ছোটবেলায় আমরা সবাই একটা বুদ্ধিমান কাকের গল্প পড়েছিলাম। বিরাট একটা কলসির নিচে ছিল কিছুটা পানি। তৃষ্ণার্ত একটা কাক ঘুরতে ঘুরতে কলসির উপর এসে বসল। কলসির নিচে পানি দেখে তার পানির পিপাসা আরও বেড়ে গেল। কাকটা চারদিকে তাকিয়ে একটা বুদ্ধি বের করল মাথা খাটিয়ে। কলসির চারদিকে পড়ে থাকা নুড়িপাথর থেকে একেকটা করে ঠোঁটে বয়ে এনে সে ফেলতে শুরু করল কলসির ভিতর। একটু একটু করে কলসির পানির স্তর বাড়তে বাড়তে কাকের ঠোঁটের নাগালে চলে এলো। তারপর কাক পেট ভরে সেই পানি পান করে তার পিপাসা মিটালো।
এই গল্পটা তো আর এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি! মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় কাকের এমন ব্যবহারিক জ্ঞান দেখেই কেউ হয়তো প্রথম গল্পটা লিখেছিল। প্রায় সব দেশেই এই গল্পটা খুব জনপ্রিয়। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই কাকের বুদ্ধির এই গল্প অতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। সর্বত্রই মানুষ আর কাকের সহাবস্থান। মানুষের উচ্ছিষ্ট কাকের খাদ্য। কাক তাই মানুষের এক উপকারী বন্ধুও বটে। কিন্তু কাকেশ^রের গায়ের রঙটা কুচকুচে কালো হওয়ার কারণে মানুষ কাককে খুব একটা পছন্দ করে না। অনিষ্টের ভয়ে তাই মানুষ চিরকালই কাক দেখলেই ‘হুস হুস’ শব্দ করে তাদের তাড়িয়ে এসেছে। অথচ একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, এই পাখিটি দেখতে কালো হলেও বড়োই বুদ্ধিমান, উপকারীও বটে।
সত্যি সত্যি কলসিতে নুড়িপাথর ফেলে পানি বাড়িয়ে কাকের পানি পান করার ক্ষমতা আছে কি না দেখার জন্য প্রাণীবিজ্ঞানীরা একটা প্লাস্টিকের চোঙাকৃতি বিরাট জারে কিছুটা পানি রেখে দিয়ে ভাসিয়ে দিলেন একটা রঙিন খেলনা। চারপাশে রেখে দিলেন কিছু পাথরের টুকরো। তারপর আড়াল থেকে কাকের উপর নজর রাখলেন। কী আশ্চর্য! দেখা গেল একটা কাক এসে কিছুক্ষণ পানির জার আর তার ভিতরে রেখে দেয়া খেলনাটা খুঁটিয়ে দেখে নিলো; তারপর একটা একটা করে পাথর ফেলে পানির স্তর উঁচু করতে লাগল যতক্ষণ পর্যন্ত না রঙিন খেলনাটা তার নাগালের মধ্যে চলে আসে। বিজ্ঞানীরা কাকের এই অত্যাশ্চর্য কর্মকাণ্ডের ভিডিও তুলে রেখে দিলেন।
কাকের প্রখর বুদ্ধির একটা লক্ষণ হলো, সুবিধামতো যন্ত্র বানিয়ে ফেলার দক্ষতা। খাবারের সন্ধানে কাকেরা গাছের ডাল ভেঙে, তারপর প্রয়োজনমতো সেটার একদিক বাঁকিয়ে নেয় আঁকশি দিয়ে খাবার তুলবে বলে। একদল বিজ্ঞানী-পর্যবেক্ষক একটা প্লাস্টিকের পাইপে ভরে দিলেন সুস্বাদু প্রাণীর মাংস। তারপর পাইপের কয়েকটা জায়গায় ফুটো করে দিলেন। পাইপের পাশে রেখে দেওয়া হলো কিছু লোহার তারের টুকরো। দেখা গেল, একটা কাক এসে প্রথমে খাদ্যের অবস্থান বেশ গুছিয়ে বুঝে নিলো; তারপর একটা সরু তার বেছে নিয়ে কায়দা করে ঠোঁটের সাহায্যে একটা দিক বেঁকিয়ে নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পাইপের ফুটো দিয়ে মাংস বের করে মজা করে খেতে লাগল।
প্রাণীবিজ্ঞানীরা কাকদের অদ্ভুত আচরণ দেখে ভারি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারা গবেষণা করতে লাগলেন কাকের মস্তিষ্ক নিয়ে। মানুষের বুদ্ধির চাইতে কোনও অংশে ছোটো করা যাবে না তুচ্ছ এই পাখিটাকে। তার মাথায় ঘিলুটা কিন্তু রাখা আছে ছোট্ট একটা আখরোটের মাপের খোলে। আরও জানা গেল, মানুষের ঘিলুর সঙ্গে তাদের ঘিলুর অনেক তফাত। প্রাণীদের ক্ষেত্রে ভাবতে গেলে বা বুদ্ধি খাটাতে গেলে যেটা লাগে, তা হলো মস্তিষ্কের নিউরন কোষ। দেখা গেল, গুচ্ছ গুচ্ছ নিউরন জটিলভাবে পাকিয়ে আছে কাকের মাথায়। নিউরনের জটিল খেলায় কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তারা আগে থেকে নিতে পারে যে কোনও সিদ্ধান্ত, যাকে মানুষ বলে ‘বুদ্ধি খাটানো’।
দুষ্টু বুদ্ধিতে কোনও জুড়ি নেই কাকের। যেমন মানুষের বাচ্চারা দুষ্টুমি করে, ঠিক তেমনভাবেই কাক কখনো গৃহস্থের ছাদ থেকে তেলের বাটি নিয়ে পালায়, কখনো চামচ বা অন্য জিনিস ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে গাছের মগডালে পালায়। সেজন্য অনেকেই কাককে চোর বলে থাকে। পরের জিনিস না বলে নিয়ে গেলে মানুষ তাকে চুরি বলে। তবে কাকেরা এই কাজটাকে চুরি হিসাবে দেখেই না, তাই চোরের বিচারও হয় না। তারা চুরি করে নেহাত কৌতূহল মেটাতে, কিংবা নিজের প্রয়োজনীয় যন্ত্র বানাবে বলে। কাকের বাসায় যদি হানা দেওয়া যায়, তবে মিলবে এমনই সব চুরির মাল।
কাক মানুষ চিনতেও সিদ্ধহস্ত। যদি একবার কেউ কাকের বাসায় ঢিল মারে, তবে আর রক্ষে নেই। দশ দিন পরও যদি সেই লোকটা কাকের বাসার পাশ দিয়ে যায়, চোঁ করে কোথা থেকে উড়ে এসে ঠিক সেই লোকটার মাথায় ঠোকর দিয়ে যাবে। তাদের মানুষ চিনে রাখার ক্ষমতা অবাক করেছে বিজ্ঞানীদেরও। আমেরিকার পক্ষী-বিজ্ঞানী ম্যাক গোয়ান কাকের বাসায় হানা দিলেন তাদের গতিবিধি কাছ থেকে দেখবেন বলে। যেই না তিনি কাকের বাসার ধারে কাছে এসেছেন, অমনি ‘কা কা’ চিৎকারে একদল কাক এসে বেচারাকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে তুলল। সেদিন তাঁকে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল। কিন্তু তার পরদিন তিনি ওদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে গেলেন। প্রথমে চেঁচামেচি করে কাকগুলো তাঁকে এই ঠোকর দেয় তো সেই ঠোকর দেয়। আত্মরক্ষার জন্য ঠোকর ছাড়া আর কী-ই বা আছে তাদের! ভদ্রলোক অবাক হলেন, যখন তিনি দেখলেন কাকেরা খাবার-দাবার পেয়ে বেজায় খুশি। তারপর থেকে রোজ তিনি কাকেদের বাসার কাছে আসতেই কাকেরা ‘কা কা’ করে তাকে রীতিমতো অভ্যর্থনা করতে শুরু করল, আক্রমণ করা তো দূরের কথা। কিছুদিন একনাগাড়ে খাবার জোগাড় দেবার পর ইচ্ছে করেই তিনি একদিন খালি হাতে গেলেন কাকের বাসায়। কাকেরা কিছুক্ষণ পর যেই না বুঝেছে যে তিনি সেদিন তাদের জন্য কিচ্ছু আনেননি, বেজায় রেগে গিয়ে তারা বিজ্ঞানী ম্যাক গোয়ানকে ঠোকরাতে শুরু করে দিলো। এই পরীক্ষায় তিনি প্রমাণ করেছিলেন, কাকেরা জ্ঞান-ভিত্তিক বুদ্ধি ধরে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘কগনিটিভ স্কিল’।
কোনও কাক মারা গেলে দেখা যায় অসংখ্য কাক কোথা থেকে জুটে এসে ‘কা কা’ শব্দ করছে সমস্বরে আর গোল হয়ে চক্কর দিচ্ছে আকাশে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটি তাদের সংঘবদ্ধ মানসিকতার পরিচয় দেয়। অর্থাৎ একে অপরের দুঃখ তারা ভাগ করে নিতে জানে।
পক্ষী বিশেষজ্ঞরা কাকের শ্রেণীবিভাগ করেছেন ‘করভিড’ শ্রেণীতে। এই শ্রেণীর পাখিদের মধ্যে কাক ছাড়াও আছে দাঁড়কাক, যারা আকারে সাধারণ কাকের তুলনায় বড়ো, টিয়া, কাঠঠোকরা ইত্যাদি। কাকের মতোই তাদের বিভিন্ন একজাতীয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। পাহাড়ে লক্ষাধিক বছর আগের গুহাচিত্রে মানুষের সঙ্গে কাকের ছবি পাওয়া গেছে। যা থেকে বোঝা যায়, মানুষের সঙ্গে তার সখ্যতার ইতিহাসটা অনেক লম্বা। উত্তর মেরুর এস্কিমোরা মরা কাকের পা বাচ্চাদের গলায় ঝুলিয়ে দিত এই বিশ^াসে যে, কাক তাদের সন্তানদের রক্ষা করবে।
দুটো কাক হয়তো একটা মানুষকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ‘কা কা’ করে হৈ চৈ বাধিয়ে দিয়েছে। এটা আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ ঘটনা বলে মনে হলেও পক্ষী বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন তারা পরস্পরের মধ্যে মত বিনিময় করে মানুষটির গতিবিধি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যদি কোনও কারণে ব্যক্তিটি সন্দেহের যোগ্য হয়, তবে মিলিতভাবে তাকে আক্রমণ করতে কাকেদের সময় লাগে না। যদিও মানুষ কাকের ভাষা বোঝে না, তবুও তাদের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করে বিজ্ঞানীরা সাধারণত মানুষের কানে কাকের ‘কা কা’ ডাকের মধ্যে কম্পাঙ্কের তফাত খুঁজে পেয়ে মনে করছেন কাকেদের নিজস্ব ভাষা আছে।
Share.