সারা দিন আশপাশের দু’একটা গ্রাম ঘুরে, সকল মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের হাত-পা ধরে অনেক কান্নাকাটি করে অবশেষে শূন্য হাতে, একরাশ হতাশা বুকে নিয়ে উ™£ান্তের মতো সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল রহিম শেখ। সারা দিনে অভুক্ত পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি; যদিও সেদিকে তার কোনো ভ্রƒক্ষেপ ছিল না। তার দুশ্চিন্তা একটাই, গরুটা না পাওয়া গেলে, সে কিভাবে চাষাবাদ করবে? কারণ একজন কৃষকের বেঁচে থাকার অবলম্বন হচ্ছে, তার গরু, লাঙ্গল ও জমি।
তবুও স্বামী যে বাড়ি এতেই বুকের উপর চেপে থাকা পাথরটা নেমে গেল কুলসুম বেগমের। গরু পাওয়া যায়নি তো কী হয়েছে, স্বামী তো ফিরেছে। চৌদ্দ বছরের বশির ও আট বছরের মেয়ে বকুল দুই ভাই বোন মিলে সারা দিন মায়ের মতো অস্থির সময় কাটিয়েছে আব্বার অপেক্ষায়। বাড়িতে এসে রহিম শেখকে ভেঙে পড়তে দেখে তার কাছে গিয়ে বশির বললো, আব্বা, একটা গরু চুরি হয়েছে তো কী হয়েছে? আরও একটা তো আমাদের আছে। তাছাড়া আমিও এখন থেকে তোমার সাথে ক্ষেতে বেশি করে কাজ করব। তুমি দেখে নিও সামনের বৈশাখ মাসের আগেই আমরা আর একটা গরু কিনে আনব। তুমি কোনো চিন্তা করো না আব্বা।
কোনো কথা না বলে বাঁশের আড়া থেকে গামছা নিয়ে পুকুরের দিকে যেতে লাগল রহিম শেখ। ছেলে-মেয়ে দুটো আব্বার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো। কুলসুম বেগম রাতের খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্বামীর মলিন চেহারা দেখেই সে বুঝে নিয়েছে সারা দিন তার পেটে কিছু পড়েনি। সবাই রাতের খাবার খেতে বসেছে। বকুল তার আব্বার গা ঘেঁষে বসে খাচ্ছে। মেয়েটা তার খুব আদরের। খুব একটা বেশি খেতে পারল না রহিম শেখ। মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে সে কখনই ভালো করে খেতে পারে না। তাছাড়া একজন কৃষকের হালের বলদ চুরি হবার কষ্ট যে কী, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।
জেলা শহর থেকে ৩৫ মাইল দূরে, সুন্দরবন সংলগ্ন রতনপুর গ্রামে রহিম শেখের পৈতৃক নিবাস। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তার ছোট সোনার সংসার। পৈতৃক দুই বিঘা জমি ও দুইটি হালের বলদ ছিল তার আয়-উপার্জন ও বেঁচে থাকার অবলম্বন। বছরের অধিকাংশ সময় এই ছোট জমিটুকুতে তার সময় কেটে যায় বিভিন্ন রকমের চাষাবাদে। ধান কাটা হয়ে গেলে শীত মৌসুমে বিভিন্ন প্রকার তরিতরকারি আবাদ করে সে। যেমন, এখন আলু তোলার সময় হয়ে গেছে; অথচ গতকাল রাতে গরু চুরি হবার কারণে আজ তার ক্ষেতে যাওয়া হয়নি।
লেখাপড়া করার সুযোগ রহিমের হয়নি, তাই তার স্বপ্ন ছেলেকে শিক্ষিত করবে। আর লেখাপড়ার প্রতি বশিরেরও আগ্রহ প্রবল। রোজ পাঁচ মাইল পথ হেঁটে দুটো গ্রাম পার হয়ে সে ধুলিয়াপুর স্কুলে যায়। ছাত্র হিসেবে সে মেধাবী, স্কুলের শিক্ষকরা তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। রোজ আসা-যাওয়ায় দশ মাইল হাঁটতে বশিরের কোনো ক্লান্তি নেই, বরং ভোর হলেই সে বাড়ির ছোটখাটো কাজ সেরে স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। স্কুল হচ্ছে বশিরের জীবন, আর স্কুলের পাশ দিয়ে কুল কুল শব্দে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদী বশিরের খুব প্রিয়। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, আগামী বছর বশির অষ্টম শ্রেণীতে উঠবে; তার চোখে অনেক স্বপ্ন।
রাতে খাওয়ার পরে এই পৌষের শীতেও রহিম উঠানে মাদুর পেতে বসে আছে। উদাস দৃষ্টিতে গোয়ালে নিঃসঙ্গ গরুটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে সে। গরুটাও যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে। আসলে অবলা প্রাণীর মধ্যেও আমাদের মতো আবেগ অনুভূতি আছে; শুধু দেখার চোখ থাকলে ঠিকই দেখা যায়। আব্বার কষ্টটা ভাগ করে নেয়ার জন্য বশিরও বসে আছে মাদুরে। পাশের বাড়ির চাচাতো ভাই হানিফ শেখ এসেছে রহিমের খবর নিতে।
– কী রে রহিম, গরু পাওয়া গেল?
– না মিয়া ভাই, অনেক জায়গায় খোঁজলাম। মেম্বাররে টাকা দিতি চালাম, তাও কোন কিছু হলো না।
– তুই কি পাগল নাকি রহিম? টাকা দিয়ে যদি গরু পাওয়া যেত, তা হলি তো চোর ধরা পড়ে যেত। দুই গুণ দাম দিলিও তো তোর গরু কেউ ফেরত দেবে না। রাতের মধ্যি ইছামতি নদী পর্যন্ত গরু নিয়ে যাতি পারলিই তো শেষ। তোর গরু হাওয়া।
– তাই তো দেখতিছি মিয়া ভাই।
আরও অনেক কথা বলে, রহিমকে সান্ত¡না দিয়ে হানিফ বাড়ি চলে গেল। তবুও রহিমের ওঠার কোনো নাম নেই। সে বসেই আছে।
– আব্বা, তুমি এত চিন্তা করতিছো কেন?
– কই, নাতো আমি চিন্তা করতিছি না।
– আব্বা, চিন্তা করো না। আমরা তো এখনো বেঁচে আছি। আর আমাদের তো একটা গরু এখনো আছে। এখন থেকে ক্ষেতে আমরা আরও কাজ করব। আমাদের গরু কেনার টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। আব্বা, আজকে কিন্তু আলু তোলা হয়নি। কালকে ক্ষেতে যাতি হবে, সব আলু তুলে সামনের হাটে বেচতি পারলি আমাদের লাভ হবে।
– ঠিক আছে বাজান।
– আব্বা, আমাদের হেডমাস্টার মশাই কি বলে জানো?
– কী বলে?
– জীবন একটা যুদ্ধের মতো, এখানে হাল ছাড়া যাবে না। একমাত্র ধৈর্যশীলরাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।
– ঠিক কথা বলিছিসরে বশির।
– আব্বা চলো, অনেক রাত হইছে শুতি চলো। কাল সকাল-সকাল ক্ষেতে যাব।
– ঠিক আছে, চল যাই।
Share.