ছোটবেলায় অনেকটা সময় কেটেছে নানাবাড়িতে। আমার নানাবাড়িটা একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অজপাড়াগাঁ বললেও কম বলা হবে। পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। রাতের বেলা দূরে মাঠের মধ্যে সেচঘরে একটা বাতি জ্বলতে দেখা যায়। সন্ধ্যা গড়ালেই পুরো গ্রামে শুরু হয় রাত্রিযাপনের প্রস্তুতি। খেটে খাওয়া মানুষগুলো সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই সন্ধ্যা হলেই সবাই কুপি জ্বালিয়ে খাবার পর্ব শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
এশার আজান হওয়ার আগেই পুরো গ্রামজুড়ে সুনসান নীরবতা। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়। মাঠে শেয়ালগুলো হুক্কাহুয়া ডাকতে থাকে। একটু পরেই সবার ঘরে ঘরে জ্বলতে থাকা কুপিগুলো আস্তে আস্তে নিভে যায়। অন্ধকারে ছেয়ে যায় পুরো গ্রাম। রাতে তেমন কেউ বের হয় না প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া। চারিদিকে খোলামাঠ। মাঝখানে একটা বিশাল দিঘী। পাশে একটা পুরনো মাজার। দিঘীটার কোল ঘেঁষেই ১০-১২টা ঘর নিয়েই গড়ে উঠেছে গ্রামটা।
দিঘীটাকে কেন্দ্র করে গ্রামটা গড়ে উঠায় গ্রামের নাম কুড়োলদিঘী। কিন্তু প্রশ্ন জাগতেই পারে দিঘীটার নাম কুড়োলদিঘী কেন হলো? কথিত আছে অনেক বছর আগে এই দিঘীর পাড়ে এক কাঠুরিয়া কাঠ কাটতো। প্রতিদিন সে গাছ কাটার পর তার কুড়ালটা পাশে রেখে একটু বিশ্রাম করতো। দিঘীটার পাড় ঘেঁষেই ছিল উঁচু উঁচু গাছের সারি। শাল, মেহগনি, শিশু, কড়ই অনেক প্রজাতির গাছ ছিল সেখানে। গ্রামের লোকেরা উঁচু ঘন গাছপালার এই সারিগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ‘ডাইং’ বলে। একদিন কাঠুরিয়া দিঘীটার কিনারায় একটা বড়সড় উঁচু শালগাছ দেখতে পেল। দেখে কাঠুরিয়ার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আর ভাবলো এই গাছটা কেটে বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কাঠুরিয়া তার কুড়ালটি নিয়ে গাছটির জড় কাটতে শুরু করল। গাছটি ছিল বিশাল। জড়মূলগুলো বেশ কিছু জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। কাঠুরিয়া তার কুড়াল দিয়ে জড়মূলে আঘাত করল। কিন্তু জড়টা কাটলো না বরং বাউন্স হয়ে কুড়ালটা ছিটকে গেল। আবারো আঘাত করলো নাহ কাটলোই না। কাঠুরিয়া কুড়ালের ধার ঠিক আছে কিনা পরখ করলো। কাঠুরিয়ার এত বছরের অভিজ্ঞতায় এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি কখনো, ধারও ঠিক আছে কিন্তু কাটছে না কেন? কাঠুরিয়া সাত-পাঁচ না ভেবে আবারও কোপ দিল। কোপ দেয়ার সাথে সাথে কুড়ালটা ছিটকে দিঘীতে পড়ে গেল। কাঠুরিয়া হায় হায় করতে লাগলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কুড়ালটি না পেয়ে বাড়ি চলে গেল। পরে যতগুলো কাঠুরিয়া দিঘীর পাড়ের ঐ শালগাছটি কাটতে গিয়েছে সবাই একইভাবে তাদের কুড়ালটি হারিয়েছে। সেই থেকে দিঘীটার নাম কুড়োলদিঘী। শালগাছটি এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বছরের পুরনো গাছটি। কোনো এক অজানা রহস্যে ঘেরা শালগাছটি। গ্রামের লোকেরা বলে গাছটিতে প্রেতাত্মারা থাকে মধ্য দুপুর বেলায়। কেউ দুপুরে গাছটির আশপাশে গেলেই তার কোনো না কোনো ক্ষতি হয়। আর এমনটি হয়েছে তার প্রমাণও মিলেছে কিছু। নানাবাড়ির পাশের বাড়ির আদরি মামানি একদিন মধ্যদুপুর বেলায় দিঘীর পাড় থেকে তরতাজা কিছু পুঁইয়ের ডাঁটা কেটে নিয়ে এসেছিল রান্না করার জন্য। পুঁইয়ের ডাঁটা কিছু রান্না করে পরদিনের জন্য রেখে দেয়। দুপুরে খাবার পর প্রলাপ বকতে থাকে মামানি। চোখগুলো রক্তলাল হয়ে যায়, চুলগুলো এলোমেলো করে সবাইকে তাড়া করতে থাকে। গ্রামের মানুষ বুঝে নেয় নিশ্চয় প্রেতাত্মা ভর করেছে ওর ওপর। অনবরত বলতে থাকে পুঁইয়ের ডাঁটা যেখান থেকে নিয়ে এসেছিস রেখে আয় সেখানে। নয়তো তোর পরিণতি খারাপ হবে কিন্তু। আমার নানী ছিলেন খুব সাহসী। ভূত-প্রেতাত্মা দেখে মোটেও ভয় পায় না। নানী জিজ্ঞেস করে কোথায় পুঁইয়ের ডাঁটা রেখে আসবো? উত্তরে বলে- দিঘীর পাড়ে শালগাছটির নিচে রেখে আয়। এদিকে মামানির ঝাড়ফুঁক চলতে থাকে। পুঁইয়ের ডাঁটা রেখে আসে নানী। ঝাড়ফুঁক শেষে মামানির হঠাৎ চেতনা ফিরে আসে। এতক্ষণ প্রেতাত্মা ভর করে ছিলো। বাড়ি ভর্তি অনেক মানুষ দেখে বলে- তোমরা সবাই এখানে কেন? কার কী হয়েছে? পরে নানী মামানিকে সব ঘটনা খুলে বলে। তখন থেকেই ছোটবড় সবাইকে বারণ করা হয়েছিলো মধ্যদুপুর বেলায় দিঘীর পাড়ে শালগাছটির কাছে না যেতে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ঘটলো আরো একটা ঘটনা। একদিন কাশেম মামা হালচাষের বলদগুলোকে দিঘী থেকে গোসল করিয়ে বাড়ি ফিরছিল। তখন ছিল পড়ন্ত দুপুর বেলা। শালগাছটির কাছে আসতেই মামা শুনতে পেল একটা গোঙ্গানির শব্দ। ঠিক যেন ২-৩ বছরের ছোট বাচ্চা কাঁদছে করুণ সুরে। মামা হঠাৎ দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে থাকলো কোথা থেকে আসছে শব্দটা। আশপাশে তাকিয়েও শব্দের উৎস খুঁজে পেল না। এসময় মামা কি যেন ভেবে শালগাছটির মগডালের দিকে তাকালেন। তাকিয়ে যা দেখলেন তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ঠিক ২-৩ বছরের একটা বাচ্চা গাছের মগডালে ঝুলছে। পা দুটো গাছের সাথে আটকানো। মাথাটা নিচের দিকে ঝুলছে। চোখ দুটো পুরো কালো ভয়ঙ্কর। দেখে মামার জ্ঞান হারাবার অবস্থা। এক মুহূর্ত দেরি না করে বলদ দুটো ডাইং-এ রেখে মামা বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি আসে। তারপর সব ঘটনা খুলে বলে। আমার যদিও বিশ্বাস হয়নি এসব। একটা ছোট বাচ্চা কিভাবে বিশাল শালগাছের মগডালে উঠতে পারে। মামার ব্যাপারটা বিশ্বাস হলো না বরং কৌতূহল বাড়লো যে দুপুরে শালগাছে কি এমন পেতনি ভূত থাকে তাই দেখার। আহা মাজারের কথাতো বলতে ভুলেই গেলাম। দিঘীর পাড় ঘেঁষেই উঁচু জায়গায় ছিল একটা শত বছরের পুরনো মাজার শরিফ।
