আমরা হয়তো অনেকেই জানি না পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়েছিল একজন ধনাঢ্য, বিদুষী, ধর্মানুরাগী মুসলিম মহীয়সী নারীর মাধ্যমে। তিনি হলেন ফাতিমা আল-ফিহরি। তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন কুয়াইরান এ যা বর্তমানে তিউনিশিয়া নামে পরিচিত। পিতা মুহাম্মদ আল-ফিহরি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। যিনি ব্যবসায়িক কারণে অভিবাসী হয়ে চলে এসেছিলেন মরক্কোর ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ফিজ শহরে যা আল মাগরিব নামে পরিচিত ছিল। ফাতিমা আল-ফিহরি এখানেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

পিতা, ভাই ও স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ও তার বোন মারিয়াম সকল স¤পত্তির মালিক হন। তারা তাদের সমস্ত স¤পদ মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য মসজিদ, জ্ঞানকেন্দ্র নির্মাণ ও কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার অঙ্গীকার করেছিলেন, যা ছিল ফাতিমা আল-ফিহরির শিক্ষা ও ধর্মের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এই ভালোবাসার জন্যই তিনি আর দশ জন ধনাঢ্য মহিলার মত পার্থিব চিন্তা না করে বৃহত্তর কল্যাণের চিন্তা করেছিলেন। মুসলিম সভ্যতার বিকাশে নারীদের অবদান যে প্রণিধানযোগ্য তা ফাতিমা আল-ফিহরির এই চ্যালেঞ্জই প্রমাণ করে। তার কল্যাণমূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল মসজিদ, লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ। সেই ৮৫৯ সালে তিনি চিন্তা করেছিলেন এমন অত্যাধুনিক লাইব্রেরি গঠনের যা নির্মাণ করা হয়েছিল প্রাচীন মোজাইক, টাইলস, সিরামিক, কাঠের রেলিং, বিভিন্ন ভাস্কর্য, উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ও অন্যান্য আধুনিকতার সমন্বয়ে, যা বর্তমানের যেকোনো সর্বাধুনিক স্থাপত্যকেও হার মানায়। এর মূল চত্বরে একটি ঝরনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই স্থাপনা পুনঃনির্মাণ করতে গিয়ে এগুলোর অস্তিত্ব দেখে কর্তৃপক্ষ মুগ্ধ হয়ে এর মূল আকৃতি ঠিক রেখে নতুন টেকসই প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কিছুই প্রমাণ করে ফাতিমা আল-ফিহরি ছিলেন সৃজনশীল, অত্যাধুনিক ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী ।
লাইব্রেরিতে প্রায় ৪০০০ দুর্লভ বই, সপ্তম শতাব্দীর অনেক মূল্যবান পা-ুলিপিসহ ধর্মতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আইনবিষয়ক অনেক পা-ুলিপি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ইবনে খালদুনের প্রধান পা-ুলিপি মুকাদ্দামাহ, নবম শতাব্দীর কিউফিক ক্যালিওগ্রাফিতে লেখা পবিত্র আল কুরআনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় এই লাইব্রেরিটিতে। ইসলামী জ্ঞান সংরক্ষণে বই, পা-ুলিপি ও প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। ফাতিমা আল-ফিহরি তা চিন্তা করেই তার তৈরি করা লাইব্রেরিতে এসব দুর্লভ সংগ্রহ সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।
তিনি ইসলামী শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই বিদ্যাপীঠ থেকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, ইতিহাসবিদ, জ্যোতির্বিদ ও বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়ে চলেছে যারা জ্ঞান বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত। এই মহীয়সী নারীর জীবন ইতিহাস আমাদের নারীসমাজকে শিক্ষা দেয় কিভাবে জীবনকে প্রকৃতপক্ষে মানবকল্যাণে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সমর্পণ করা যায়।

Share.

মন্তব্য করুন