ঘুম থেকে উঠে দেখি আব্বু এসেছে। আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম আমি। আব্বুও চোখের পানি লুকোতে ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। পারলেন না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন আমার সাথে তিনিও। নয় মাস পর তিনি বাড়ি এলেন। তখন মোবাইল ফোন ছিলো না। তাই যোগাযোগ ছিলো না বললেই চলে। হুট করেই আব্বু এলেন। লঞ্চে। ভোররাতে লঞ্চ থেকে নেমে বাড়ি এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি টের পাইনি। ছোটো মানুষের ঘুম থাকে বেশি। আমি প্রচ- ঘুম কাতুরে ছিলাম। তাই বুঝতেই পারিনি ঘরে কেউ এসেছে। এতো দিন পর আব্বু কেন এলেন? কারো কাছে হয়তো আমার ছোটো ভাই দেলোয়ার হওয়ার সংবাদ পেয়েছেন। নইলে কাকতালীয়ভাবে এসেছেন। যাহোক আম্মু কিছুটা হলেও ভরসা পাবেন। দীর্ঘদিন একাই সংসারের পুরো দায়িত্ব পালন করছিলেন। এভাবে আর কত দিন সংসারের ঘানি টানবেন তিনি।
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে। সকালে আম্মু বললেন, মামণি! তোমার নানুকে ডেকে নিয়ে এসো। বলবে, আম্মুর পেটে ব্যথা আপনাকে যেতে বলছে দ্রুত। আমার নানুর ছোটো বোন। তিনি থাকেন তার বাপের বাড়ি। একটি মাত্র ছেলে। শ্বশুরবাড়ি থেকে অভিমান করে চলে এসেছেন। আর যাননি। স্বামী আরেক বিয়ে করেছে বলে। নানুকে বলতেই ওড়না পেঁচিয়ে আমার সাথে রওনা হলেন। আম্মু তখনো স্বাভাবিক। আমি কিছুই বুঝিনি। স্কুলে চলে গেলাম। দাদা-দাদী কেউ বেঁচে নেই। যথারীতি স্কুল ছুটি হলো বিকেলে। এসেই একটি শুভসংবাদ শুনলাম। আমার ভাই হয়েছে। অলরেডি সে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। আম্মু ছোটোভাই উভয়ই সুস্থ। এই সুখের সংবাদটি আব্বুকে জানানো গেলো না। এমন তো কখনো হয় না। প্রতি মাসেই তিনি বাড়ি আসেন। থাকেন ঢাকায়। মাসে না আসতে পারলে কমপক্ষে দুই মাস অন্তর একবার তো আসবেনই। রুটি, কলা, আঙ্গুর, আপেল আরো কতো রকম ফলফলাদি নিয়ে আসেন। আমার জন্য নিত্যনতুন খেলনা। কিন্তু এবার এক মাস, দুই মাস, তিন মাস, দিন যায়, মাস যায় আব্বু আসে না। আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। চিঠি পাঠিয়েও তার কোনো জবাব পাওয়া গেলো না। এদিকে আম্মু ভীষণ কষ্টে আমাদের নিয়ে দিনরাত পার করছেন। সকালে বাড়িতে মক্তব খুললেন। বিশ-ত্রিশ জন ছেলেমেয়ে আম্মুর কাছে কোরআন শিখতে আসতো। এতে অল্পকিছু অর্থনৈতিক সামাল হলো। কিন্তু পুরোপুরি তো নয়ই! হাঁস-মুরগি পালতে শুরু করলেন। আম্মু শিক্ষিতা ছিলেন। বিকেলে দু’চারজনকে অঙ্ক-ইংলিশ পড়াতে লাগলেন। দিনগুলো খুব কষ্টের মধ্যেই পার হতে লাগলো। এবার আব্বু আসাতে আম্মু যারপরনাই খুশি হলেন। বিপদ বুঝি এবার বাড়ি ছাড়বে। অল্পকিছু দিন আব্বু আমাদের সাথে থাকলেন। আবার যথারীতি ঢাকা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় পাঁচ কেজি চাল আর পাঁচশত টাকা দিয়ে গেলেন। বলে গেলেন খুব শিগগিরই টাকা পাঠাবেন। আম্মু আশায় বুক বাঁধলেন।
আব্বু সেই যে গেলেন। মাস গেলো। বছর গেলো। এক, দুই, তিন, চার। কোনো খোঁজ তার পেলাম না আমরা। আম্মু দুশ্চিন্তা করতে করতে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। সংসারের পুরো হাল তাকে ধরতে হলো। ঐসব কাজ করার পাশাপাশি নতুন একটা কাজ আম্মু নিলেন। দর্জির। কাজ শিখে অনেক কষ্টে এগারো শ’ টাকা জমিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনলেন। পুরনো। আশপাশের মহিলাদের ছায়া ব্লাউজ বানানো শুরু করলেন। ক্রমান্বয়ে কাজের পরিধি বাড়লো। মেয়েদের থ্রি পিস। ফ্রক। ছোটো ছোটো ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট। আরো যাবতীয় কাজ তিনি করতে লাগলেন। কাজের চাপ ও এই অল্প বয়সে আব্বুর বিরহে শরীরটা রোগের কারখানায় পরিণত হলো আম্মুর।
