বিছনাকান্দি, স্রষ্টার এক অপরূপ সৃষ্টি। ছোট বড় পাথর, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ নীল পানি, ওপাড়ে অবস্থিত মেঘালয় রাজ্যের মেঘের সারি। সব মিলিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সৌন্দর্যের মা খ্যাত বিছনাকান্দি এলাকাটি। বিছনাকান্দি নামটার সাথেই সাথেই সৌন্দর্যের এক সম্পর্ক থেকে যায়, যেন সৌন্দর্যের বিছানা।
আমরা যখন এই সিলেটের মানুষ তখন সিলেটের সবচেয়ে সুন্দর ও দর্শনীয় এই স্থানটি না দেখলে কি হয়? তাই বেরিয়ে পড়লাম প্রিয় বন্ধুদের সাথে অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে আর সৌন্দর্যকে অবলোকন করার উদ্দেশ্যে। আমরা সদস্যসংখ্যা ৯ জন ছিলাম। সবাই আমার মত অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমী, সবাই স্রষ্টার সৃষ্টিকে দেখতে আগ্রহী, নতুন কিছু জানতে আগ্রহী, অবলোকন করতে চাই সৃষ্টিকে। তাই দেরি না করে প্রিয় বন্ধুদের সাথে অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে তৈরি হলাম আমিও। একদিনের ভেতরেই গাড়িসহ সব ধরনের প্রস্তুতি সারলাম। আমরা সদস্যসংখ্যা একটু বেশি থাকায় রিজার্ভ করলাম একটি বড় গাড়ি। সব প্রস্তুতি শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম ২৪ মে ২০১৭ তারিখে। আমাদের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে। বিয়ানীবাজার থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় পৌঁছাতে সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টার মত। তাই সকাল ৮টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বিয়ানীবাজার থেকে সিলেট শহর হয়েও যাওয়া যায়, আবার সিলেটের বাইপাস রোর্ডের পাশের সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট রোড দিয়েও যাওয়া যায় গোয়াইনঘাট। আমরা সেনা ক্যান্টনমেন্ট রাস্তা দিয়েই পথ চললাম। যেহেতু এটা আমাদের জন্য সহজ রাস্তা।
স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এই দিন আমাদের একটি ভ্রমণ উপযোগী আবহাওয়া করে দেয়ার জন্য। সকালবেলা বের হলাম বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যার কারণে গরমের কবলে আমাদের পড়তে হলো না। একটু পরই সিলেটের কাছাকাছি এলাকায় পৌঁছাতেই সূর্যমামা আকাশের মেঘের বুক চিরে হাজিরা দিলেন সোনালি মিষ্টি রৌদ্র নিয়ে। এ রকম সুন্দর আবহাওয়ায় পথ চলতে লাগলাম আমরা। গাড়ির বাইরের চার দিকের সৌন্দর্য অবলোকন করছি। দেখতে পাচ্ছিলাম উঁচু নীল পাহাড়ের চূড়ায় সাদা তুলোর মত মেঘরাশি। যত এগোচ্ছি পাহাড় আরো তত কাছে আসছে আর মেঘ সরে যাচ্ছে দূরের গহিন সীমানায়। আর মনে মনে স্রষ্টার প্রশংসায় অতল হচ্ছি এই জন্য যে, এইরকম একটি সুন্দর পৃথিবী আমাদের উপহার দেয়ার জন্য। বিশেষ করে সকল দেশের রানী আমাদের এই মাতৃভূমিকে এতো সুন্দর করে সাজানোর জন্য।
নীল পাহাড় আর সাদা মেঘরাশির সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে পৌঁছালাম হাদারপার বাজার। এখান থেকে বিছনাকান্দিতে নৌকা করে যেতে হয়। হেঁটেও যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে নীল পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা জলরাশি তথা ঝর্ণার সৌন্দর্য আরো বেশি করেই অনুধাবন করা যায়। কিন্তু তাতে সময়ের প্রয়োজন হয় অনেক বেশি। তাই আমরা নৌকা দিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাতে সময় ব্যয় হবে মাত্র ৩০ মিনিট এবং পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ নীল পানিও দেখে আসতে পারবো। নৌকা ভাড়া নিলো ৬০০ টাকা আপডাউন। এর মধ্যে আবারও মেঘরাশির সাদা মেঘ নিচে নামলো বৃষ্টি হয়ে। বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় লেগে থাকা মেঘের দৃশ্য দেখতে সত্যিই অপরূপ! এভাবে কিছুক্ষণ কাটার পর বৃষ্টি বন্ধ হলো।
আমরা নৌকায় উঠে পড়লাম। নৌকায় যেতে যেতেই আবারও সূর্য মামা উঁকি দিলো। প্রায় ৩০ মিনিট পর আমরা পৌঁছালাম বিছনাকান্দিতে। নৌকা থামার সাথে সাথেই লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম প্রকৃতির অপ্সরা বিছনাকান্দিতে।
জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে পাথরের টুকরা। পাথর ছুঁয়ে পানি গড়িয়ে মিশে যাচ্ছে স্রোতস্বিনীতে। সেই পাথর ছোঁয়া পানিতে অপরূপ রূপ ধারণ করেছে প্রকৃতির অপ্সরা বিছনাকান্দি। ডুবু ডুবু পাথর আর পানিখেলার দৃশ্যে এ অপ্সরা মুহূর্তেই মন কেড়ে নেয় আমাদের মত সৌন্দর্য পিপাসুর।
দূরের চেরাপুঞ্জি আর কাছের মেঘালয় পাহাড় ঘেঁষে নেমে আসা ঝর্ণার জল আর পাথুরে বিছানায় বিছনাকান্দির নিবাস, যা সত্যিই মন কেড়ে নেয়ার মত। আর অগভীর এই স্বচ্ছ শীতল পানিতে যে কেউই গা ভাসিয়ে প্রকৃতির কোলে চড়তে চাইবেন। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। তাই কাপড় বদল করেই নেমে পড়লাম স্বর্গীয় পিয়াইন নদীর নীল পানিতে। প্রচ- স্রোতের এই শীতল পানিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন। তারপরও পাথরকে আঁকড়ে ধরে স্রোতের সাথে প্রায় যুদ্ধ করেই সাঁতার কাটছিলাম পিয়াইনের নীল পানিতে। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
আর ওদিকের দুই পাড়ের পাহাড়ের চূড়ায় লাল ঝুলন্ত সেতুর সৌন্দর্যও ভাল লাগার মত। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেই ঝুলন্ত সেতুতে ওঠা যায় না। এটা শুধু বিজিবি ও বিএসএফের জন্য নির্ধারিত।
এভাবে অনেক সময় ব্যয় করার পর ঘণ্টা বাজলো বিদায়ের! পাথরের বিছানা, সৌন্দর্যের মা খ্যাত বিছনাকান্দির অপরূপ প্রকৃতির কোল থেকে ফিরে আসার জন্য প্রস্তুতি নিতে হলো। তাই উঠে পড়লাম নৌকায়। তবে আরেক দিন গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দির পিয়াইনের স্বচ্ছ পানিতে গা ভাসানোর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম।
বহু মজা, আনন্দ-ফুর্তির সাথে নতুন অনেক কিছু শিখলাম প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে। ও হ্যাঁ, বন্ধুদের নামই তো বলা হলো না। তারা হচ্ছে : আলামিন, শিপু, জুনেদ, রাহিম, মাসুম, ইউনুছ, সাব্বির ও হাফিজ।
নৌকা করে হাদারপার বাজারে পৌঁছে আমাদের রিজার্ভকৃত গাড়িটি নিয়ে রওয়ানা দিলাম বাড়ির পথে। আর শুকরিয়া আদায় করতে লাগলাম মহান আল্লাহ তায়ালার যিনি আমাদের এই রকম একটি ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছেন।

Share.

মন্তব্য করুন