এভারেস্ট শৃঙ্গ বা মাউন্ট এভারেস্ট নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই মানুষের। এটা বলতে গেলে এক রহস্যের জগৎ। মানুষ এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেছে বটে, কিন্তু অনেক রহস্য এখনো অজানা রয়ে গেছে। সেখানে ইয়েতি আছে কি না বা সেখানে গিয়ে কেন বহু অভিযাত্রী নিখোঁজ হয়েছেন এসব প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই। মাউন্ট এভারেস্ট বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত হিসেবে বিবেচিত। এটি নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তে অবস্থিত। বিগত ৭০ বছর ধরে হাজার হাজার অভিযাত্রী চেষ্টা করছে মাউন্ট এভারেস্টে ওঠার। অনেকে সফলভাবে সুউচ্চ এই পর্বতে আরোহণও করছেন। এভারেস্ট সম্পর্কিত অনেক তথ্য আছে, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। মাউন্ট এভারেস্ট দিবস। নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি ও নেপালের তেনজিং নোরগে শেরপার অসাধারণ কৃতিত্বের সম্মানে ২৯ মে আন্তর্জাতিক এভারেস্ট দিবস পালিত হয়। ১৯৫৩ সালের ২৯শে মে হিলারি এবং তেঞ্জিং দক্ষিণ দিক থেকে সর্বপ্রথম এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণ করেন। এভারেস্টের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে একজন বাঙালির নাম। তিনি রাধানাথ শিকদার। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেরাদুন শহরে অবস্থিত সদর-দপ্তরে বাঙালি গণিতবিদ ও পর্যবেক্ষক রাধানাথ শিকদার নিকলসনের মাপ-জোক থেকে ত্রিকোণোমিতিক গণনা করে সর্বপ্রথম নির্ণয় করেন যে এই শৃঙ্গ বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। রাধানাথ শিকদার বিখ্যাত হিন্দু কলেজে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্লাসমেট ছিলেন।
সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে আবিষ্কার
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতসমূহের অবস্থান এবং পরিচয় শনাক্ত করার লক্ষ্যে ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা মহান ত্রিকোণমিতিক সর্বেক্ষণ আরম্ভ করে। দক্ষিণ ভারত থেকে এই কাজ শুরু করে জরিপ দল ৫০০ কেজি (১,১০০ পা) ওজনের ভারী ভারী থিওডোলাইট যন্ত্র বহন করে উত্তরাভিমুখে এগোতে থাকে। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে তারা হিমালয়ের পাদদেশে পৌঁছায়। কিন্তু রাজনৈতিক এবং ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সন্দেহে নেপাল ব্রিটিশদের তাদের দেশে প্রবেশাধিকার দেবার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিল। জরিপ দলের নেপালে প্রবেশের সকল আবেদনই প্রত্যাখান করা হয়। ব্রিটিশরা বাধ্য হয়ে নেপালের দক্ষিণে হিমালয়ের সমান্তরালে অবস্থিত তরাই থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যায়। বর্ষা ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপে বিপর্যস্ত দলটির তিনজন আধিকারিক মৃত্যুবরণ করেন ও দুইজন অসুস্থ হয়ে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।
