আজ বিশ্বে শিশুরা অশিক্ষা, ক্ষুধা দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হচ্ছে, আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে বেছে নিয়েছে শ্রমকে। অথচ গোটা বিশ্বের সম্পদ ও সংগঠনকে উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে শিশুদেরকে সুস্থ, শিক্ষিত, উৎপাদনশীল ও উত্তম নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। সারা বিশ্বে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশুশ্রমিক। শিশু শ্রমিকরা আমাদের দেশে নানাবিধ দৈহিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে শিশু-সমস্যায় জর্জরিত। তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিরাপত্তাহীনতা ও নিম্ন সামাজিক মর্যাদা নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছে। দরিদ্রতা, নিরক্ষরতা, অসচেতনতা, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি প্রেক্ষাপট থেকে আবিষ্কার হয়েছে শিশুশ্রমিক, যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে বর্তমান সমাজকে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO)) নীতিমালা ন্যূনতম বসয়সীমা (শিল্প) কনভেনশন, ১৯১৯ অনুযায়ী পরিবারের কোনো সদস্য কাজে নিয়োজিত না থাকলে ১৪ বছরের নিচে কোন শিশুকে কোন শিল্পখাতে নিয়োজিত করা যাবে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন অধ্যাদেশ বিধিমালা ও বিভিন্ন নীতিমালা বিশেষ করে জাতীয় শিশু নীতিমালা ২০০১ এ শিশু শ্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তা নিরসনের কথা বলে ও তা বাস্তবায়িত হয়নি বিধায় উদ্ভূত শিশুশ্রমিক দেশপ্রেমিক ও সৃজনশীল জনসম্পদ তৈরির প্রক্রিয়া থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ উন্নয়নে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যটি হচ্ছে “শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের মাধ্যমে মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক গুণসম্পন্ন জ্ঞানী, দক্ষ, যুক্তিবাদী ও সৃজনশীল দেশপ্রেমিক, জনসম্পদ সৃষ্টি।” জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার প্রক্রিয়া হচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে মানুষের জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গির অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ও কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনয়ন করা। দক্ষ ও সৃজনশীল জনসম্পদ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনDevelopment of knowledge, skill & attitude, এ পরিবর্তন বা উন্নয়নের ক্ষেত্র হচ্ছে মানুষ। আর মানুষের শুরু হচ্ছে শিশু থেকে। প্রতিটি শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকে সুপ্ত প্রতিভা ও সম্ভাবনা। এই প্রতিভা ও সম্ভাবনাকে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমেই উৎপাদনশীল করে তুলতে হবে শিশুবান্ধব পরিবেশ।
শিশু চিহ্নিত হয় বয়সসীমা নির্ধারণ করে। United Nations Convention on the Rights of the Child (CRC) ১৯৮৯ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীদের সকলকেই শিশু বলা হয়েছে। অবশ্য International Labour Organization (ILO) ১৯৯৮ সালে উন্নয়নশীল দেশের শিশুশ্রমিকদের হিসাব দিতে গিয়ে ৫-১৪ বছর বয়সীদের শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ‘শিশুশ্রমিক’ বলতে সাধারণত সেই সমস্ত শিশুদেরকে বুঝায় যারা অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সাথে সরাসরি জড়িত। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার ১৩৮ নং কনভেনশন অনুসারে বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা যখন বাধ্যতামূলকভাবে বা স্বেচ্ছায় নিজের ও পরিবারের দায়িত্ব পালনের জন্য আয় উপার্জনমূলক কাজে নিয়োজিত থাকে তখন তাকে শিশুশ্রমিক বলা হয়। বাংলাদেশের শিশুরা পরিবহনের হেলপার, খোলাবাজার এলাকার কুলি, গৃহকর্মী, হোটেল, রেস্টুরেন্ট বয়, খেলনা ও চকোলেট বিক্রেতা, দৈনিক পত্রিকা, ফুল ও সস্তা খাবার বিক্রেতা, শহরের যানজটে থেমে যাওয়া ধনীদের গাড়ির ক্লিনার হিসেবে কাজ করে।
