ফল করতে হবে, এটা এখন বুঝে গেছে সে। শিক্ষকরাও তার পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়ার বিষয়টি লক্ষ করেছেন। তারা যে তার ওপর খুশি শেহজাদ এটা বুঝতে পারে তার প্রতি তাদের স¯েœহ ব্যবহার দেখে। ফলে সে আরো উৎসাহিত হয়ে উঠেছে।
রাতে খাবার সময় টেবিলে বসে আনমনা হয়ে পড়ে শেহজাদ। এই টেবিলে ক’দিন আগেও বাবা তাদের সাথে একত্রে বসে খেয়েছেন। তাদের ছিল একটি সুখী পরিবার। আজ তিনি নেই। এখান থেকে অনেক দূরে ঘুমিয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। শেহজাদের বা পরিবারের কারোরই ভালো বা মন্দে বাবার কিছুই করার রইল না। তার মনে পড়ে, বাবা বাড়িতে থাকলে স্কুলে যাবার সময় সে ও বুশরা মা ও বাবা দু’জনের কাছ থেকে বিদায় নিত। এখন মা আছে, কিন্তু বাবার কাছ থেকে আর বিদায় নিতে হয় না। তিনি তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করে দিতেন। আর কোনোদিন তা করবেন না। গোরস্তানের কথা মনে হয় তার। বিশাল জায়গা জুড়ে হাজার হাজার শহীদের সারি সারি কবর সেখানে। দেশের জন্য পরিবার ছেড়ে, সন্তানদের রেখে, বন্ধু-স্বজনদের ফেলে তারা চলে গেছেন আরেক পৃথিবীতে। জীবনে কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল তাদের। তার সবই অপূর্ণ রয়ে গেল। তার বাবা বলেছিলেন, ফিরে এসে শেহজাদকে তিনি অনেক বড় দেখতে চান। তার সে ইচ্ছা পূরণ হলো না। বাবার মৃত্যুর পর থেকে নামাজ পড়া শুরু করেছে শেহজাদ। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পর মোনাজাতের সময় বাবার জান্নাত নসিবের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে।
আরো এক বছর পার হওয়ায় এবার চৌদ্দোয় পড়েছে শেহজাদ। তাতে তার চেহারায় কোনো ভারিক্কি ভাব আসেনি বটে, তবে তার দায়িত্ববোধ আগের চেয়ে বেড়েছে। মায়ের সুবিধা-অসুবিধার দিকে ভীষণ লক্ষ তার। এমনকি রাতের রান্না পর্যন্ত করতে শুরু করেছে সে। মা প্রথম প্রথম খুব আপত্তি করেছেন। পরে হার মেনেছেন ছেলের কাছে। সে কিছুতেই তাকে ঘরের কাজ করতে দিতে চায় না। বলেছে, কাজ থেকে ফিরে এসে তুমি শুধু বিশ্রাম করবে। কোনো কাজ করতে হবে না তোমাকে। বুশরার পড়ার জন্যও এখন শিরিনকে ভাবতে হয় না। শেহজাদের কাছে পড়ে তার পরীক্ষার ফলও ভালো হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এবার ক্লাসে প্রথম হয়েছে শেহজাদ। এর আগে সে চতুর্থ বা পঞ্চম স্থানে থাকত। মাঝেমধ্যেই সে শিরিনকে বলে-
: তুমি চিন্তা করো না মা। আমি দ্রুত বড় হয়ে যাব দেখো। একটা ভালো চাকরি করব। তখন আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। তুমি বাড়িতে বসে শুধু আরাম করবে আর বুশরাটা পড়বে।
তার কথা শুনে চেয়ে থাকেন শিরিন তার দিকে। এই এক বছরে ছেলেটার মধ্যে কতই না পরিবর্তন এসেছে। হ্যাঁ, সত্যিই বড় হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। আজ তার বাবা থাকলে এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না তাকে। বাবা-মায়ের সম্মিলিত হ ও ভালোবাসায় তার নিষ্পাপ মন ও স্বপ্নগুলো আরো কিছুদিন লালিত হতো, তার বাল্যকালের সময়টা আরো কিছুদিন নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পারত। ছেলে আর মেয়েকে ঠিক মত গড়ে তুলতে হবে। তাদের যেন কোনো ভাবেই সে রকম কোনো কষ্ট না হয়, তাদের লেখা-পড়ার ব্যাঘাত না ঘটে, যতটা সম্ভব সে ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি ছাড়া তো তাদের পাশে দাঁড়ানোর আর কেউ নেই। পিতার হ ও ভালোবাসা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে, এখন মায়ের মমতা ও যত দিয়ে সে অভাব পূরণ করতে হবে। বুক থেকে একটি দীর্ঘশস বেরিয়ে আসে শিরিনের। কাজটি সহজ হবে না হয়ত। কিন্তু তাকে তা পারতেই হবে। নইলে হাসানের রূহ শান্তি পাবে না।
একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলেন শিরিন। শেহজাদ বড় হয়ে উঠেছে। পরীক্ষায় চমৎকার ফল করে লেখাপড়া শেষ করেছে। খুব ভালো ও সম্মানজনক একটা চাকরি পেয়েছে সে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। বুশরার লেখাপড়াও শেষ পর্যায়ে। এ রকম একটি ছবি তার চোখে ভেসে ওঠে। শিরিনের মনে হয়, হাসানও এ ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন। তার মুখে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি। এ স্বপ্ন ও আশার এক আলোছায়ার মধ্যে ডুবে রইলেন তিনি।

ব্রেনেসা স্মিথ: যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির কলম্বাসে জন্ম। এখন স্টার্কভিলে বাস করেন। ডেল্টা বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজি/ ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
এ কিশোর উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এটি ঠিক মূল লেখার অনুবাদ নয়। বাস্তব কারণেই এতে মূল কাহিনী ও চরিত্রের অংশমাত্র রাখা হয়েছে, রূপান্তর ঘটানো হয়েছে কাহিনীর সিংহভাগ ও প্রায় সব চরিত্রের।

Share.

মন্তব্য করুন