রাত এগারোটা। সদরঘাট টার্মিনালের এক কোনায় বসে আছি। বারোটার লঞ্চ ধরে চাঁদপুর যাবো। চাঁদপুর আমার নানুবাড়ি। নানুবাড়ি থেকে বিশ টাকা বাস ভাড়া তারপর পঁচিশ টাকা সিএনজি ভাড়া দিলে দাদুবাড়ির দরজায় কড়া নাড়া যায়। আজ আমি নানুবাড়ি দাদুবাড়ি কোথায়ও যাবো না। আজ যাবো ফিরোজের কাছে। একসময় আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো ফিরোজ। আমার চেয়ে দুই বছরের বড় হলেও একই ক্লাসে পড়তাম আমরা। দু’ বছর হলো ওর সঙ্গে তেমন মেশা হয় না। দেখা যে হয় না তা নয়। পিইসি পরীক্ষার পর ও পড়াশুনা ছেড়ে দেয়। কতজন কতভাবে বোঝালো- ‘পড়াটা ছাড়িস না’, কে শোনে কার কথা? একদিন আমিও বলেছিলাম, ‘দোস্ত! স্কুলে ভর্তি হয়ে যা; এখনো সময় আছে।’
‘পড়ালেখা আমার ভালো লাগে না।’
‘কী করবি?’
‘কাজ করব।’
‘কোথায়?’
‘খলিল কাকার চায়ের দোকানে।’
অনেক বোঝালাম। কাজ হলো না। এক বছর পরের কথা। কী কাজে যেন আব্বুর সঙ্গে বাজারে গেলাম। দেখি দোকানের পেছনে বসে ফিরোজ সিগারেট টানছে। আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। আমার বেস্টফ্রেন্ড সিগারেট টানছে! এই সময় তো ওর হাতে বই থাকার কথা। লুকিয়ে লুকিয়ে ‘রোমাঞ্চ’ পড়ার কথা। বই না পড়–ক, অন্তত গেমসে তো ডুবে থাকতই। হায়! সে কিনা কাজের ফাঁকে সিগারেট টানছে? সেদিন থেকেই ওর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা মরে গেছে। শেষ যখন ওর সঙ্গে কথা হয় তখন বললাম, ‘দোস্ত! তুই সিগারেট খাস?’
‘ধুর! কে বলল?’
‘আমি দেখেছি।’
ফিরোজের চেহারা শক্ত হয়ে গেল। পকেট থেকে এক শলা গোল্ডলিফ বের করে মুখে পুড়ল। সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘দেখেই যেহেতু ফেলছিস, তাহলে তো লুকানোর কিছু নেই।’
সিগারেটের ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। আমার সামনে আমার বেস্টফ্রেন্ড সিগারেট খাচ্ছে! ভেতরের তোলপাড়কে আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল ফিরোজের এই কথাগুলো- ‘পড়ালেখার চেয়ে সিগারেটের জীবন অনেক সুখের। তোরা যে লেখাপড়া করছিস, তোদের জীবনে কোনো আনন্দ আছে? আমাকে দেখ! মনে আনন্দ, পকেটে টাকা- কোনোটারই অভাব নেই। ইচ্ছে হলে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি। যা খুশি করতে তাই পারি। আর তোরা? বইয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট জীবনে না আছে আনন্দ না আছে স্বাধীনতা। শালার পড়ালেখার খ্যাতা পুড়ি।’
