জোসনা রাত। রূপময় চাঁদ যেন পৃথিবীর দিকে ফিরে হাসছে। সে হাসির দ্যুতি সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সাথে সাথে এই সবুজের পৃথিবীকে সে যেন নতুন করে সাজিয়ে তোলে। এমন জোসনা রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে?
রাহীর বয়স এখন দশ বছর। বয়স কম হলে কী হবে [?] বুদ্ধি শুদ্ধিতে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। অস্থির চঞ্চল এবং চপল। সারাদিন ঠাস ঠাস করে কথা বলে যায়।
এখন সে ক্লাস টুতে পড়ে। ক্লাসের প্রথম। চঞ্চল হলেও লেখা পড়ার ভীষণ মনোযোগী। স্কুলের পড়া না করে সে কখনো ঘুমায় না। সানজিদা পাশে বসে বসে রাহীকে সহযোগিতা করে। ওর লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে সানজিদার খুব ভালো লাগে। মনে মনে পুলকিত হয় সে। স্বপ্নের সোনালি রোদে নিজেকে এলিয়ে দেয়।
আজ কেন জানি পড়াশোনার প্রতি রাহীর মনোযোগ নেই। এমনটা কেন হচ্ছে সে নিজেও জানে না। তাই বার বার মার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। সে মাকেও কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। কিভাবে সে বলবে ‘মা আমার পড়তে ভালো লাগছে না। চলো আমরা বাইরে জোসনায় বসে বসে গল্প করি।’
সানজিদা ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে। তার এলোমেলো মন। এখন আর পড়ায় তার মন বসছে না। কী যেন ভাবছে রাহী। সানজিদা রাহীর দিকে তাকিয়ে বললোÑ কী ব্যাপার! তুমি আজ আনমনা কেন। পড়ার প্রতি মনোযোগ নেই। কী ভাবছো?
রাহী হাসতে হাসতে বললোÑ কিছু বলবা নাতো মাÑ?
Ñ আরে নারে বাবা। কী বলবো তোমাকে?
Ñ না মানে রাগ করবাÑ।
Ñ না না, কথা দিলাম রাগও করবো না।
সানজিদা জানে রাহী কখনো বাহুল্য কথা বা মিথ্যে কথা বলে না। এমনকি কেউ ওর সাথে মিথ্যে বললে ও একেবারে কেঁদে ফেলে।
কিছুটা ইতস্তত করে বলতে যেয়ে আবার থেমে যায় সে। সানজিদা কাছে টেনে কোলে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেÑ এবার বলো লক্ষ্মী বাবা আমার।
রাহী সাহস পেয়ে বলেÑ আম্মু আজ আর আমার পড়তে মোটেই ভালো লাগছে না।
Ñ সানজিদা হেসে বলেÑ তাহলে?
রাহী আনন্দে গদ গদ হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলেÑআম্মু চল না আমরা উঠোনে যেয়ে বসি।
Ñ কেন বাবা?
Ñ আমার জোসনা খুব ভাল লাগে।
– তাই বুঝি?
– হ্যাঁ আম্মু।
– বসে বসে আমরা কি করবো?
– তোমার মুখ থেকে গল্প শুনবো। কতো দিন হলো তোমার কাছ থেকে গল্প শুনিনি। তোমার মুখ থেকে গল্প শুনতে সত্যি আমার খুব ভালো লাগে।
সানজিদা হেসে ওঠে। তাই বুঝি? তা বেশতো। তাহলে চলো আমার সাথে। আমরা জোসনায় বসে বসে গল্প করি।
সানজিদা রাহীকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে। জোসনার আলো যেন সবুজ বৃক্ষের ঘন পাতা ভেদ করে হাসতে হাসতে নিচে নেমে আসছে। এই সবুজ আচ্ছাদিত পৃথিবীকে তার আলোয় গোসল দিচ্ছে। আহ কি চমৎকার! এ ভালো লাগা কেবল রাহীর না। এ ভালো লাগা তার নিজেরও কম না।
কতো দিন হলো এভাবে বাইরে বসে বসে এক মনে জোসনা দেখা হয়নি। আগে নিয়মিত শ্বশুরের পাশে বসে বসে জোসনা তাঁর গল্প শুনতে হতো। অনেক সময় রাত জাগার ক্লান্তিতে বার বার হাই তুলেছি। তবুও তিনি আমাকে ছুটি দিতেন না।
শ্বশুরের কথা মনে হতেই সানজিদার হৃদয়টা দপ করে কেঁপে ওঠে। সত্যিই তিনি ছিলেন একজন বড় গুণী ব্যক্তি। তাঁর প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। শত কষ্টের মাঝেও তিনি হাসতে জানতেন। নিজের দুঃখ এবং যন্ত্রণাকে কিভাবে বুকে লুকিয়ে বাঁচতে হয় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।
আমি যখন এ বাড়িতে আসি তখন আর কেউ ছিলো না। একমাত্র বেটার বউ হিসেবে আমার ওপর চাপটা একটু বেশি থাকতো। যখন ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন তিনি কাছে বসিয়ে আপন মেয়ের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতেন। খাওয়া দাওয়া গোসল ইত্যাকার সব বিষয়ের ভালো মন্দের প্রতি তিনি নজর রাখতেন। একটু মন খারাপ হলেই তিনি বুঝতে পারতেন। সাথে সাথে এমন গল্প বলতেন যা শুনে মনটা হালকা হয়ে যেত। সত্যি এমন মানুষের সাহচর্য পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সানজিদা ভাবছে আর ভাবছে। আজ আর সেই গুণী মানুষটি দুনিয়াতে নেই। দৃষ্টিসীমার বাইরে তিনি। অথচ তার ব্যবহারের কথা আজো ভুলতে পারিনি। সে বিষণ হয়ে যায়। অস্ফুটে বলে- আহা আমিও যদি এমন মানুষের মতো হতে পারতাম-।
রাহী মুখে চুমো দিয়ে বললো- কী হলো আম্মু তুমি চুপ করে আছো কেন?