যাই হোক, ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা হিমালয়ের উচ্চ শৃঙ্গগুলি থেকে ২৪০ কি. মি. (১৫০ মাইল) দুরত্বে অবস্থিত পর্যবেক্ষণ স্টেশন থেকে হিমালয়ের নিখুঁত জরিপ কাজ চালিয়ে যায়। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বছরের কেবল শেষ তিন মাস জরিপ কাজ চলত। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত সওয়াজপুর স্টেশন থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেন। সে সময় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ২৩০ কি.মি. (১৪০ মাইল) দুরত্বে অবস্থিত আরো উচ্চ একটি শৃঙ্গ লক্ষ্য করেন। প্রায় একই সময়ে জন আর্মস্ট্রং নামে তার এক কর্মচারীও আরো পশ্চিম থেকে এই চূড়াটি লক্ষ্য করেন এবং একে ঢ়বধশ-ন হিসেবে অভিহিত করেন। ওয়াহ পরবর্তীতে মন্তব্য করেন যে যদিও পর্যবেক্ষণ হতে বোঝা যাচ্ছিলো যে ঢ়বধশ-ন কাঞ্চনজঙ্ঘা অপেক্ষা উচ্চতর, তা সত্ত্বেও প্রমাণের জন্যে আরো নিকটতর স্থান হতে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন ছিলো। পরের বছর তিনি এই শৃঙ্গের আরো কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য তরাই অঞ্চলে একজন আধিকারিককে পাঠান। কিন্তু মেঘের কারণে জরিপকাজ চালানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
১৮৪৯ সালে ওয়াহ সেখানে জেমস নিকলসনকে প্রেরণ করেন। নিকলসন ১৯০ কি. মি. (১২০ মাইল) দূরে অবস্থিত জিরোল থেকে দুটি পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর নিকলসন সবচেয়ে বড় থিওডোলাইট নিয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করে পাঁচটি বিভিন্ন স্থান হতে ত্রিশেরও অধিক পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেন, যার মধ্যে নিকটতমটি ছিল এভারেস্টের ১৭৪ কি. মি. (১০৮ মাইল) দূর হতে নেয়া। এরপর তিনি পাটনায় ফিরে যান এবং পর্যবেক্ষণ হতে প্রাপ্ত উপাত্ত সমূহ নিয়ে হিসাব-নিকাশ আরম্ভ করেন। তার খসড়া উপাত্ত হতে তিনি ঢ়বধশ-ন এর উচ্চতা নির্ণয় করেন ৯,২০০ মিটার (৩০,২০০ ফুট), কিন্তু এটি ছিল আলোর প্রতিসরণ জনিত ত্রুটি অগ্রাহ্য করে নির্ণীত উচ্চতা। তবুও এই খসড়া হিসাব থেকে বোঝা গেল যে, ঢ়বধশ-ন এর উচ্চতা কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে বেশি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিকলসন ওই সময়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং তার হিসাব-নিকাশ অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মাইকেল হেনেসি নামক অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহর একজন সহকর্মী সে সময়ে পর্বতগুলিকে রোমান সংখ্যায় প্রকাশ করা আরম্ভ করেন এবং সেই রীতি অনুযায়ী ঢ়বধশ-ন এর নতুন নাম হয় ঢ়বধশ-ঢঠ (১৫ নং শৃঙ্গ)।
১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেরাদুন শহরে অবস্থিত সদর-দপ্তরে বাঙালি গণিতবিদ ও পর্যবেক্ষক রাধানাথ শিকদার নিকলসনের মাপ-জোক থেকে ত্রিকোণোমিতিক গণনা করে সর্বপ্রথম নির্ণয় করেন যে, এই শৃঙ্গ বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পরবর্তী কয়েক বছর গণনাগুলিকে বার বার নিশ্চিত করবার প্রচেষ্টার কারণে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করতে দেরি হয়। নিকলসনের উপাত্ত নিয়ে ওয়াহ ও তার কর্মীরা পরবর্তী দুই বছর গণনা কার্য চালিয়ে যান এবং পর্যবেক্ষণস্থল থেকে শৃঙ্গের দুরত্বের কারণে আলোর প্রতিসরণ, বায়ুমন্ডলের চাপ ও তাপমাত্রা তারতম্যের সমস্যাগুলির সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি কলকাতার সহকারীকে পত্র মারফত তার সিদ্ধান্ত জানান। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে, এই শৃঙ্গের উচ্চতা ৮,৮৩৯.২ মিটার (২৯,০০০ ফুট) হওয়ায় এই শৃঙ্গ সম্ভবত বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। জনসমক্ষে এই শৃঙ্গের উচ্চতা জানানো হয় ৮,৮৩৯.৮ মিটার (২৯,০০২ ফুট)।
ম্যালোরি আরভিন রহস্য:
১৯২৪ সালে ম্যালোরি-আরভিনের হারিয়ে যাবার অনেক অনেক বছর কেটে গেছে। রহস্যের সমাধান হয়নি। ১৯৩৩ সালে প্রায় ২৬০০০ ফুট উপরে আরভিনের আইস এক্স পাওয়া গেলে বিতর্ক আরো উসকে ওঠে। ১৯৭৫ সালে ওয়াং নামের একজন চায়নিজ মাউন্টেনিয়ারের নেতৃত্বে একটি জাপানি টিম এভারেস্ট অভিযান চালায়। অভিযানে ওয়াং জানায় তাদের ক্যাম্পের কাছে তারা এক শেতাঙ্গ মাউন্টেনিয়ারের মৃতদেহ দেখতে পায় যার পোষাক আশাক ১৯২৪ সালের স্টাইলে। কিন্তু ওয়াং বেশী প্রমাণ দিতে পারেননি, কারন পরদিন তুষার ধ্বসে ওয়াং এর পরিনতিও আরভিন-ম্যালোরির মত হয়।
১৯৯৯ সালে বিতর্কের অবসান করতে ম্যালোরি-আরভিন রিসার্চ টিম অভিযানে নামে। ওয়াং এর কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জায়গার কাছে তারা ম্যালোরির মৃত দেহ আবিষ্কার করেন। ম্যালোরি মারা যাবার ৭৫ বছর পরে ম্যালোরি আবার সভ্য জগতে প্রত্যাবর্তন করে। ম্যালোরির কোমড়ে ইনজুরি থেকে ধারনা করা হয় তিনি সম্ভবত আরভিনের সাথে নিজেকে দড়ি দিয়ে বেধে উপরে ওঠার বা ওঠানোর কিংবা নামা বা নামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হন এবং সেকেন্ড স্টেপ বা ফার্স্ট স্টেপ থেকে পরে নিহত হন। কিন্তু আরভিন কই? মৃত্যুর ৭৫ বছর পরে ম্যালোরি ফিরলেও এভারেস্ট থেকে আরভিন এখনো ফেরেননি। সাম্প্রতিক সময়ে শোনা যাচ্ছে, আরভিন সার্চ কমিটি স্যাটালাইট ইমেজ থেকে আরভিনের দেহ খুজে পেয়েছে। আরভিনকে ফিরিয়ে আনতে ২০১০ সালে একটা অভিযান চালানো হয় কিন্তু সেটার কোন সাফল্য আসেনি।
প্রথম এভারেস্ট জয়ী কে? ১০০ বছর পর আরভিনের বুট উদ্ধারে রহস্য মিটবে?
বিশ্ব শীর্ষে (গড়ঁহঃ ঊাবৎংঃ) কে প্রথম ম্যালোরি-আরভিন নাকি তেনজিং-হিলারি? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো তুষারের তলায় চাপা পড়ে আছে। পর্বতাভিজানের ইতিহাসে মাউন্ট এভারেস্ট জয় যুগান্তকারী ঘটনা। বিতর্কের বিষয় কে প্রথম উঠেছিলেন এভারেস্টে? বারবার এমন দাবি উঠেছে, ১৯৫৩ সালে তেনজিং নোরগে এবং এডমুন্ড হিলারি প্রথম অভিযাত্রী নন ১৯২৪ সালে জর্জ ম্যালোরি ও অ্যান্ড্রু আরভিন প্রথম এভারেস্ট জয়ী। যদিও এই দুই কিংবদন্তি পর্বতারোহীর মৃত্যু হয় এভারেস্টেই। এবার মৃত্যুর ১০০ বছর মিলেছে নিখোঁজ আরভিনের বুট!
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের বিখ্যাত অভিযাত্রী জিমি চিনের নেতৃত্বে তল্লাশি চলছিল। তিনি এই মুহূর্তকে তিনি স্মরণীয় ও আবেগঘন বলে আখ্যা দিয়েছেন। ম্যালোরির দেহ পাওয়ার পর তাঁর সহঅভিযাত্রী আরভিনের দেহ মিলবে বলেই মনে করা হয়। এবার মিলেছে আরভিনের বুট। তাঁদের ক্যামেরা ও অভিযানের অন্যান্য সামগ্রী মিলবে বলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অভিযাত্রীরা নিশ্চিত। জিমি চিনের নেতৃত্বে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তথ্যচিত্র নির্মাতা পর্বতারোহীদের একটি দল গত মাসে এভারেস্টে একটি বুটে হোঁচট খায়! হিমবাহের ওপরের বরফ গলে সেটি বেরিয়ে এসেছিল। ওই বুটটিতে উলের মোজার ওপর সেলাই করা ‘এ. সি. আরভিন’ লেখা। সেটি নিখোঁজ ব্রিটিশ পর্বতারোহী অ্যান্ড্রু কমিন স্যান্ডি আরভিনের বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তাঁর পরিবার আরভিনকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেহাবশেষের পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের প্রস্তাব দিয়েছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন-জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিমালয়ে জমে থাকা বরফ পাতলা হয়ে তুষারের নিচে চাপা পড়ে থাকা পর্বতারোহীদের মৃতদেহ আবিষ্কারের ঘটনা ঘটছে। ১৯২৪ সালে সঙ্গী জর্জ ম্যালোরিকে নিয়ে এভারেস্টে অভিযান করেছিলেন আরভিন। ১৯৯৯ সালে ম্যালোরির দেহাবশেষ পাওয়া যায় এভারেস্ট শীর্ষের নিকটে। তবে নিখোঁজ ছিলেন আরভিন। ২০২৪ সালে মিলল আরভিনের বুট। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অভিযাত্রীরা আরভিনের দেহ পেতে মরিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুষারে চাপা পড়ে থাকা দেহ অবিকল থাকে। যেমনটি হয়েছিল ম্যালোরির ক্ষেত্রে। মৃত্যুর পঁচাত্তর বছর পর তাঁর দেহ মিলেছিল। সেই দেহ ছিল তরুণ বয়সের। হিমালয় তুষারে ঢেকে ম্যালোরি মৃত্যুর পরেও অনন্ত যৌবনে আটকে ছিলেন! এভারেস্ট অভিযানের ইতিহাসে আছে, ম্যালোরির সঙ্গে আরভিন যখন এভারেস্টে ওঠার জন্য গিয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। সেই অভিযানে তাঁরা কি এভারেস্ট শীর্ষে উঠেছিলেন? এই প্রশ্ন বারবার আটকে গেছে তুষারের তলায়।
মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বাড়ছে
ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এভারেস্ট থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে অরুণ নদী অববাহিকার ভূমি-ক্ষয়ের ফলেই প্রতিবছর মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা দুই মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। “এটা অনেকটা পণ্যবাহী জাহাজ থেকে মালপত্র ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার,” জানাচ্ছিলেন ওই গবেষণাপত্রের সহ-লেখক অ্যাডাম স্মিথ। তার ব্যাখ্যা, “জাহাজ থেকে পণ্য ফেলে দেওয়া হলে জাহাজটি কিছুটা ওপরে ভেসে থাকতে পারে, তাই ভূ-ত্বকের ক্ষরণ হলে পর্বতশৃঙ্গটিও কিছুটা ওপরে উঠে যাবে।“
যেভাবে সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা বাড়ছে
প্রায় চার থেকে পাঁচ কোটি বছর আগে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে ধাক্কার অভিঘাতে হিমালয়ের জন্ম হয়েছিল। দুটি প্লেটের ঘাত-অভিঘাতের কারণে এখনও হিমালয়ের উচ্চতা বেড়ে চলেছে। তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন বা ইউসিএলের বিজ্ঞানীরা বলছেন যে দুটি প্লেটের ঘাত-অভিঘাত ছাড়াও মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বৃদ্ধির বাড়তি আরও একটা কারণ অরুণ নদীতে ঘটে যাওয়া ভূ-বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনগুলি। হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়ার পথে অরুণ নদী নদীবক্ষ, অর্থাৎ ভূত্বক থেকে পাথর ও মাটি কেটে নিয়ে যায়। এর ফলে ভূত্বকের ঠিক নিচে ম্যান্টেল নামের যে স্তরটি রয়েছে তা ওপরের দিকে ফুলে ওঠে। এই প্রক্রিয়াটিকে ভূবিজ্ঞানের তত্ত্বে আইসোস্ট্যাটিক রিবাউন্ড বলা হয়ে থাকে।
নেচার জিওসায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে, এই ভূবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ফলে এভারেস্ট ও সেটির কাছাকাছি অঞ্চলের অন্যান্য পর্বতশৃঙ্গগুলিকে ওপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এভারেস্ট ছাড়াও বিশ্বের চতুর্থ ও পঞ্চম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যথাক্রমে- লোৎসে এবং মাকালুর উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণাপত্রটির আরেকজন সহ-লেখক ড. ম্যাথু ফক্স ব্যাখ্যা করছিলেন, “ভূমিক্ষয়ের ফলে যে হারে মাউন্ট এভারেস্ট ও কাছাকাছি অন্যান্য শৃঙ্গগুলির উচ্চতা কমছে, তার থেকে বেশি হারে আইসোস্ট্যাটিক রিবাউন্ড শৃঙ্গগুলিকে ঠেলে ওপরের দিকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। “— আমরা জিপিএস যন্ত্র ব্যবহার করে দেখেছি যে ওই পর্বতশৃঙ্গগুলির উচ্চতা বছরে প্রায় দুই মিলিমিটার করে বাড়ছে। এই উচ্চতাবৃদ্ধির কারণ আমাদের কাছে এখন আগের থেকে অনেক পরিষ্কার”, বলছিলেন ম্যাথু ফক্স।
ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন, এমন কয়েকজন ভূবিজ্ঞানী বলছেন যে, এই তত্ত্বটি বিশ্বাসযোগ্য ঠিকই, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। অরুণ নদী তিব্বত থেকে নেমে আসে নেপালে। আরও দুটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ওই নদীটির নাম হয় কোশী। কোশী নদী নেপাল থেকে উত্তর ভারতে প্রবেশ করেছে, যা পরে আবার গঙ্গায় মিশেছে। খাড়া পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে অরুণ নদী প্রচণ্ড স্রোতে নেমে আসে, তার ফলে নদীটির পলিমাটি কেটে নিয়ে আসার ক্ষমতাও খুব বেশি। নদীটির যাত্রাপথে তাই প্রচুর পরিমাণে পাথর আর মাটি বয়ে আনে।
চায়না ইউনিভার্সিটি অফ জিওসায়েন্সের গবেষক ড. শু হান ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির মূল লেখক। ইউসিএলে একটি স্কলারশিপে এসে গবেষণাপত্রটির কাজ করেছিলেন তিনি। তার কথায়, “মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বৃদ্ধি আরও বেশি করে আমাদের দেখিয়ে দেয় যে ভূত্বক আসলে কতটা গতিশীল একটা ভূবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া।”
ইউসিএলের গবেষণাপত্রটি জানাচ্ছে যে তিব্বত থেকে বয়ে আসা আরও একটি নদীখাতের সঙ্গে যে সময়ে মিশেছে অরুণ নদী, তখন থেকেই বিপুল পরিমাণে মাটি আর পাথর কেটে নিত নদীবক্ষ থেকে। তার পরিমাণ এবং গতি সম্ভবত আরও বেড়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরার স্কুল অফ জিওসায়েন্সেসের অধ্যাপক হিউ সিনক্লেয়ার ইউসিএলের ওই গবেষণার বিষয়ে বলছেন, যে ইউসিএলের গবেষকরা মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বৃদ্ধির যে অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করেছেন, তা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত।
তবে তিনি এটাও বলছেন যে নদীবক্ষের মাটি আর পাথর কেটে নেওয়ার সঠিক পরিমাণ ও সময়কাল এবং তার ফলশ্রুতিতে আশপাশের শৃঙ্গগুলির উচ্চতা বৃদ্ধির মধ্যে অনেক অনিশ্চয়তা এখনও আছে। তার কথায়, “প্রথমত, একটি নদীপথ আরেকটি নদীখাতে মিশে যাওয়ার ফলে বিরাট অববাহিকা জুড়ে একটি নদীবক্ষের মাটি ও পাথর কেটে আনার পরিমাণ হিসাব করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।” এই অনিশ্চয়তার কথা মানছেন গবেষণাপত্রটির লেখকরাও।
গ্রেট ট্রিকনোমেট্রিক সারভে সংক্রান্ত কার্যক্রমের ব্যাপারে ব্রিটিশ সংসদের বক্তব্য ছিল- “শুধুমাত্র উপ-সহকারী নয়, কর্তব্যনিষ্ঠ, উদ্যোগী এবং অনলস পরিশ্রমী মানুষেরা, যারা জরিপ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, নাগরিক প্রতিষ্ঠানের এমন গঠন করেছেন, যা আর কোথাও দেখা যায় না। তাদের সাফল্যের অংশীদার ভারতের শিক্ষাব্যাবস্থা। এঁদের মধ্যে দক্ষতার জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাবু রাধানাথ শিকদারের নাম, যিনি একজন ভারতীয়, যার গাণিতিক নিষ্কাশন, সর্বোচ্চ সাফল্য লাভ করেছে।” ২০০৪ সালের ২৭ জুন তারিখে ভারতের ডাক বিভাগ চেন্নাইয়ে ভারতের ত্রিকোণমিতিক জরিপের প্রতিষ্ঠার স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে, যাতে রাধানাথ শিকদার ও নইন সিং এর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে।