ছয়টি ঋতুর চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো এক অবাক করা সবুজ দেশ বাংলাদেশ। বিস্ময়কর এদেশের প্রকৃতি। স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। এ জন্যই কত কবির চোখে বাংলাদেশের রূপ-বৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও সৌন্দর্য উঠে এসেছে নানান ভাবে। নানান উপমায়। নানান বাক-ভঙ্গিমায়। যেমন,
‘সোনার কাঠি রূপোর কাঠি
তার চেয়ে যে অনেক খাঁটি-
দুধের বাটি উপচে পড়া শস্য-শ্যামল দেশ,
সাতটি রঙে ধাঁধা আমার সোনার বাংলাদেশ।’
এটা বলার পরও তৃপ্ত হয় না মন। আরও বলতে ইচ্ছে হয়, শুনতে ইচ্ছে হয়। কথায়, কবিতায় বা গল্পে যতটুকু বলা যায়, তার চেয়েও হাজার গুণে সুন্দর আমাদের প্রাণপ্রিয় এই বাংলাদেশ। সুন্দর এর প্রতিটি ঋতুই।
বছরের পঞ্চম ঋতু ‘শীত’। পৌষ ও মাঘ মাস নিয়েই শীতের আসর। শীতের সাথে বাংলার অন্য কোনো ঋতুর সামান্যতমও কোনো মিল নেই। একেবারেই আলাদা। শীতকালে বাংলার প্রকৃতি একবারেই বদলে যায়। গ্রাম-গঞ্জের চেহারা তো হয়ে যায় আরও ভিন্নতর। মাঠ, ঘাট, সুদূর-অদূর কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে সারারাত, সকাল, এমনকি অনেক বেলা পর্যন্ত। কখন যে সূর্য ওঠে তাও ঠিক বোঝা যায় না। ভোরের সূর্যকেও কুয়াশার চাদরে মুড়ে লুকোচুরি খেলে শীত। সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়ার আগেই আবারো কুয়াশা ডানা মেলে। কুয়াশার এই নিত্য খেলা চলে শীতের পুরো দু’টি মাস।
শীতকাল মানেই তো শীতের দাপট! সেটাই স্বাভাবিক। তা না হলে আর শীতকাল কেন! সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত ঝরতে থাকে শিশির কণা। শিশির ভেজা প্রকৃতি, বিস্তীর্ণ মাঠে হলুদ সরষে ফুল, দুই ধারে জমে থাকা শিশির, কুয়াশাচ্ছন্ন ঘাসের পাতা, কচুরপাতা সূর্যোলোকে হীরকের মতন ঝিকিমিকি ঝল-জলানি। এমন দৃশ্যে অনায়াসে এসে যায় কবিতা দু’লাইন-
‘সকালে সোনার রবি করে ঝিকমিক
সবুজ ঘাসের পাতায় শিশির কণা করে চিকচিক’।
শীতের সকালে পুকুরের দিকে তাকালে তো চোখ আর ফেরানো যায় না। যেন পুকুরের বুক জুড়ে ভাপ উঠছে! মনে হচ্ছে পুকুরটাকে বড় একটা কড়াইয়ের ওপর চাপিয়ে জ¦াল দিচ্ছে কেউ। দেখতে যত মজাই লাগুক না কেন, কখনো ঐ পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার দুঃসাহস দেখাইনি। কারণ তার পানি এত ঠাণ্ডা যে, মনে হবে পা-দু’টি যেন পানির নিচ থেকে কেউ টেনে ধরেছে। শুধু পুকুরের পানি কেন? শীতের দাপট চলে সর্বত্র। এ জন্যই তো সন্ধ্যা হবার আগেই ছোট-বড়ো সবাই গায়ে জড়িয়ে নেয় রাজ্যির কাপড়-চোপড়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখে শীতের ভয়ে। তাতেও কি রক্ষা হয়? হয়তোবা শহরে কলকারখানার কারণে শীতের প্রভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু গ্রামে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সকাল-সন্ধ্যায় ঘুঁটি কিংবা নাড়ার আগুন জ¦ালিয়ে সবাই তার পাশে গোল হয়ে বসে আগুন পোহায়। সে এক মজার দৃশ্য! কবির চোখে শীতটা কেমন? কেমন তাঁর অনুভূতি? নাকি তিনিও কাঁপছেন শীতের দাপটে। এজন্যই হয়তো কবি ঈশরচন্দ্র গুপ্ত ‘মানিনী নায়িকার মানভঙ’ কবিতায় খানিকটা কৌতুক ও হাস্যরসে বর্ণনা করেছেন,
‘বসনে ঢাকিয়া দেহ গুঁড়ি মেরে আছি।
উহু উহু প্রাণ যায় শীত গেলে বাঁচি॥
হাসিয়া নাগর কহে, খোল প্রাণ মুখ।
শীত-ভীত হয়ে এত ভাব কেন দুখ॥
ছয় ঋতুর মধ্যে শীত করে তব হিত।
হিতকর দোষী হয় একি বিপরীত॥’
শীত নিয়ে এ ধরনের বহু ছড়া-কবিতা লিখেছেন আমাদের দেশের কবিরা। এখনো লেখা হচ্ছে। আগামীতেও হবে। কারণ শীত এমন একটি ঋতু- যাকে উপেক্ষা করতে পারেন না কোনো কবিই।
এত যে শীত! এত যে ঠাণ্ডা!- তবুও থেমে থাকে না গ্রাম-বাংলার জনজীবন। তাদের কর্মপ্রবাহ। খুব ভোরেই আমার বড় কাকা খালি পায়ে ছুটে যেতো মাঠে। শুধু আমার কাকা কেন, সব কৃষকের এক রুটিন। কাঁধে বাক। বিকেলে খেজুর গাছ কেটে ছিল। সারারাত ভাঁড়ে জমেছে সুস্বাদু খেজুর রস। ভাঁড়ভর্তি সেই রস পাড়তেই ছুটে চলে মাঠের দিকে। পা দু’টি শির শির করে। শরীরও কেঁপে কেঁপে উঠে। মাড়িও কাঁপে শীতে। তবুও আমার কাকার মতো থেমে নেই কোনো কৃষক। শীতকে উপেক্ষা করে উঠে যায় খেজুর গাছে। এক গাছ থেকে অন্য গাছে। রসের ভাঁড় পাড়া শেষ হলে বাকের দুই পাশে ঝুলিয়ে নিয়ে আসে বাড়িতে। ততক্ষণে কাকার শিশির ভেজা দুই পায়ে সর্ষে ফুল জড়িয়ে হলুদ এবং ভারী হয়ে যায়! চাতালে সারি সারি রসের ভাঁড়। যে গাছের রস সবচেয়ে মিষ্টি এবং সুস্বাদু সেই গাছের রসের ভাঁড়টি আলাদা করা। বাড়ির সকলেই গ্লাস নিয়ে প্রস্তুত। আমরা পাটকাঠির নল গ্লাসে ডুবিয়ে রোদে বসে আয়েশ করে রস খেতে খুবই পছন্দ করতাম। বাকি রস সবই বড় কড়াই-এ ঢেলে, আগুনে জ্বালিয়ে তৈরি হতো গুড়। খেজুরের গুড়ের যে স্বাদ তারও তুলনা হয় না। খেজুর রস এবং গুড় দিয়েই ঘরে ঘরে তৈরি হয় পিঠা, পায়েস আরও কত কী! পুরো গ্রাম জুড়েই খেজুর রসের মন মাতানো মৌ মৌ গন্ধ। ধুম পড়ে যেতো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সে ভাপা পিঠা খাওয়ার। বাংলা বালার হাতের সুনিপুণ পটুতায় ঢাকনা ঢাকা হাঁড়ির উপরে একরতি কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে মোড়ানো উঠছে আতপচালের গুঁড়ো ঢাকা, নতুন খেঁজুর গুড় আর নারিকেল দেয়া ছোট বাটি। নামছে এক একটা ভাপা পিঠা। এ যেন পরম আদর, স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসার এবং পারিবারিক অটুট বাঁধনের এক চিরায়িত গ্রাম বাংলার চিরচেনা শীতকালীন ছবি। এসময় আরো অনেক পিঠা তৈরি করে থাকে মানুষ, তান্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য- চিতই, দুধচিতই, বড়াপিঠা, পাটিসাপটা, দুধপুলি, ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি প্রভৃতি পিঠার বেশ প্রচলন রয়েছে।
এই মৌসুমে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করে কৃষকেরা। কোনো কোনো ক্ষেতে আমনের খড়-বিচুলিও থাকে। আর মাঠের পর মাঠ ভরে থাকে রবিশস্য- মটরশুঁটি, ছোলা, মাষকলাই, মুগ, সরিষা, পিঁয়াজ, রসুন, ধনেসহ আরও কত্ত কী! বাড়ির সবাই দল বেঁধে নাড়ার আগুনে পুড়িয়ে মজা করে খেতাম ছোলা ও মটরশুঁটি। আর প্রজাপতি ও মৌমাছির নিত্য আনাগোনা চলতো সরষে ক্ষেতে। সে দৃশ্য তো ভোলাই যায় না! শীত এলেই আর এক অবাক করা বিষয় ঘটে আমাদের এই দেশে। দেশীয় পাখি- ঘুঘু, শালিক, বাবুই, চড়–ই, দোয়েল, বক, মাছরাঙা প্রভৃতি তো আছেই। তাদের সাথে যুক্ত হয় পৃথিবীর বহু দেশ থেকে আসা অতিথি পাখির ঝাঁক। তারা আসে দল বেঁধে। ঝাঁকে ঝাঁকে। এদের মধ্যে থাকে বিভিন্ন জাতের হাঁস, সরাল, নীল ডানা হাঁস, জোয়ারি, সাদা সারস, ধূসর বটের পাখি, চখাচখিসহ কত না পাখি! পুরো শীতকাল জুড়েই হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল সরব হয়ে থাকে দেশীয় ও অতিথি পাখির কলগুঞ্জনে। কিছু দুষ্টু লোক এই সময় অন্যায় ও নিষ্ঠুরভাবে শিকার করতে থাকে দেশীয় ও অতিথি পাখি। সত্যিই এটা কষ্টের। সাংঘাতিক বেদনার। এভাবে নির্বিচারে অতিথি পাখি শিকার করা আদৌ কি উচিত!
শীতের সূর্য! ভোরে নাগালে পাওয়াই দুষ্কর। শীতের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত হলো শীতের সকাল। ছোট বড় সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন রোদ পাবো! কখন রোদে বসে শরীরটা একটু গরম করে নেবো! কখন! প্রতীক্ষার পালা চলতে থাকে। বিশেষ করে যারা গরিব, অভাবী, যারা শীতের কাপড় কিনতে পারে না, তাদের তো কষ্টের কোনো সীমা থাকে না। কনকনে শীতে তুরতুর করে কাঁপতে থাকে তারা। রাতের জন্য তেমন লেপ-কাঁথাও থাকে না তাদের। শীতটা তাদের বেশ কষ্টেই কাটে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা যদি ঐ অসহায়দের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তাদের কষ্ট কমে যায়। আমাদের কিন্তু তেমনি দরদি এবং সহমর্মী হওয়া প্রয়োজন।
শীতের আর একটি মজাদার বিষয় হলো- ভ্রমণ। দল বেঁধে পিকনিক, বনভোজন ইত্যাদির জন্য খুবই উপযুক্ত ঋতু এটা। কারণ গরম নেই, ঝড়-বৃষ্টি নেই, প্রকৃতির পাগলামো নেই, কাঠফাটা রোদ নেই। ঝামেলা বা ভয়ের কোনো কারণই নেই শীতে। সুতরাং বন্ধুবান্ধব মিলে, দলবেঁধে এ ধরনের আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতে অসুবিধা কোথায়। অসুবিধা নয়, বরং সুবিধাই বেশি। তাই তো শীত এলেই গোটা দেশ যেন মেতে ওঠে আনন্দে। একের পর এক চলে, ক্রমাগত চলে চড়–ইভাতি, পিকনিক, বনভোজনসহ নানা নামে, নানা রঙের ব্যানারে কত আয়োজন। আমরাও বসে থাকতাম না একেবারে। পাড়ার ছেলেরা একসঙ্গে বনভোজনে মেতে উঠতাম। নামটা বনভোজন হলেও আমাদের কাছে ‘বনভাত’ নামে সমাদৃত ছিলো। বাড়ির দক্ষিণ দিকের ছোট্ট মাঠে জমতো আমাদের বনভাত। লাকড়ি সংগ্রহ করা হতো বিভিন্ন বাগান থেকে। আমার দাদি থাকতেন এই আয়োজনের প্রতিনিধি। তার দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হতো আমাদের ‘বনভাত’ নামক বনভোজন।
ভ্রমণপিয়াসুরা দল বেঁধে কিংবা একাকী ছুটে যেতো এবং এখনো যায়। দূরে, বহু দূরে। চট্টগ্রাম বেড়ানোর জন্য স্বর্গভূমি। এছাড়াও আছে সেন্টমার্টিন, দু’টি পাতা একাটি কুঁড়ির দেশ সিলেট, কুমিল্লার ময়নামতি, রাঙ্গামাটি, সুন্দরবন, ফয়েজ লেক, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, কুয়াকাটা, বান্দরবান, রামসাগর, পাহাড়পুর, কাপ্তাই লেক, জাফলং, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, সোনারগাঁও, আরও কত নয়নাভিরাম স্থান! বেড়ানোর জায়গার কি অভাব! আসলে বাংলাদেশটাই এমনি। যেখানেই পা রাখবো, যে দিকেই চোখ দেব ভরে যাবে মন-প্রাণ। এ জন্যই তো সকল দেশের সেরা আমাদের এই জন্মভূমি। শীত মৌসুমে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই সবুজ বাংলা সেজে ওঠে আরও নতুনভাবে। জাগিয়ে তোলে সে গোটা দেশ এবং জাতিকে। দোলা দিয়ে যায় হৃদয়ের ঢেউ টলোমলো পদ্মদীঘি। মানুষ কি শুধু ভয়েই কাঁপে? শীতে কাঁপে? না, বরং খুশি এবং আনন্দেও মানুষ সমান শিহরিত হয়। পুলকিত হয়। অপার আনন্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে মানুষের হৃদয়-মন। শীতও তেমনি একটি ঋতু। যে ঋতু বাংলার মানুষের হৃদয়কে শীত এবং আনন্দে মিলে মিশে কাঁপিয়ে তোলে আমূল।