সারা বিশ্বের ২৫ কোটি শিশু শ্রমের সাথে সংযুক্ত। বিশ্বের প্রতি ৬ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু শ্রমিক। আইএলও-এর তথ্যানুযায়ী সমগ্র বিশ্বব্যাপী ৫-১৭ বয়সী প্রায় ২৪৬ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে শিশু শ্রমিকরা নানা ধরনের নির্যাতন, লাঞ্ছনা, অপমান ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার। ইউনিসেফ, জাতিসংঘ শিশু তহবিল, দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক কার্যালয় ২০০১ কর্তৃক প্রকাশিত একটি (অনুচ্ছেদ ২৭) ‘আমি সিঁড়ির নিচে ঘুমাই এবং আমর পোশাক ছেঁড়া, আমি কেবল উদ্বৃত্ত খাবারটুকু পাই এবং মাঝে মাঝে খাবার এত কম হয় যে আমি ক্ষুধা নিয়েই ঘুমাতে যাই’, এ দায়ভার কার। গৃহযুদ্ধকবলিত ইয়েমেনের প্রায় ১ কেটি শিশুর জন্য জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বলে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানায়। ইউনিসেফের বিবৃতিতে বলা হয়, ইয়েমেনের বেশির ভাগ শিশু মৌলিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পর্যাপ্ত পুষ্টি, বিশুদ্ধ পানীয়, যথাযথ স্যানিটেশন এবং শিক্ষার অভাব রয়েছে। দেশটিতে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি প্রকট হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি বলেছে, ১ কোটি ৭০ লাখ ইয়েমেনি জানে না পরবর্তী বেলার খাবার কিভাবে আসবে।
ইউনিসেফের (২০০৮) অপর এক তথ্যে বলা হয়, বিশ্বে ১৫ বছরের কম বয়সী ৪ কোটি শিশু মানবাধিকার ও অবহেলার শিকার। মার্কিন বিচারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতে, নগরীর শতকরা একশত ভাগ জনসংখ্যার প্রায় আড়াই লাখ শিশু অপরাধে লিপ্ত। ইউনিসেফ অন্য এক হিসেবে জানায়, ১৮ বছরের কম বয়সী ৩ লাখের বেশি শিশু বর্তমানে বিশ্বে ৩০টির মত সশস্ত্র সঙ্ঘাতের মধ্যে শোষিত হচ্ছে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (২০০৫) মতে অধিকতর সংখ্যায় শিশুর বয়স হচ্ছে ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। ৭ অথবা ৮ বছরের মধ্যেও কিছু রয়েছে। মানবপাচারের হিসেবে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বে ২ কোটি ৭০ লাখ লোক বেকার হয় এবং তারা ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচারবিষয়ক বিভাগ (২০০৬) জানায়, প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে অন্তত ৬ থেকে ৮ লাখ লোক পাচার হয়। এখানেও শিশুর কথা বলা হয়।
গোটা বিশ্বে শিশুদের ওপর নির্দয় আচরণ মানবাধিকার লংঘন এবং শোষণের ঘটনা ঘটছে। এনজিও বা বেসরকারি সংস্থাগুলো সহিংসতা থেকে রক্ষায় শিশুদের বাঁচানোর বা রক্ষায় কাজ করছে। শিশু এবং সহিংসতা সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ দুর্দশাগ্রস্ত শিশুদের রক্ষায় কাজ করছে যা সহিংসতাকে প্রতিরোধ করতে কাজ করবে। বিশেষ করে ওয়ার্কিং গ্রুপের কাঠামোয় ব্যাপকভাবে শিশুদের রক্ষায় সরকারগুলোর যে আইনি বাধা রয়েছে তা দূর করে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়।
শিশুদের রক্ষায় বিশ্বব্যাপী বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। তার মধ্যে রয়েছে ‘ইউএন স্টাডি অন ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন ফলো আপ’ ক্যাম্পেইন, অ্যাক্ট নাও ইন্ড ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন ‘দি স্পেশিয়াল রিপ্রেজেন্টেটিভ অব দ্য সেক্রেটারি জেনারেল অন ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন’, কমিটি অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল ইত্যাদি।
শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সংক্রান্ত জাতিসংঘ স্টাডির কাজ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ওয়ার্কিং গ্রুপ প্লাটফরম হিসেবে তথ্য আদান প্রদান করে। জাতিসংঘ স্টাডিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে এতে ব্যাপক শিশু অধিকার সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়।
ক্যাম্পেইন ‘অ্যাক্ট নাও ইন্ড ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন’ এ গত বছর (২০১৬) শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এক্ষেত্রে বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং ব্যাপকতর নিপীড়ন বন্ধে অনেক কিছু করা প্রয়োজন। ২০১৫-পরবর্তী সময়ে শিশুরা যাতে সকল ধরনের সহিংসতামুক্ত জীবনযাপন করতে পারে, সঙ্ঘাত দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে পারে তা নিশ্চিত করে নিরাপদ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি প্লাটফরম তৈরি করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া ২০০৯ সালের সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাবিষয়ক তার বিশেষ দূত হিসেবে মারতা স্যান্টোসকে নিয়োগ দেন। ওয়াকির্ং গ্রুপ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সহিংসতার ব্যাপক তথ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে এনজিওগুলোর জন্য গাইডলাইন তৈরি করে। গাইডলাইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সহিংসতার প্রশ্নে পর্যাপ্ত বা ব্যাপক আলোচনা এবং বিশ্লেষণে এনজিওগুলোকে সহায়তা করা। ১৪০টি এনজিও যেন নিপীড়ন, সহিংসতা ও শিশু মানবাধিকার লংঘনকে কেন্দ্রিভূত করে শিশু অধিকারের বিষয়টি কমিটির কাছে পেশ করে। গবেষণায় শিশুদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাত প্রশ্নে এনজিওগুলোরে তথ্য আরো উন্নত করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়।
সমাজ সকলের, আমাদের প্রায় প্রতিটি ঘরে শিশু রয়েছে যাদের প্রতি রয়েছে অনেক ভালোবাসা অথচ দরিদ্র পরিবার থেকে আগত শিশু শ্রমিকটির প্রতি আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? সামাজিক মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধ পারে শিশু শ্রমিকদের সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা দিতে। শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বড়দের ভালোবাসা ও মনোযোগ। সাধারণত ৪ বছর বয়স থেকে শিশু গুছিয়ে কথা বলতে শেখে এবং শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে পরিবার ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ অভিভাবকদের ভালোবাসা ও মনোযোগ পাওয়ার এই সময়টিতে শিশু থাকে ঘরের বাইরে শ্রমিকরূপে, আর বিদ্যালয়ে পদার্পণের পরিবর্তে নিয়তির পরিহাস তাকে ঠেলে নিয়ে যায় ধনীর ঘরের ভালোবাসাহীন পরিবেশে।
বাংলাদেশের নি মাথাপিছু আয়ের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনজীবিকার তাগিদে অতি আদরের সন্তানদেরকে ঠেলে দিচ্ছে অর্থ উপার্জনের দিকে। এই শিশুরা সমাজের অঙ্গ। শিশুশ্রম যেমন একাধারে শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর তেমনি বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নের প্রধান বাধা। শিশু শ্রমিকদের জন্য সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শের আঙ্গিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও বিধিমালা কার্যকর করতে হবে। অভিভাবক থেকে শুরু করে সকল মহলকেই শিশু শ্রমিকদের প্রতি সজাগ ও সচেতন হতে হবে। গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মালিক যদি নিজের সন্তানের মত অনুভূতিশীল হৃদয় নিয়ে দারিদ্র্যক্লিষ্ট আশ্রিত শিশুটির প্রতি সমাজের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে শিশু শ্রমিকটির জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
সর্বোপরি সামাজিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সামাজিক দায়িত্ব পালনে সকলে উদ্যোগী হলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমে আসবে। বন্ধ হবে শিশু শ্রম। শিশু শ্রমিকদের জীবন হবে বিকাশমুখী, শিশুরা গড়ে উঠবে দক্ষ ও যুক্তিবাদী দেশপ্রেমিক ও সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে।