একসময় মানুষের অবসর সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল বই। তখন অনেকেরই নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস ছিল। অথচ সভ্যতার আধুনিকায়নে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, বই পড়ার বিষয়টি চিন্তাই করি না। মানুষ হয়ে পড়ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর। ভিডিয়ো গেইমে আসক্ত হয়ে তরুণ সমজ পৌঁছে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, বিশ^জুড়েই তরুণদের বই পড়ার প্রবণতা কমেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজ ও পরিবার। দিন দিন বিলিন হয়ে যাচ্ছে মানুষের পাঠ্যাভ্যাস। ছোট কিংবা বড়, অভিভাবক কিংবা সন্তান, শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী সকলেই হয়ে পড়ছে বই বিমুখ।
প্রযুক্তির বিকাশেও বাংলাদেশে বই বিক্রি কমেনি। দিন দিন বই বিক্রি বাড়ছে। প্রতিবছরই বই মেলায় বাড়ছে বই বিক্রি। তাহলে বইগুলো কারা পড়ছে! জরিপ বলছে, সিনিয়র সিটিজেনরাই বেশি বই পড়ে থাকেন। যেহেতু তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণ কম তাই তারা বইকে অবসর সময়ের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছেন।
আসলেই তো বই মানুষের পরম বন্ধু। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দীর্ঘ নবুয়তি জীবনের প্রথম শব্দ ছিল ‘পড়’। বই মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষায় উজ্জীবিত করে একজন আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে উঠতে সাহয্য করে। কবি আসাদ বিন হাফিজের ভাষায়-
“বই পড় ভাই বই পড়
মজার মজার বই পড়
জানার জন্য বই পড়
মানার জন্য বই পড়।”
বই মানুষের মনের খোরাক। বই পাঠ মানুষকে মানসিক প্রশান্তি দান করে, মানুষকে ভাবতে শিখায়, স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। এছাড়াও বই পাঠের আরো নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। চলুন সেগুলো জেনে নেয়া যাক-

মানসিক প্রশান্তি দেয়:
বই মানুষকে মানসিক প্রশান্তি দেয়। প্রমথ চৌধুরী তার ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, “লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল।” মানসিক চাপ কমানোর একটি উত্তম উপায় হলো পাঠ্যাভ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমান প্রজন্ম অতিমাত্রায় মানসিক চাপে ভোগে। মানুষের সংগ্রামমুখর জীবনে মনের কোনে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা এসে বাসা বাঁধে। যা মানসিক চাপ বাড়ায়। নিয়মিত বই পড়ার মাধ্যমে সেসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা যায়। যেমন- মানুষ যখন কোনো গল্প পড়ে তখন গল্পের প্রাণহীন চিত্রগুলো তার কল্পনার জগতে ভাসতে থাকে। এর ফলে মানুষের মনে অন্য কোনো চিন্তর স্থান পায় না। ফলে মানসিক চাপ তার থেকে দূরে সরে যায়। আর মানুষকে দেয় মানসিক প্রশান্তি। মোটিভেশনাল বা আধ্যাত্মিক বই পড়ার ফলে মানুষের আত্মবিশ^াস বাড়ে। যুক্তরাজ্যে শিক্ষার্থীদের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ‘যারা নিয়মিত বই পড়েন তারা মানসিক সমস্যায় কম ভোগেন’।

মনোযোগ বৃদ্ধি পায়:
প্রযুক্তির অতিরিক্ত ও অপব্যবহারের ফলে সামাজিক, মানসিক, নৈতিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে; এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোট ছোট রিলস ভিডিয়ো দেখা, ছোট ছোট স্ট্যাটাস পড়ার ফলে মানুষ এখন বড় কোনো কাজে বা বড় কোনো বই পড়ায় মনোযোগ হারাচ্ছে। যেকোনো কিছু সে খুব অল্প সময়ে অর্জন করতে চাই। কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারার ফলে তার কাজটি আশানুরূপ হচ্ছে না। বইয়ে লিপিবদ্ধ জ্ঞান আহরণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে ধৈর্যের সহিত বইটি পড়তে হয়। যার ফলে কাজের প্রতি মানুষের মনোযোগ বাড়ে।

স্মৃতিশক্তি বাড়ায়:
মস্তিষ্কের কর্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত বই পড়া একটি কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বই পড়ার ফলে মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে আরো বেশি সক্রিয়। বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, বই পড়া অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক সচল হয়ে ওঠে। মার্কিন সাইকোলজিস্ট ও নিউরো সায়েন্টিস্ট রবার্ট উইলসনের মতে, যারা নিয়মিত পড়াশোনা করেন তাদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অর্থাৎ বই পড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য কার্যকর। মানুষকে সুস্থ ও সবল থাকতে হলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যায়াম প্রয়োজন। মস্তিষ্কের ব্যায়াম হলো বই পড়া। যা মস্তিষ্ককে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর রাখে। মানুষ যখন কোনো গল্পের বই পড়ে তখন তার মস্তিষ্ক গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের নাম ও প্রেক্ষাপট মনে রাখতে বাধ্য হয়। ফলে স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়। নিয়মিত বই পড়ার ফলে মানুষের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মানুষের মস্তিষ্ক প্রচুর তথ্য ধরে রাখতে সক্ষম। বই পড়লে এই ক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।