এবার আমার সম্পর্কে কিছু বলি। আমি ইফতি। পড়ি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। এ বছর জেএসসি পরীক্ষা দেবো। পরীক্ষার আর মাত্র ছয় মাস বাকি। সারা দিন পড়া আর পড়া। ক্লাস-কোচিং-প্রাইভেটের ধকল সামলানোর পর আবার আম্মুর কাছে বসতে হয় বই-শিটের পাহাড় নিয়ে। একবিন্দুও অবসর পাই না। শান্তিমত গেমসও খেলতে পারি না। ট্যাব নিয়ে বসলেই আম্মু কটকটির মত হুঙ্কার দিয়ে বলে, ‘মাত্র দশ মিনিট’। আচ্ছা আপনারাই বলেন, গেমস খেলতে বসলে কি দশ মিনিটে উঠা যায়? না, যায় না। তারপরও চোখমুখ বুজে পনের মিনিট শেষে আম্মুর হাতে স্বাদের ট্যাবখানা হ্যান্ডওভার করে আবার পড়তে বসি। মিশন এ প্লাস। এই ‘এ প্লাসের’ জন্য আব্বু-আম্মু রীতিমত আমার পেছনে উঠে পড়ে লেগেছে। তবে এখন থেকে আর কোন টেনশন নেই। আজ থেকে আমি ফ্রি। এই যে বিকাল থেকে পড়তে বসিনি, সন্ধ্যায়ও পড়িনি, এখন সাড়ে এগারোটা বাজতে চলল; ‘ঘুমিয়ে পড় ইফতি’ বলে কেউ কান ঝালাপালা করে ফেলছে না। জীবনের আনন্দ তো এখানেই। এই স্বাধীনতা পেয়েই তো ফিরোজ আজ সুখী মানুষদের একজন। আমিও চাই সুখী হতে। ফিরোজের মত সুখী। পকেট ভর্তি টাকা থাকবে। মন চাইলে একটা-দুটো সিগারেটও ধরাতে পারি। এত অল্প বয়সে কি সিগারেট ধরা ঠিক হবে? জানি না। মূলত এ জন্যই ফিরোজের উদ্দেশ্যে আমার যাত্রা। কোন এক দোকানে কাজ ঠিক করে তারপর আমিও পড়ালেখার খ্যাতা পুড়ব।
এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয় বুঝে গেছেন আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। বাসা ছেড়ে পালানো কিন্তু মোটেও খারাপ কাজ নয়। যদি তাই হতো তবে নজরুল বেচারা কেন বাড়ি থেকে পালিয়েছেন? পালিয়েছেন ভালো কথা। এক পুলিশ অফিসার তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। নজরুল সেখান থেকেও পালিয়েছেন। এই ছেলেটাই পরবর্তীতে কাজী নজরুল হিসেবে ইতিহাসের খাতায় সোনার অক্ষরে নাম লিখিয়ে নিলেন! সত্যি বলতে কী বাসা থেকে পালানোর প্রেরণাটা আমি কাজীদার থেকেই পেয়েছি। একদিন আমারও নাম হবে। বই বেরোবে। সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। আপনারা যারা আজ আমার ওপর চটে আছেন, ভাবছেন, বাসা থেকে পালিয়ে ছেলেটা কী ভুলই না করল; সেদিন এই আপনারাই আপনাদের নাতি-নাতনীদের বলবেন, ‘দেখ! দেখ! বাসা থেকে পালিয়েও ইফতি আজ সফল মানুষ। আর তোমরা? এতসব সুযোগ-সুবিধা পেয়েও দিন দিন গাধা আর বেকুব ছাড়া কিছুই হচ্ছো না।’
লঞ্চে উঠব এমন সময় কে যেন পেছন থেকে জামা টেনে ধরল। বুকটা ধক করে উঠল। বাবা নয় তো? এই বাবার জ্বালায় আর পারা গেল না। খুঁজতে খুঁজতে এখানেও চলে এসেছে। মিশন স্বাধীনতা বুঝি ভেস্তেই গেল। আবার শুরু হবে পড়ার পাহাড়ে পিষ্ট হওয়া। দুরু দুরু বুকে পেছন ফিরে তাকালাম। না, বাবা নয়। তবে বাবার মতই একজন। উস্কো খুস্কো চুল। মলিন চেহারা। সারাদিন বোধ হয় কিছু খায়নি। পোশাক-আশাক দেখে মনে হচ্ছে বাবার মতই বড় কোন অফিসে চাকরি করেন। তাহলে এমন দেখাচ্ছে কেন ওনাকে? এসব ভাবতে ভাবতে মিষ্টি হেসে ভদ্রলোককে বললাম, ‘আঙ্কেল! কিছু বলবেন?’
