পশ্চিমের পথ ধরে, গায়ে শুভ্রতা ছড়িয়ে যে কাফেলাটি নিরন্তর পথ চলছে ওরা সবাই পশ্চিমের পথিক। আমিও ছিলাম সেই কাফেলার এক নগণ্য মুসাফির। সঙ্গ ছিল, সঙ্গী ছিল। পথ ছিল, পাথেয় ছিল। তাই ভয় ছিলো না, সাহস ছিলো।
আমরা ছিলাম ভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন বর্ণের। আমাদের ভাষাও ছিল ভিন্ন তবে গন্তব্য অভিন্ন। আমরা সবাই ছিলাম পশ্চিমের মুসাফির। আমাদের গন্তব্য অনেক দূর। মনজিল বহুদূর। আমরাও ছিলাম বদ্ধমূল। দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে আমরা অবিরাম পথ চলছিলাম। নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছিলাম। দিনের পর রাত, রাতের পর দিন এই পথচলা অব্যাহত ছিল।
আমি চলছি। আমরা এগুচ্ছি। চলতে চলতে আমি যেনো দেখতে পেলাম অদৃশ্যের এক ছায়া। আমি ছিলাম ক্লান্ত-শ্রান্ত। তাই সেই ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। বিশ্রাম নিতে লাগলাম। এভাবে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গাফিলতের ঘুমে বিভোর হলাম। কিন্তু সেটা যে ঘুম ছিলো না বরং পথচ্যুতের মূল। সেটা ছিল পথ হারানোর ধাঁধা।
আমি ঘুমোলাম। ঘুমোতেই লাগলাম। হঠাৎ মনে হলো কে যেন মৃদু আওয়াজে আমাকে জাগিয়ে তুললো। আমি জাগলাম। কিন্তু সঙ্গহীন হলাম এবং সঙ্গহারা হলাম। পথচ্যুত হলাম এবং পাথেয় হারা হলাম। আমি হারিয়ে ফেললাম আমাদের সেই শুভ্র কাফেলা। হারিয়ে ফেললাম সব পাথেয়। অথচ আমি জানি না আমার গন্তব্য। আমি চিনি না আমার মনজিল।
আমি তখন অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হলাম। নিজেকে খুব তিরস্কার করলাম। এখন আমি কোথায় যাবো? কিভাবে পথ খোঁজে পাবো? কিভাবে কাফেলায় শামিল হবো? আমি যেনো হয়ে গেলাম অকূল দরিয়ার মাঝি। পথহারা পথিকের মতো। দিকহারা নাবিকের মতো। আমি তখন আর্তনাদ করলাম ও ফরিয়াদ জানালাম। কিন্তু কেউ শোনেনি আমার ফরিয়াদ। কেউ বোঝেনি আমার আর্তনাদ। কেউ আমায় পথ দেখায়নি এবং পাথেয় জোগায়নি। আমি তখন অসহায় হয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার চোখে অঝোরে অশ্রু ঝরছিল।
হঠাৎ মনে হলো কে যেনো আমার কাছে এলো! কে যেনো আমায় সান্ত¡না দিলো! আর তাতেই আমার উপশম হলো। আমার অস্থির অন্তরাত্মা স্থির হলো। আর তখন যেনো অদৃশ্য থেকে আমি শুনতে পেলাম ‘বান্দা যতই বিপদে পড়ো এবং বিপথে চলো আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।’
আমি অভিভূত হলাম এবং অদৃশ্য সত্তার কাছে নিজেকে সঁপে দিলাম। তখন যেনো মনে হলো আমার ফরিয়াদ কবুল হলো, আমার আর্তনাদ গৃহীত হলো। আমি যেনো পেয়ে গেলাম আমার পথ এবং পাথেয়। আমি যেনো দেখতে পেলাম চারদিকে শুধু নূর আর নূর। আমি যেনো নূরের সরোবরে অবগাহন করছি। তখন আমার মুখমণ্ডল হয়ে গেলো আলোঝলমল। আমার সর্বসত্তায় আনন্দের দোল খেলো। আমি আন্দোলিত হলাম এবং উত্তোলিত হলাম। অজানা শিহরণে শিহরিত হলাম। আমি তখন হিম্মত পেলাম, নির্ভীক হলাম। আবারো আমি সামনে এগিয়ে চললাম। সঙ্গ ছিলো না, পাথেয় ছিলো না। তবুও যেনো মনে হলো কেউ আমাকে সঙ্গ দিলো! কী যেনো আমার পাথেয় হলো! আমি অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে পথ চলছিলাম সময়ের পর সময়। কে যেনো আমার ‘রাহনুমায়ী’ করল। সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে অচেনা গন্তব্যের পথিক হয়ে আমি পথ চলছিলাম। বৃষ্টির রিমঝিম, তারকার ঝিলমিল যেন আমায় অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। আমি বিপুল উদ্যমে কাক্সিক্ষত গন্তব্যের উদ্দেশে পথ চললাম।
চলতে চলতে হঠাৎ একসময় দেখতে পেলাম আমার হারানো সেই আলোঝলমল কাফেলাটি। খুঁজে পেলাম আমার হারানো পথের পাথেয়। আমি তখন অবাক হলাম। অভিভূত হলাম। কে আমাকে পথ দেখালো? কে আমার পাথেয় জোগালো?
এসব যখন ভাবছিলাম ঠিক তখন মনে পড়ল অদৃশ্যের সেই ইশারার কথা। আমি বুঝতে পারলাম এটা ছিল অদৃশ্যের দান ও অদৃশ্য সত্তার ইহসান। আমি শোকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। আহ্লাদে আত্মহারা হয়ে আমি আবার শামিল হলাম আমাদের সেই নূরানি কাফেলায়। আমি আবার পশ্চিমের পথিক হলাম। আবার পশ্চিমে এগিয়ে চললাম।

Share.

মন্তব্য করুন