আমার প্রাইমারির পাঠ শেষ। হাইস্কুলে পড়ানোর ক্ষমতা আম্মুর নেই। সংসারে টানাপড়েন লেগেই আছে। তদুপরি দেখেছি, আম্মু আমাদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল করে দুধ রোজ করতেন। আধা সের। আম্মুর কষ্ট আমি বুঝতাম। আমিই ছিলাম বড়। নিতান্তই খাবারের অভাবে আম্মু আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করলেন। বাড়ির কাছেই ছিলো হাফেজি মাদ্রাসা। আম্মু সেখানটায় ভর্তি করালেন। পরে শুনেছি, আম্মু মাদ্রাসা কমিটির সেক্রেটারির কাছে গিয়ে বহুদিন কেঁদেছেন। আমাকে যেনো ভর্তি নেন। প্রথম প্রথম অস্বীকার করলেও পরে আম্মুর কান্নার কাছে পরাজিত হয়ে আমাকে ভর্তি নেন। বোর্ডিংয়ে খাবার চালু হয়। এবার একজনের খাবারের চিন্তা থেকে আম্মু নিস্তার পান। পাঞ্জাবি বানিয়ে দিতে পারেননি আমাকে। পুরনো একটা কেনা পাঞ্জাবি পরে মাদ্রাসায় পড়া শুরু করি আমি। আবাসিক থেকে। বিকেলে বাড়ি আসতাম। আম্মুর গলা ধরে কাঁদতাম। কত রাত আম্মু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছেন। আমি তার নীরব সাক্ষী। জীবনটা ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠলো আম্মুর। আমার ছোটো যে ভাইটা ওকে নানা বাড়ি দিয়ে দিলেন। তাও খাবার অভাবে। আম্মু তারপরও স্বামীর ভিটা ছাড়তে রাজি নন। রোগ ক্রমেই সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। এখানে থেকেই তার চিকিৎসা করতে লাগলেন। নানারাও খুব আর্থিক সচ্ছল নন। তারা যে আমাদের সহযোগিতা করবেন তাও না। দাদাকে তো দেখিই নি। দাদু মারা গেছেন ছোটো অবস্থায়। চাচারা নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। আম্মুর দিনগুলো ভয়াবহ খারাপ যাচ্ছিল। ঔষধে কাজ হচ্ছিল না। আব্বুরও কোনো খোঁজ-খবর নেই। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তাও জানি না। আম্মুর আর চলছে না। কোনো কাজই তিনি করতে পারছেন না। না পারছেন পড়াতে। না পারছেন সেলাই কাজ করতে। ঘরে পড়ে গেলেন। কতদিন আর অন্যরা দেখবে! এবার বাধ্য হয়ে নানা বাড়ি গেলেন। ঘরটা খালি রেখে। সেখানে চিকিৎসা চললো। নানা বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূর। মাঝে এক নদী পড়ে। যাতায়াতব্যবস্থা খুবই খারাপ। হেঁটেই যেতে হয়। একদুপুর লাগে। আম্মু নৌকাতে গেলেন। যাওয়ার সময় এলাকার অন্যান্য মহিলারা কেঁদেছেন। আম্মুও কেঁদেছেন।
সুচিকিৎসা হওয়ার পর আম্মু কিছুটা সুস্থ হলেও বাড়িতে আসার শক্তি বা সাহস কোনোটাই হয়নি। সেখানেই থাকা শুরু করলেন। ছোটো ভাইকে স্থানীয় একটা বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলো। আম্মু সেলাই মেশিনের কাজ শুরু করলেন।
পাঁচ-ছয় বছর পর আব্বুর খোঁজ মিললো। ততদিনে আমি কুরআনে হাফেজ হলাম। দিনগুলো অনেক কষ্টে যাচ্ছিল। ঘর উইপোকায় খেয়ে শেষ করে দিলো। আম্মু এবং আমরা মানবেতর জীবন পার করলাম। আব্বু এলেন ঠিকই আমাদের বাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হলো না। আর হবে বলে মনেও হচ্ছে না।

Share.

মন্তব্য করুন