মানসিক উদ্দীপনা দেয়:
বই পড়লে মানুষ মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বই পড়ার অন্যতম উপকারিতা হলো- ‘নিয়মিত বই পড়া মানুষের আলঝাইমার ও ডিমেনশিয়ার মতো মানসিক রোগের প্রক্রিয়া ধীর করে। এর ফলে মস্তিষ্ক উদ্দীপ্ত ও সচল হয়।’ বই মানুষকে অনুপ্রাণিত করে সফলতার লক্ষ্যে পথ চলতে। মানুষ যখন বই পড়ে তখন সে কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়। সে যা কখনো ভাবেনি তা ভাবা শুরু করে, যা বিশ^াস করেনি তা বিশ^াস করা শুরু করে। বইয়ের প্রাণহীন প্রতিটি পাতা মানুষের মনের স্পর্শে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সেই উদ্দীপ্ত মানুষগুলো বইয়ের সংস্পর্শে অসাধ্যকে সাধন করতে প্রস্তুত হয়ে পড়ে।

শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়:
নিয়মিত বই পাঠের মাধ্যমে নতুন নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। জানা যায় অনেক সমার্থক ও বিপরীত অর্থবোধক শব্দ। শব্দভাণ্ডারে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন শব্দের সমাহার। নিয়মিত বই পড়ার ফলে শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাসের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। আর সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার ভাষার উপর দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়।

চিন্তায় স্বচ্ছতা আনে:
মানুষ বই পড়ার সময় কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। সে বইয়ে পড়া চরিত্রগুলো নিজের মাধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করে। বই মানুষের চিন্তার দক্ষতা উন্নত করে। বিশেষ করে রহস্য উপন্যাস পড়ার অভ্যাস মানুষের চিন্তায় স্বচ্ছতা নিয়ে আসে। যার ফলে মানুষ যেকোনো সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করতে পারে।

বলবার দক্ষতা বাড়ায়:
কথা বলার দক্ষতা হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় দক্ষতা। শুধুমাত্র একটি শব্দের চয়নে উপস্থাপন শৈলী হতে পারে হৃদয়গ্রাহী। পাঠ্যাভ্যাসের ফলে মানুষের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। যার বাস্তব প্রয়োগ করা হয় বলবার মাধ্যমে। নিয়মিত বই পড়ার ফলে কথা বলবার সময় সঠিক শব্দ ব্যবহার করা মানুষের জন্য সহজ হয়।

বিশ্লেষণ দক্ষতা বাড়ায়:
যেকোনো বই রচিত হয় কোনো না কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এবং তাতে তথ্য-উপাত্যের ব্যাপক সন্নিব্যশ থাকে। যা পাঠকদের জ্ঞান আহরণ ও চিন্তাশক্তির উন্নয়নে সাহায্য করে এবং বিশ্লেষণ দক্ষতা বাড়ায়।

লিখবার দক্ষতা বাড়ায়:
লেখকদের বলা হয় জাতির বিবেক। একজন লেখক তখনই সার্থক লেখক হবেন যখন তিনি নিয়মিত অধ্যয়ন করবেন। আর তখনই লেখকের লেখার মান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

বিনোদনের মাধ্যম:
মানুষ বিনোদনের জন্য নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন সিরিজ দেখে থাকে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আমাদের দেখা প্রিয় অনেক নাটক, সিনেমা কিংবা সিরিজ বিখ্যাত উপন্যাস বা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। আবার অনেক সিরিজ আছে যেগুলো ইতহাস অবলম্বনে লেখা। যেমন- আমরা যদি তুর্কি সিরিজ দিরিলিস আর্তগ্রুল বা কুরুলস উসমানের কথা বলি, সেগুলো উসমানীয় সা¤্রাজ্যের ইতিহাস অবলম্বনে নির্মিত। আমরা উসমানীয় সা¤্রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থ- ‘সানজাক-ই উসমান’ বা ‘উসমানি সা¤্রাজ্যের ইতিহাস’ বইগুলো পড়লে উসমানীয়দের সেসব ইতিহাস জানতে পারব। আবার নতুন নতুন অনেক বিষয়ের সাথেও আমাদের পরিচয় হবে। কিন্তু সিরিজের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সিরিজটিকে দর্শকের কাছে আকর্ষনীয় করে উপস্থাপন করতে পরিচালক অনেক চরিত্রের পরিবর্তন, পরিবর্ধন-পরিমার্জন করে থাকেন। তাই ইতিহাসের কিছু তথ্য সিরিজ থেকে বাদ পড়ে যায় বা নতুন কিছু সংযোজন হয়। যার ফলে, সঠিক ইতিহাস জানা হয় না। কিন্তু বই পড়লে আপনি সঠিক ইতিহাসও জানতে পারবেন আবার বিনোদনও পাবেন।

নতুন তথ্যের সন্ধ্যান পাওয়া যায়:
নিয়মিত পাঠ্যাভ্যাসের ফলে নানা ধরণের বই পড়া হয়। সেসব ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বই থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্যের সন্ধ্যান পাওয়া যায়। যা বাস্তবে প্রয়োগের ফলে মানুষের জীবন চলার পথ সুগম হয়।

অবসাদ দূর হয়:
মানুষের কর্মময় জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে বই হতে পারে অবসাদ কাটানোর অন্যতম মাধ্যম। নিয়মিত বই পড়লে রক্তচাপ কমে, হার্ট ভালো থাকে। ফলে মানসিক অবসাদ কেটে যায়।

Share.

মন্তব্য করুন