– এমনিতেই।
– কেন তোমার ভালো লাগছে না-?
– হ্যাঁ বাবা, খুব ভালো লাগছে।
– তাহলে একটা গল্প বলো না আম্মু।
– গল্প! কী গল্প করবো এখন?
– রাহী চোয়ালে আঙুল রেখে প-িতের মতো বলে হুম-তাহলে দাদু ভাইয়ার গল্প করো।
সানজিদা অবাক হয়ে গেল। রাহী কি তার মনের খবর তাহলে জেনে গেছে? নইলে ও কিভাবে বুঝলো যে আমি ওর দাদু ভাইকে নিয়েই এতক্ষণ ভাবছি?
– কি হলো আম্মু। তাহলে শুরু করো।
– হ্যাঁ বাবা। গল্পতো করবো কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো তাই ভাবছি।
– দাদু ভাইয়ের কি অনেক গল্প আছে?
– হ্যাঁ-।
– বেশ। তাহলে একটু ভেবে নাও। তারপর শুরু করো।
একদিন দুপুর বেলা।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখি তোমার দাদু যেন কার সাথে গল্প করছেন। আমি আড়াল থেকে দেখলাম একজন ভিক্ষুক বসে বসে এক মনে তার কথা শুনছে। তারপর হঠাৎ করে ভিক্ষুক উঠে দাঁড়ায়। তোমার দাদু তার দিকে তাকিয়ে বলেন- উঠছো কেন গো? কোথায় যাবে?
ভিক্ষুক আস্তে করে বললো- বেলা বয়ে যাচ্ছে আর একটু বেরিয়ে তারপর-
– তা যাবে তো। তোমার ক্ষতি করবো কেন? তবে এখনতো দুপুর। খাওয়ার সময়।
– না চাচা থাক।
– তা হয় না গো তা হয় না। খাওয়ার সময় মেহমান হাতে পেয়ে কিন্তু আমি ছাড়ছি না। তোমাকে বাবা দু’মুঠো খেয়ে যেতে হবে।
ভিক্ষুক ইতস্তত করতে লাগলো। তোমার দাদু একটু শব্দ করে আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে আসতেই দেখিয়ে দিলেন ভিক্ষুককে।
অনেক সময় উনি ইশারায় কথা বলতেন। দীর্ঘদিন পাশে থাকার কারণে আমি তার অনেকটাই বুঝতাম। তিনি ইশারা করে বললেন খাবার দিতে।
আমি দ্রুত ভিক্ষুককে খাবার দিলাম। এভাবে তিনি উঁচু নিচু বুঝতেন না। বুঝতেন ভালো কাজ। ভালো কিছু করার তার বড় কাজ ছিল।
রাহী মার কাছ থেকে দাদু ভাইয়ের এসব গল্প শুনে অবাক হয়। মনে মনে ভাবে- আহা দাদু ভাইয়ের মতো এমন মহৎ মানুষ যদি হতে পারতাম-! এমন গুণী মানুষ আমাকেও হতে হবে।
সানজিদা রাহীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে কি ভাবছ বাবু? আম্মু আমি ভাবছি- আমাকে দাদু ভাইয়ের মতো হতে হবে। গুণী মানুষ হতে হবে। মানুষকে ভাল বাসতে হবে।
সাথে সাথে সানজিদা যোগ করে দেয়- তোমাকে তার জন্য সাধনা করতে হবে এবং লেখাপড়া আরো বেশি করে করতে হবে। তাহলে তুমি তোমার দাদু ভাইয়ের মত হতে পারবে।
রাহী বলে দোয়া করো আম্মু- আল্লাহ যেন আমাকে- দাদু ভাইয়ের মত ভালো মানুষ বানায়।

Share.

মন্তব্য করুন