চারদিকে ছিল চুন সুরকির ইট দিয়ে ঘেরা রাজকীয় দেয়াল। মাঝখানে উঁচু ঢিবিতে কবরটা লালসালু দিয়ে ঢাকা। লোকমুখে শোনা যায় এটা নাকি হযরত সুলতান শাহ (র)-এর মাজার। ঝোপঝাড় ঘন জঙ্গলের ভেতর মাজারটা। মাজারের পাশেই ছিল বিশাল একটা জামগাছ। অনেক আগে বিভিন্ন উৎসবে এই জামগাছের তলায় নাকি মেলা বসতো। হরেক রকমের জিনিসপত্র বেচাকেনা হতো এখানে। বেচাকেনার মধ্যে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ছিল অন্যতম। আমি ছোট থেকেই খুব ডানপিটে ছিলাম। ছোটবেলার খেলার সাথী ছিল দুইজন হারুন আর কালু। তিনবন্ধু মিলে সকাল থেকে সারাদিন হইচই টইটই করে কাটাতাম। মাজারে ঝুপড়ির আড়ালে লুকোচুরি খেলতাম। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে পাখির বাসা বানাতাম। মাজারের ভেতরের ঝোপঝাড়গুলো কেটে পরিষ্কার করতাম। মাটি খুঁড়ে পরিষ্কার করার সময় মাটির তৈরি অনেক পুরনো খেলনা পেতাম। খেলনাগুলোর মধ্যে ছিল মাটির তৈরি ভাঙাচোরা হাতির শুঁড়, ঘোড়ার পা, পাখির ঠোঁট, ছোট ছোট মাটির কলস আরো অনেক কিছু। এগুলো সবই ছিল মেলার নিদর্শনস্বরূপ। দুপুরে তিন বাউ-ুলে মিলে দিঘীতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কাটতাম। সাঁতার কেটে কে কতদূর যেতে পারে বাজি ধরতাম। কাদা ছোড়াছুড়ি খেলতাম। গোসল শেষে চোখ লাল করে যে যার মত বাড়ি ফিরতাম। এগুলো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। একদিন তিন বন্ধু মিলে ফন্দি আঁটলাম আজ গোসল শেষে বাড়ি যাবো না। আজ দেখবো দুপুর বেলায় শালগাছে কি থাকে। আমরা তিন বন্ধুই ছিলাম খুব সাহসী। হাঁটতে লাগলাম শালগাছের দিকে। শালগাছের পাশেই ছিল একটা ঝোপ। শালগাছের কাছে যেতেই ঝোপের আড়ালে তিন বন্ধু লুকিয়ে গেলাম।
আজ দেখবো দুপুরবেলায় কি সব অদ্ভুত কা-কারখানা হয়। চুপচাপ নিস্তব্ধ সবাই। কোনো সাড়া শব্দ নেই। শালগাছেও কিছু নেই। অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। পরে ভাবলাম নাহ আসলে কিছুই নেই। সব মনের ভুল। আজগুবি সবার কথাবার্তা। চল গাছের নিচে যাই। কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু হবে না। ঝোপ থেকে বের হয়ে শালগাছের দিকে পা বাড়ালাম তিন বন্ধু। কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে হাঁটছিলাম। শালগাছের কাছে আসতেই হারুন বলে- দেখ গাছের নিচে চুলের মত কি যেন ঝুলছে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে চোখ তুলে উপরের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম দেখে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যাবার অবস্থা। সাদা কাপড় পরিহিত একটা মহিলা মগডালে বসা। মুখটা দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। লম্বা কালো চুলগুলো ওপর থেকে ঝুলে একদম মাটি ছুঁই ছুঁই। নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তার আগেই মা-রে বলে একটা চিৎকার দিয়ে দিলাম ছুট। কালু আর হারুনও দৌড়াতে লাগলো আমার সাথে। ঝোপঝাড় না দেখে পাগলের মত ছুটতে লাগলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি এসে কাঁপতে থাকলাম অনবরত। কাউকে কিচ্ছু বলার ভাষা ছিল না। রাতে প্রচ- জ্বর এলো। রাতে স্বপ্নে কিছুদিন ওই দৃশ্যটা দেখতাম আর আম্মু বলে চিৎকার দিতাম। সেই থেকে আর কোনোদিন ঐ শালগাছটার গাছে যাইনি।

Share.

মন্তব্য করুন