আচ্ছা ছোট্ট বন্ধুরা, কল্পনা করো তো সবুজে বেষ্টিত একটি ছোট্ট গাঁ। যে গাঁয়ের চারদিকে চোখধাঁধানো সবুজের সমারোহ। ঘন গাছগাছালি। পাখিদের কিচিরমিচির। গাঁয়ের চারদিকে সোনালি ধানক্ষেত। কূল ঘেঁষে বয়ে চলা ছোট্ট একটি স্রোতস্বিনী নদী। টলমলে জল। দিগন্ত ছোঁয়া বিশাল মাঠ। মাঠের বুকে তিরতির করে কেঁপে ওঠা দূর্বাঘাসের জমিন। কল্পনা করো তো তেমন একটি মায়াময় সুন্দর গাঁয়ের দৃশ্য। যে গাঁয়ের কারও মাঝে নেই কোনো হিংসা বিভেদ, মারামারি। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে যে গ্রামের বাসিন্দারা পাশে থাকে একে অপরের। ছোটোরা রোজ সকাল বিকেল একসাথে খেলাধুলা করে মাঠে। পড়ার সময় পড়ে। খাওয়ার সময় খায়। একসাথে মিলেমিশে স্কুলে যায়। নদীতে ঝাঁপাঝাপি করে। জাল ফেলে মাছ ধরে। বাবা-মা, গুরুজনদের মেনে চলে। কল্পনা করো তো অমন সুন্দর, আলোকিত একটি গাঁ!
কেমন হয় তোমাদের কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা সেই সুন্দর গ্রামখানিকে যদি তুলে ধরা হয় ছড়ায়, ছন্দে ছন্দে। তাহলে এসো না পড়ি একবার একসঙ্গে-
“আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দীঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে,
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে।”

কত সুন্দর একটি ছড়া, তাই না! যেন আমাদের মনের কথাগুলোই ছন্দে ছন্দে প্রকাশ করলেন কবি! আমাদের মনে যেন তিনি গেঁথে দিতে চেয়েছেন অমন মায়াময়, সুন্দর গাঁয়ের ছবি। কবির এই কবিতা পড়ে আমাদেরও ইচ্ছে করে না, আমাদের গ্রামও হয়ে উঠুক এমন একটি গাঁ, সেই মায়াময় স্বপ্নের ছোট্ট গ্রামখানি! আচ্ছা বন্ধুরা, অমন সুন্দর করে যিনি আমাদের জন্য লিখেছেন এই কথাগুলো, তাঁকে চেনার এবং জানারও তো দরকার আছে, তাই না?
হ্যাঁ বন্ধুরা, তাঁর নাম বন্দে আলী মিয়া। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই ডিসেম্বর যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি শিশুদের জন্য লিখে গিয়েছেন। তিনি চাইতেন, শিশু কিশোরেরা বেড়ে উঠুক নির্মল হাসি আনন্দের ভেতর দিয়ে। পরস্পর মিলেমিশে থাকুক। প্রতিদিন ভোরে মুয়াজ্জিনের আল্লাহু আকবারের সুরে ঘুম ভাঙুক তাদের। সুন্দর, আলোকিত জীবন যাপনে বেড়ে উঠুক তারা। বন্দে আলী মিয়ার কবিতায় যেমনিভাবে ফুটে এসেছে শিশুদের কথা। তেমনি এসেছে প্রকৃতির কথাও। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা আছে ‘ময়নামতির চর’ নামে। সেটির কয়েক লাইন এমন-
“এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও পারের বুড়ো বট
মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট;
এরি উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষী,
কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি।
কূলে কূলে চলে খরমূলা মাছ, দাঁড়িকানা পালে পালে
ছোঁ দিয়ে তার একটারে ধরি’ গাঙ চিল বসে ডালে
ঠোঁটে চেপে ধরি’ আছাড়ি আছাড়ি নিস্তেজ করি তায়
মুড়ো পেটি লেজ ছিঁড়ি একে একে গিলিয়া গিলিয়া খায়।…”
প্রকৃতির কবি, শিশুদের কবি বন্দে আলী মিয়াকে অনেকেই চেনে না। অথচ শিশুদের জন্য জীবন গঠনমূলক কত লেখাই না তিনি লিখে গিয়েছেন। শিশুদের জন্য লেখালেখি করে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, ১৯৭৮ সালে রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কারও লাভ করেন সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য।
শিশুদের ছাড়াও তিনি লিখেছেন বড়দের জন্যও। তবে শিশুসাহিত্য রচনাতেই জীবনের বেশি সময় অতিবাহিত করেছেন তিনি। শিশুদের জন্য লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু বইয়ের মধ্যে আছে- চোর জামাই (১৯২৭), মেঘকুমারী (১৯৩২), মৃগপরী (১৯৩৭), বোকা জামাই (১৯৩৭), কামাল আতাতুর্ক (১৯৪০), ডাইনী বউ (১৯৫৯), রূপকথা (১৯৬০), কুঁচবরণ কন্যা (১৯৬০), ছোটদের নজরুল (১৯৬০), শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা (১৯৬৩), বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা, সাত রাজ্যের গল্প (১৯৭৭), হাদিসের গল্প, ইত্যাদি।
১৯৭৯ সালের ২৭ শে জুন রাজশাহীতে শিশুদের কবি, প্রকৃতির কবি বন্দে আলী মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

Share.

মন্তব্য করুন