সমুদ্রে ডুব দিয়ে দেখেছেন কখনও! একবার ডুব দেওয়ার কল্পনা করুন। চারপাশে কী দেখতে পাবেন! মাছ, বিভিন্ন ধরনের মাছ। হরেক রকম মাছ আপনার চারপাশে ঘুরছে। প্রতিটি মাছের একেক রঙ, বিভিন্ন রকম। কখনো একই রঙের অনেক মাছ, কখনো অন্য ধরনের। এ যেন জলের নিচে এক রঙিন প্রদর্শন।
প্যারটফিশের উজ্জ্বল নীল থেকে ক্লাউনফিশের জ্বলন্ত লাল, হাজার রকম মাছের এমন জলের নিচের জগৎটিকে মনে হবে প্রকৃতির একটি আর্ট গ্যালারি। কিন্তু মাছ কেন এমন জমকালো হরেক রঙের হয়? উত্তরটি মাছের বিবর্তন, বেঁচে থাকার কৌশল এবং বিজ্ঞানের কিছু ব্যাখ্যার আকর্ষণীয় এক মিশ্রণের মধ্যে রয়েছে।

বিবর্তন এবং অভিযোজনের খেলা
মাছের এমন বিভিন্ন ধরনের রঙ হওয়ার কারণ তার বিবর্তন। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মাছেরা তাদের রঙ বিকশিত করেছে বেঁচে থাকার একটি কৌশল হিসাবে। তারা যে রঙগুলো ধারণ করেছে, তা কিন্তু এলোমেলো নয়। এগুলো বিশেষ কিছু উদ্দেশ্যে প্রকৃতির দ্বারা বেশ যত্ন সহকারেই মাছের শরীরে যুক্ত হয়েছে। কখনো শিকারি এড়াতে, কখনো সঙ্গীদের আকৃষ্ট করার জন্য, কখনো পরিবেশের সাথে পার্থক্য বুঝাতে, কখনো বিবর্তনীয় চাপের ফলাফলে এসেছে মাছের শরীরে রঙের এই খেলা।

ছদ্মবেশ ধারণ
অনেক মাছ ছদ্মবেশ ধারণে বেশ ওস্তাদ। অন্য শিকারি মাছ কিংবা প্রাণী কিংবা প্রকৃতিতে খাদ্য সন্ধানী অন্য জলজ শিকারির চোখ বেশ ভালোভাবেই ফাঁকি দিতে পারে। যেমন : ফ্ল্যাটফিশের কথা ধরুন। শিকারিদের তীক্ষè চোখ এড়িয়ে সমুদ্রের তলে মিশে যাওয়ার জন্য তার রঙ পরিবর্তন করতে পারে। এই ধরনের ছদ্মবেশকে বলে ক্রিপটিক কালারেশন। শরীরের এমন রঙ পরিবর্তন মাছটিকে শিকারির দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখে। যেমনটা সি হর্স মাছ তাদের চারপাশের রঙ অনুযায়ী জীবন্ত গিরগিটির মতো মুহূর্তে রঙ পরিবর্তন করে একরকম অদৃশ্যের ভান করতে পারে। স্টোনফিশ নামের মাছটি একটি বিষাক্ত মাছ। এটিও কখনো কখনও এত ভালোভাবে ছদ্মবেশ ধারণ করে যে- ডুবুরিরা অনেক সময় এটি দেখতে পায় না, যতক্ষণ না তারা এটির সংস্পর্শে আসে।

সতর্কতামূলক রঙ
কিছু মাছ লুকিয়ে থাকতে নয়, বরং উল্টো প্রকাশ্যে থাকতে শরীরের রঙের পরিবর্তন করে। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে রঙের পরিবর্তন করে। এটি করে অন্যদের বা শিকারিদের এই সতর্ক করতে যে- আমাকে বিরক্ত করো না, আমাকে ধরার চেষ্টা করো না। তারা আশপাশের মাছ বা প্রাণীদের এই বার্তা পাঠাতে উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করে। উজ্জ্বল রঙ চোখে পড়ে সহজে। এটি দিয়ে আক্রমণাত্মক সতর্কবার্তা দিয়ে বলতে চায়- দূরে থাকুন মশাই! এমন মাছগুলোর এমন রঙ পরিবর্তনকে বলে অ্যাপোসেম্যাটিক বা সতর্কীকরণ রঙ। যেমন : লায়নফিশ মাছ তার বিষাক্ত কাঁটায় লাল, সাদা এবং কালো প্যাটার্নের সাথে ফ্ল্যাশ স্ট্রাইক করে শিকারিদেরকে বিপদের ইঙ্গিত দেয়। কাছে এলে তুমি আমার বিষাক্ত কাঁটায় মরবে, এমন সতর্ক সংকেত দেয় এমন রঙ দেখিয়ে। এতে অন্য মাছ কিংবা শিকারি সতর্ক দূরত্বে থাকে এবং তাকে খাবারে পরিণত করতে সাহস পায় না।

