হালকা কুয়াশা ঘেরা সকাল টিনের চাল বেয়ে পড়ছে শিশিরের ফোঁটা। প্রভাতের অরুণ কিছুটা মাথা উঁচু করে মিটিমিটি হাসছে। চেয়ার নিয়ে ঘরের পেছনে দাদু বসে আছে। রাতুল চুপিচুপি গিয়ে পেছন থেকে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, শুভ সকাল দাদু।
– আরে দাদুভাই তুমি এত সকালে উঠলে কেন?
– উঠবো না কেন দাদু? তুমি বইতে পড়নি ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি’। দাদু আমি এখানে যে কয়দিন আছি শীতের ছুটিতে তোমাকে নিয়ে ঘুরে দেখবো আমাদের গ্রামের প্রকৃতি।
– ঠিক আছে দাদুভাই, চলো সকালের নাস্তাটা করে তারপর বের হবো। তোমার দাদিমা তোমার জন্য গরম গরম ভাপা পিঠা তৈরি করেছে খেজুরের পাটালি দিয়ে।
– তাই নাকি দাদু! ভাপা পিঠা আমার খুব প্রিয়।
রাতুল বলল- দাদু এভাবে যদি তোমার সঙ্গে সব সময় থাকতে পারতাম কতনা আনন্দ হতো, ছুটি শেষ হলেই তো আবার চলে যেতে হবে কারাগারে।
– কারাগার মানে কী দাদুভাই?
– তুমি বুঝতে পারলে না? দাদু কারাগার মানে শহরের বদ্ধ ঘর। সেই বদ্ধ ঘরে থাকলে নাকি মানুষের মতো মানুষ হওয়া যায়। ওটাই নাকি ভালো পরিবেশ। প্রিয় মানুষদের ছেড়ে কি করে মানুষের মতো মানুষ হওয়া যায়, বলতে পারো দাদু?
দাদুর চোখের কোনায় জল, আধো-আধো কণ্ঠে দুঃখ চাপা হাসি দিয়ে বলল- শহর থেকে ভালো স্কুলে পড়লে ভালো মানুষ হওয়া যায়। গ্রামের পরিবেশ ভালো না দাদু ভাই।
– আচ্ছা দাদু, তুমি কি শহরে লেখাপড়া করেছ না গ্রামে করেছ?
– গ্রামে করেছি আমরা আবার শহরে যাবো কিভাবে?
– তুমি কি তাহলে মানুষ হওনি দাদু?
– এইসব কথা ছেড়ে ভাপা পিঠা খাও তো দাদুভাই ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
রাতুল ক্লাস নাইনে পড়ে, সে প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসে। আশপাশের প্রিয় মানুষদের সাথে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে। একদিন বিকেলে দাদুর সঙ্গে রাতুল বের হলো গ্রামের প্রকৃতি ঘুরে ঘুরে দেখতে। কিছুদূর এগিয়ে বড় একটা খেলার মাঠ, ওখানে অনেক ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। রাতুলের চোখে পড়ল একটি ছেলে গলার সাথে লুঙ্গি পেঁচিয়ে বেঁধে পুরো শরীর ঢেকে রেখেছে। রাতুল বলল- দাদু-দাদু, দেখো না একটা ছেলে এমন করে লুঙ্গি পেঁচিয়ে রেখেছে কেন? দাদুভাই খুব শীত পড়েছে তো এ জন্যই ওর মা ওকে এমন করে বেঁধে দিয়েছে শীতে যেন কষ্ট না পায়। ওরা খুব গরিব, ওদের সামর্থ্য নাই, শীতের কাপড় কিনবে কিভাবে! তাই এ রকম করেছে।
রাতুলের মুখখানায় কালো মেঘের ছায়া নামল। রাতুল বলল জানো দাদু, বাবা আমাকে অনেক টাকা দিয়েছে শীতের ছুটিতে ঘুরবো বলে। দাদু আমি চাই এই টাকাগুলো আমি ঘুরে নষ্ট করব না। আমি গ্রামের গরিবদের জন্য শীতের কাপড় কিনে দেবো, তুমি আমাকে বাজারে নিয়ে চলো। দু’জনে মিলে বাজারে গেল, অনেকগুলো শীতের কাপড় কিনে আনল। তারপর ঐ বড় খেলার মাঠে গিয়ে সামর্থ্যহীন পরিবারের গরিব বাচ্চাদের উপহার হিসাবে দিলো।
শীতের কাপড় পেয়ে বাচ্চাগুলো অনেক খুশি, সবার ঠোঁটে সরলতার হাসি। ওদের সরল হাসি দেখে রাতুলের মনের কালো মেঘগুলো আনন্দের বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিলো নয়নের পাপড়ি। দাদু বলল, দাদুভাই, মানুষের কষ্টকে যে অনুধাবন করতে পারে, মানুষের দুঃখে যার চোখে জল আসে, মানুষের বিপদে যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই তো প্রকৃত মানুষ। আর তোমার মধ্যে আমি তা দেখতে পাচ্ছি অনেক দোয়া করি তোমার জন্য জীবন যুদ্ধে জয়ী হও।
রাতুল বলল, দাদু প্রত্যক শীতের ছুটিতে তোমার মতো পরশ পাথরের ছোঁয়া পাই বলে মরচে পড়া হৃদয়কে চকচকে করতে পারি। কথাটা বলেই দাদুকে জড়িয়ে ধরল রাতুল।