প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক এখানে ছুটে যান প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রকৃতির মাঝে ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেতে চান তারা। বনের ভেতর ছুটেন হরেক রকম প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেখতে।
সময়টা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। পশ্চিম সদর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে অন্যসব দিনের মতোই ক্লাস চলছে। তখন আমাদের ক্লাসে ছিলেন আইসিটি শিক্ষক আহমেদ হুসাইন স্যার। তিনি অভিজ্ঞতার বিষয়ে বর্ণনা দিতে গিয়ে উদাহরণস্বরূপ ভ্রমণের কথা বলেন। তাৎক্ষণিক আমি এবং আমার ক্লাসমেট, বন্ধুরা মিলে কলেজ থেকে ভ্রমণে যাওয়ার কথা বলি। তখন স্যার আমাদেরকে পরামর্শ দিয়ে বলেন অধ্যক্ষ মহোদয়ের নিকট এই বিষয়ে আবেদন করতে। পরদিন আমরা কলেজের অধ্যক্ষ আতিকুর রহমান স্যারের নিকট আবেদন করলে তিনি গ্রহণ করেন এবং অন্যসব শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এতে তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ইং তারিখ। স্থান নির্বাচন করা হয় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। এরপর শুরু হয় স্কুল ও কলেজের ভ্রমণে যেতে ইচ্ছুক ছাত্র ছাত্রীদের তালিকা তৈরি। তালিকায় ৮৬ জন শিক্ষার্থী ভ্রমণে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। স্কুল কলেজের শিক্ষক এবং কর্মচারীসহ সব মিলিয়ে আমরা প্রায় ১০০ জন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আগের দিন সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো সকাল ৮টায় কলেজ মাঠে উপস্থিত থাকার জন্য।
এর পর আমাদের সামনে চলে এলো সেই কাক্সিক্ষত দিন। সকাল সাড়ে ৭টায় আমি (ফারহান) এবং আমার বন্ধু মিলন, উসমান, হারুন, সুলতান, ফয়ছল, সার্জান, তারেক সবাই মিলে রওনা দিলাম কলেজের দিকে। নির্ধারিত সময়ে আমরা কলেজ মাঠে উপস্থিত হই। সব শিক্ষার্থী জড়ো হওয়ার পর শিক্ষকরা সবাইকে বাসে উঠতে বলেন। বাসে উঠার পর সকাল ৯:১০ মিনিটের সময় ড্রাইভার বাস ছাড়েন। এবার আমরা রওনা দিলাম গন্তব্যের দিকে। যাত্রাপথে সকাল ১০:২০ মিনিটের সময় আমরা তাজপুর বাজারে পৌঁছাই সেখানে নেমে একটি প্রাথমিক স্কুলের মাঠে আমরা সকালের নাস্তা গ্রহণ করি। নাস্তা গ্রহণ শেষে এবার আমরা রওনা দিলাম মূল গন্তব্যের দিকে। দুটি বাসের মধ্যে ছিল দুটি মাইক। যাত্রাপথে কৌতুক আর সঙ্গীত শুনতে শুনতে ১২:০০ টার সময় আমরা পৌঁছলাম চুনারুঘাট বাজারে। বাসের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়বে সারি সারি গাছ কোথাও আবার খোলা মাঠে চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি। ছোট ছোট পাহাড়, নদী আর চা-বাগান দেখতে দেখতে দুপুর ১২:৩০ মিনিটের সময় আমরা পৌঁছলাম সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে।
বাস থেকে নেমেই চোখে পড়লো প্রবেশ গেইট। গেইটে ঢোকার বাম পাশে রয়েছে টিকেট কাউন্টার। টিকেট এর মূল্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জনপ্রতি ২০ টাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা। টিকেট এর নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে ভিতরে ঢুকতেই সামনে পানিবিহীন ছোট্ট একটি খাল। খালের উপর থাকা সেতু পার হয়ে ছোট ছোট পাকা রাস্তা দিয়ে আমরা বনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। শিক্ষকরা আমাদেরকে ঘুরাঘুরি করার জন্য ৩ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করে দিলেন। শুরুতে আমরা সবাই রওনা দিলাম ওয়াচ-টাওয়ার এর দিকে। চারপাশের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করে সরু রাস্তা দিয়ে সবাই হাঁটা শুরু করলাম। সবাই বনের গভীরে যেতে যেতে আলোর স্বল্পতা অনুভব করি। একমাত্র ঘন বনের ক্ষেত্রেই এমনটা হতে পারে। বনতলে বিচিত্র গাছপালা। আমরা সরু পথে নুয়ে পড়া ডালপালা এড়িয়ে এগোতে থাকি। যেতে যেতে হঠাৎ একটি ধূসরকাণ্ডের উঁচু গাছ দেখে সবাই দাঁড়াই। ইংরেজি শিক্ষক রিয়াজ উদ্দিন স্যার নিশ্চিত করলেন এগুলো ডুমুর। দেশের আর কোনো বনে এত বড় ডুমুর দেখিনি। পাখিদের সুমধুর কলতানে মুখরিত এই উদ্যান। হাঁটতে হাঁটতে বনের প্রায় দেড় কিলোমিটার ভিতরে যেতেই চোখে পড়লো উঁচু একটি পাহাড় লম্বা সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলাম। উপরে উঠেই দেখতে পেলাম ১০ তলা বিশিষ্ট ওয়াচ-টাওয়ার যেটার উপর উঠলে বনের পুরো সৌন্দর্য একনজরে দেখা যায়। আমি এবং আমার বন্ধুরা মিলে ওয়াচ-টাওয়ারে উঠে পুরো বনের সৌন্দর্য পাখির চোখে দেখে নিলাম। ওয়াচ-টাওয়ার থেকে নেমে এবার আমরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বনের গহিনের দিকে রওনা দিলাম।
জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সাতছড়ি উদ্যানের অপরূপ সৌন্দর্য নিজের চোখে এবং বাস্তবে উপভোগ না করলে বোঝা সম্ভব নয়। হাজারো পর্যটক এখানে পরিভ্রমণে আসেন। এটির মধ্য দিয়ে পানিহীন সাতটি ছোট খাল বা ছড়া প্রবাহিত হয়েছে। যা বর্ষায় পানি এলেও শুকিয়ে যায়। তবে অবাক হওয়ার কথা, ছড়াগুলোর মধ্যে প্রকৃতি তার নিয়মে বিছিয়ে রেখেছে, পানিবিহীন দুধের মতো সাদা বালু। সাদা বালুর ওপর হেঁটে যাওয়া যায় উদ্যানের গভীরে। তখন মনে হবে এ যেন প্রকৃতির সাদা গালিচার অভ্যর্থনা। ছড়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাবেন বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজি ও নাম না জানা অসংখ্য লতাপাতা।
চারিদিকে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই চোখ আটকে যায়। সবকিছু দেখার পর এবার আমাদের নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে এলে দেরি না করে সবাই জড়ো হলাম কাউন্টার প্রাঙ্গণে। দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য সবাই বসে পড়লাম সবুজ ঘাসের ওপর। খাবার গ্রহণ শেষে সবাই বনের পাশে থাকা সাতছড়ি চা-বাগানে ঘুরে তৃপ্তি নিয়ে ফিরেছি যার যার বাসায়। এভাবেই আমাদের ভ্রমণের সমাপ্তি হলো। যদিও এমন ভ্রমণ ছেড়ে আসতে কারো ইচ্ছা করবে না।
একনজরে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান :
১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ/সংশোধন আইনের বলে ২৪৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে ২০০৫ সালে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই উদ্যানে সাতটি পাহাড়ি ছড়া আছে, সেই থেকে এর নামকরণ সাতছড়ি (অর্থ: সাতটি ছড়াবিশিষ্ট)। সাতছড়ির আগের নাম ছিল ‘রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্ট’।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে প্রায় ২০০ এরও বেশি প্রজাতির গাছপালা। এর মধ্যে শাল, সেগুন, আগর, গর্জন, চাপালিশ, পাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধাজারুল, আওয়াল, মালেকাস, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, বাঁশ, বেত-গাছ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এ উদ্যানে ১৯৭ প্রজাতির জীব-জন্তু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর, আরও আছে প্রায় ১৫০-২০০ প্রজাতির পাখি।
এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। বনে লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, মুখপোড়া হনুমান, পাতিশিয়াল, উল্টোলেজি বানর, লাল বানর, মেছোবাঘ, চিতা বিড়াল, বন বিড়াল, মায়া হরিণ, এশীয় কালো ভাল্লুক, রামকুত্তা, হলুদগলা মার্টিন, কাকড়াভুক বেজী, এশীয় বুরুশ- লেজী সজারু ইত্যাদি।
পাখিদের মধ্যে কাও ধনেশ, লাল বনমোরগ, লালমাথা কুচকুচি, কাঠঠোকরা, পাতি ময়না, ভীমরাজ, ধলাকোমর শ্যামা, ঝুঁটিপাঙ্গা, শালিক, হলদে পাখি, টিয়া প্রভৃতির আবাস রয়েছে। শকুনের নিরাপদ এলাকা-১ তফসিল অনুসারে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান শকুনের জন্য নিরাপদ বলে ঘোষিত। এছাড়াও গাছে গাছে আশ্রয় নিয়েছে অগণিত পোকামাকড়, ঝিঁঝি পোকা তাদের অন্যতম।