রঙের বিজ্ঞান
মাছের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রঙে রঙিন হওয়ার কারণ হলো বিশেষ এক ধরনের কোষ। এদের বলা হয় ক্রোমাটোফোরস। এই কোষগুলোতে বিভিন্ন ধরনের রঙ জাতীয় কেমিক্যাল থাকে। আলো যখন মাছের শরীরে কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়, শরীর তখন বিস্তৃত এক বর্ণালি তৈরি করে। আমরা মাছের যে রঙগুলো দেখি, তার জন্য তিনটি প্রধান ধরনের ক্রোমাটোফোর থাকে। যেমন: মেলানোফোরসের মধ্যে মেলানিন রয়েছে। এটি কালো, বাদামি এবং ধূসর রঙ তৈরি করে। জ্যান্থোফোরস হলুদ এবং কমলা প্রতিফলিত করে। ইরিডোফোরস ধাতব এবং ঝলমলে রঙের জন্য দায়ী। এই ধরনের রঞ্জক কোষগুলো নীল, সবুজ এবং রূপালি রঙ বেশি প্রতিফলিত করে। এমনকি অনেক ধরনের মাছের শরীরে এই ক্রোমাটোফোরগুলোকে প্রসারিত বা সঙ্কুচিত করে তাদের রঙের তীব্রতা পরিবর্তন করার ক্ষমতাও থাকে। এমন রঙের পরিবর্তন তাদেরকে বিভিন্ন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে।

পানি এবং আলো
জলের মধ্যে আলো ভিন্নভাবে আচরণ করে। আলোর এমন আচরণ মাছের রঙ প্রদর্শনকে প্রভাবিত করে। জলের গভীরে যাওয়ার সাথে সাথে আলোর বর্ণালি সঙ্কীর্ণ হতে থাকে। লাল, কমলা এবং হলুদ রঙের আলো দ্রুত শোষিত হয় জলে। ফলে অনেক গভীর জলে বা গভীর সমুদ্রের মাছগুলোকে লাল দেখায়। লাল রঙ দেখানোর কারণ এই নয় যে- তারা আকর্ষণীয় হওয়ার চেষ্টা করছে, বরং এমন লাল দেখানোর মূল কারণ হলো- লাল আলো জলের এতটা নিচে তেমন একটা ছড়াতে পারে না। এই গভীরতায় লাল দেখালে শিকারি দূর থেকে মাছটিকে দেখতে পারে না। এতে মাছগুলো অদৃশ্য থাকতে পারে সহজে।

সঙ্গীকে আকর্ষণ
অনেক পাখি তাদের পছন্দের সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য তাদের পালক এবং তার রঙ দেখায়। তেমনি অনেক মাছও অন্য মাছ বা সঙ্গীদের আকর্ষণ করার জন্য রঙের প্রদর্শন করে। যেমন : বেটা মাছ বা ম্যান্ডারিন মাছের পুরুষ প্রজাতিগুলো মিলনে আকৃষ্ট করার জন্য নীল, সবুজ এবং কমলা রঙ দেখায়। কেবল পুরুষ মাছ নয়, কিছু ভিন্নতাও আছে। কিছু প্রজাতির মহিলা মাছও নিজেকে রঙিন করে। পাইপফিশের মহিলা প্রজাতিরা ডিম বহনকারী পুরুষদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য উজ্জ্বল রঙ দেখায়।
মাছ বিভিন্ন কারণেই তাদের এমন রঙ ধারণকে বিকশিত করেছে। কখনও বেঁচে থাকার জন্য, কখনো একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে, কখনও সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে। আবার কখনও কখনও কেবল তাদের পরিবর্তনশীল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে। প্রকৃতির এমন বর্ণিল রূপ আসলে বেঁচে থাকার কৌশলগুলোর একটি সিস্টেম। এই সিস্টেম লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিমার্জিত, পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে।

Share.

মন্তব্য করুন