ভদ্রলোক কিছু বলতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে একজন মহিলা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার চোখে মুখে চুমু খেতে খেতে বলল, ‘খোকা! তুই এলি? তুই এখানে কেন? বাসায় চল। তোর জন্য কত খেলনা সাজিয়ে রেখেছি জানিস? তোর না কর্ন স্যুপ অনেক পছন্দ? আমি বানিয়ে রেখেছি। চল, বাসায় চল।’
কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। মহিলার অদ্ভুত আচরণের রহস্য বুঝতে পারলাম আঙ্কেলের কথা শুনে। আঙ্কেল অনেকটা অপরাধীর ভঙ্গিতে বললেন, ‘বাবা! কিছু মনে করো না। তোমার মত আমাদেরও একটি ছেলে আছে। আজ পনের দিন হল পাজিটা রাগ করে বাসা ছেড়েছে। কত জায়গায়-ই না খোঁজলাম। পোড়া কপাল! আমার ছেলের কোন সন্ধান পাইনি। এই যে মহিলাকে দেখছ, ও আমার ওয়াইফ। ছেলেকে হারিয়ে পাগল হয়ে গেছে। তোমার বয়সী কোন ছেলেকে দেখলেই নিজের ছেলে মনে করে বাসায় নিয়ে যেতে চায়।’
এবার মহিলার দিকে তাকালাম। এতক্ষণে তিনি বুঝতে পেরেছেন আমি তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে নয়। তাই একটু দূরে গিয়ে অনেকটা লজ্জায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মহিলাকে দেখে কেন যেন আম্মুর কথা মনে পড়ে গেল। আঙ্কেল দুঃখ প্রকাশ করে বিদায় নিলেন। বললেন, ‘এক্সট্রিমলি স্যরি বাবা! লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। যাও তোমার আব্বু-আম্মু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
আব্বু আম্মুর কথা শুনতেই ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল। কী করছে আব্বু? আমাকে খুঁজতে কী এখনো বাইরে বাইরে ঘুরছে? আব্বুর সঙ্গে কি আম্মুও আছে? আমার মত কোন ছেলেকে দেখে আম্মুও কী ওই মহিলার মত জড়িয়ে ধরেছে? গালে-মুখে চুমে খেয়ে বলেছে- ‘চল খোকা! বাসায় চল।’ যখন বুঝবে জড়িয়ে ধরা ছেলেটি তার খোকা নয় তখন কি আম্মুও লজ্জায় কুঁকড়ে যাবে? আব্বু স্যরি বলবে ছেলেটিকে? মনে হয় না এমন কিছু হবে। সব বাবা-মা তো একরকম নয়। আমার আব্বু আম্মু হয়তো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে এখন নাকে তেল দিয়ে এসি ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল সকাল উঠে আব্বুকে অফিসে যেতে হয়। রাত বারোটা অবধি জেগে থাকা তাই বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। বড়জোর খবরের কাগজে একটি বিজ্ঞাপন এবং থানায় একটি ডায়েরি করার মাধ্যমেই আব্বু তার দায়িত্ব শেষ মনে করবে। যাই হোক, মিশন স্বাধীনতা আপাতত বন্ধ হচ্ছে না। অর্থাৎ বন্ধ হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না।
ঘড়ির কাঁটা এখন ১১টা ৫৯ মিনিটের ঘরে। লঞ্চ ছাড়তে আরো এক মিনিট বাকি। এতক্ষণ লঞ্চের প্রবেশদ্বারেই দাঁড়িয়েছিলাম। যাই, দোতলায় গিয়ে সুবিধামত যায়গায় বসে পড়ি। আশ্চর্য! এবারো পেছন থেকে শার্টে টান পড়ল! এবার আর বিরক্ত হলাম না। পেছনে না ফিরেই বলতে পারি এটা আম্মুর হাত। আম্মুর গলা ‘ইফতি! বাসায় চল বাবা!’