চিরায়ত নিয়মে সময়ের পরিবর্তন ঘটে। এই নিয়মেই বছর ঘুরে বছর আসে। আনন্দ বেদনার নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বছর। অনেক জল্পনা কল্পনা আর স্বপ্নের অবসান হয়। পাওয়ার আনন্দ আর না পাওয়ার বেদনায় কেটে যায় বছর। সময় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। সময় যেমনভাবে বয়ে চলে আপন গতিতে, জীবনের পাঠও তেমনি। বয়ে চলাই এর কাজ। না পাওয়া সবকিছুকে ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন।
নতুন বছর নতুন বার্তা নিয়ে আসে। নতুন আশার আলো জাগিয়ে দেয়। মনে এক অন্যরকম আনন্দের ঢেউ খেলা করে। সবাই আমরা বড় হতে চাই। চাই পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় ভরতে। চাই নতুন করে আকাশ ছুঁয়ে নতুন কিছু করতে। মানুষ নানারকম স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নকে ঘিরে তৈরি হয় তার আশার ভুবন। কারণ বড় হতে চাই বড় স্বপ্ন। স্বপ্নের এই চাওয়া আমাদের প্রাণিত করে। সফল মানুষ হতে প্রেরণা যোগায়। একজন সফল মানুষ হতে প্রয়োজন পরিকল্পিত জীবন। সঠিক পরিকল্পনাই পারে একজন মানুষকে উন্নত মানুষ বানাতে। মনে রাখতে হবে একটি গোছানো জীবনের স্বপ্ন তোমার আমার আমাদের সকলের। এই পথ নির্দিষ্ট কারোর নয়। তাই পথ তৈরির কাজটিও আমাদেরই করতে হবে।
কাঙ্খিত পথের সন্ধান অতীতেও কখনোই সহজ ছিল না। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, যারাই জীবনে সফলতা অর্জন করেছেন তাদের গল্প অন্যরকম। তারা স্বপ্ন দেখেছেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তব করতে পরিকল্পিত জীবনের ছক এঁকেছেন। নিজেকে সেই কাজে নিয়োজিত করেছেন। সাফল্যময় জীবনের প্রয়োজনে তারা সব করেছেন। কোথাও কোনো ফাঁক রাখেননি। কাঁটাযুক্ত পথকে সহজ করে গ্রহণ করেছেন। এই যে কঠিন পথকে সহজ করে গ্রহণ করা এটি বলতে সহজ মনে হলেও কার্যক্ষেত্রে খুব সহজ নয়। তবুও তারা থেমে থাকেননি। হোক তা জটিল কিংবা কুটিল। গোছানো পরিকল্পনার কাছে সবই সহজবোধ্য। এভাবেই সব বাধা সব বিপত্তিকে ঠেলে পথ নিয়ে যায় সাফল্যের দরোজায়। দৃঢ় প্রত্যয় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। জীবনকে কখনো কখনো বৃক্ষের মতো স্থির হতে হয়। শক্ত হয়ে নিজেকে ধরে রাখতে হয়। তাহলেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।
আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা স্বপ্নের মধ্যে বাস করে। স্বপ্ন আশা জাগিয়ে রাখার একটি অদ্ভুত অনুভূতি। জীবনের বাস্তবতায় স্বপ্ন পূরণে কখনও নিরাশ হওয়া যাবে না। হতাশাকে দূরে ঠেলতে হবে। তার জন্য চাই একটি নিদর্শন। একটি স্বপ্ন। সকল কষ্ট একসময় দূর হবে এমন আশা এবং সম্ভাবনা মনে জাগিয়ে রাখাই স্বপ্ন। আজকের দিনটির গুরুত্বহীনতা একদিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আগামীকাল হবে সুন্দরতায় মোড়ানো। শুধু জানতে হবে সেই সিঁড়ি তৈরির ক্ষেত্রে কি কি উপকরণ চাই। এরও আগে বুঝতে হবে আমি পূর্বে কেমন ছিলাম? আমি এখন কেমন আছি? আমি কেমন হতে চাই? আমার কী করা উচিৎ? এসব বিষয়ের সচেতনতা আমাদের আগামীর লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে। ফারসি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তার যর্থাথই বলেছেন-
‘প্রাণকে বলি হে প্রাণ! আমিতো তোমার কাছেই সমর্পিত
শুধু অতলান্ত সমুদ্রে বিন্দুর খোঁজে আমি আজও।
ছিলো না কোনো উপায় আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে
তুমি জানো তুমিই আমার সব পাওয়ার উপায় উপকরণ।’
আজকের শিশু-কিশোর-তরুণ আগামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসরমান তাদের জীবন। আধুনিকতার উপকরণে ডুবে থেকেও জুলাই ২০২৪ এ সংঘটিত গণবিপ্লব সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস। এটি কোনো সাধারণ ইতিহাস নয়। অধিকারের আদায়ের লড়াইয়ে সৃষ্টি এই ইতিহাসের। ভাবনার বিষয় মানুষ কখন মানুষের শত্রুতে রূপ নেয়! মানুষ কেন মানুষকে ঘৃণা করে! কী করে মানুষ কেড়ে নেয় মানুষের অধিকার! সেই অধিকার চাইতে গিয়ে বন্দুকের গুলির মুখে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হয়! আধুনিক জীবনের মিছিলে কেন এই নৈরাজ্যতা! নিপীড়িত মানুষের ভীড় কেন সর্বত্র! এসবই প্রতিবাদী দৃঢ় কণ্ঠে দীপ্ত পদক্ষেপে তোমরা দেখিয়েছ। সারা বিশ^ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ^াস করতে শুরু করেছে তোমরাই পারবে আগামীর বাংলাদেশকে একটি লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। তোমরাই পারবে সোনার বাংলাদেশ গড়তে। অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২০২৪। অন্যান্য সব বছর থেকে বছরটি ভিন্ন। এটি কালের গর্ভে কখনো হারিয়ে যাবে না। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গ্রাফিতি ও ফিচারের মাধ্যমে বিষয়গুলো লিখিত হবে। আর শক্তি ও সাহসের প্রতীক হয়ে বছরটি ফিরে আসবে বারবার।

নতুন বছর ২০২৫। নতুন স্বপ্ন বোনার বছর। নতুন আশা ও আকাক্সক্ষায় জীবনকে একটি লক্ষ্যে নিয়ে যাবার বছর। এর জন্য চাই নতুন পরিকল্পনা। পরিকল্পনা করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদা, অবস্থান, সামর্থ্য এবং রুচিবোধকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। এজন্য পরিকল্পনার ক্ষেত্র সহজ হওয়া জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে যেন পরিকল্পনাটি লক্ষ্য অনুযায়ী, সঠিক কাজ, সময় এবং প্রচেষ্টার ভিত্তিতে হয়। জীবন পরিচালনায় সঠিক সিদ্ধান্তের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব বহন করে। সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিকল্পনাই পারে জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে। উপভোগ্য করে তুলতে। মনের আঙিনায় ঢেউ জাগাতে। পরিকল্পিত জীবনের জন্য প্রয়োজন কিছু পদক্ষেপ। প্রথমত প্ল্যান করে কাজ করা। কয়েকজন মিলে একটি টিম তৈরি করা। তোমরা কী কী কাজ করতে চাও এর তালিকা প্রস্তুত করা। এরপর কাজের পরিধি অনুযায়ী কাজটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়া। আর কাজটির অগ্রগতির জন্য সবসময় সজাগ দৃষ্টিও রাখতে হয়। ফলে অল্প সময়ে কাজটির ফলাফল লাভ সহজ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত প্রস্তুতিসহ কাজে মনোনিবেশ করা। যে কোনো কাজ তখনই সফল হয় যখন কাজটির প্রস্তুতি পরিপূর্ণ থাকে। যেমনটি পরীক্ষার পূর্বে সকল প্রশ্ন ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে। যে যে বিষয়গুলো কঠিন মনে হয় সেসব বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিকট পরমর্শ করতে হবে। এবং কঠিন বিষয়টি সহজ হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই পরীক্ষায় ভালো করা সম্ভব হবে। ঠিক তেমনি যে কোন কাজের আগে কাজের ধরন বুঝে এর পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। এবং বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞদের পরামর্শের মাধ্যমে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। কারণ কিশোর বয়স থেকেই ক্যারিয়ার পরিকল্পনায় জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্নতায় মোড়ানো। কেউ হতে চায় ডাক্তার। কেউবা ইঞ্জিনিয়ার। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার সঠিক সময় এ বয়সটিই। এটি বেশিরভাগই নির্ভর করে আমাদের প্রচেষ্টা, ইচ্ছে, আগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার ওপর। তখনই সকল আধাঁর ঠেলে ওঠে আসবে নতুন সূর্যের দিন।
তৃতীয়ত অধ্যবসায়। জ্ঞান ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। বর্তমান বিশে^ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে তথ্যপ্রযুক্তিতে পরিপক্কতা একান্ত অপরিহার্য। প্রাথমিক থেকে বিশ^বিদ্যালয়ের সফর তৈরিতে অধ্যবসায়ের কোনো বিপল্প নেই। শৈশব থেকেই মানুষের বুকের ভেতর স্বপ্নরা নানাভাবে ছড়িয়ে থাকে। জীবন-জীবিকার তাগিদে খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টময় চলার চিত্র নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠেছে। ঘর হতে বের হলেই এমন দৃশ্যের দেখা মিলে। খেটে খাওয়া দিনমজুরের সন্তানেরাও আজ প্রতিষ্ঠার জন্য দিনরাত মেহনত করছে। অনেককেই দেখা যাচ্ছে ডাক্তার হতে। আবার কেউবা বিসিএস ক্যাডার। কিছু হতে না পারলেও তারা অশিক্ষিত হওয়া থেকে দূরে থাকতে সচেষ্ট। তারা প্রমাণ দিচ্ছে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অসাধ্য সাধন করা যায়। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার সময়। এখনই আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে যদি নিজ কর্মের প্রতি সচেতন হই তাহলে সফলতা আসবেই ইনশাআল্লাহ।
চতুর্থত জ্ঞান আহরণ। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ আল কোরআনের প্রথম বাণী ‘ইকরা’ বা পড়। জ্ঞানের চেয়ে উত্তম কিছু নেই। বলা হয়ে থাকে দোলনা থেকে কবর পর্যন্তই জ্ঞান আহরণ করো। আমাদের মধ্যে যারাই আজ উন্নতির শিখরে আরোহিত তারা প্রত্যেকেই জ্ঞানের সাগরে বিচরণ করেছেন। কবি-সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উদ্যোক্তা কেউই জ্ঞানের বাইরে অবস্থান করছেন না। প্রযুক্তি-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে এটিই মানুষের প্রত্যাশা। মানুষ চায় মানবিক সমাজ নির্মাণ করতে। চায় মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখতে। স্বপ্ন দেখে স্বাধীন দেশে কেউ বেকার থাকবে না। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচবে। শিক্ষা দীক্ষায় প্রথম শ্রেণির হবে। এ চাওয়া খুবই সাধারণ একটি চাওয়া। এটি অর্জন করতে জ্ঞানের বিকল্প কিছু নেই।
বর্তমান সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। আমরা এমন একটি সময়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে পিছিয়ে যাবার সকল পথ বন্ধ। যা আমরা ফেলে এসেছি তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সামনের দিনগুলোকে কেমন করে সার্থক করে তোলা যায় সেটিই ভাবনার বিষয়। বৈশি^ক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতের সফলতা অর্জনেই লুক্কায়িত সত্যিকারের বীরত্ব। সৃষ্টিকর্তার সাজানো পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখতে পাই কেমন করে পাহাড়-পর্বত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রকাশ করছে। প্রকৃতির নিসর্গ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করতে হবে। পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দিকটি বেছে নেয়া জানতে হবে। সেটিই হতে পারে সঠিক সিদ্ধান্ত। উদ্দেশ্যহীনভাবে চলে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। জীবনের লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট। তাহলেই কাঁটার আঘাত সয়ে পথচলা হবে অনেক সহজ। জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর।
সময় একবারই ছুঁয়ে যায় মানুষকে। সময়ের গুরুত্ব দিতে জানতে হবে। যা চলে যায় তা চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। নতুন বছর নতুন পরিকল্পনায় নতুন করে সাজাতে হবে জীবন। সাফল্যময় জীবন পেতে হতে হবে দৃঢ় প্রত্যয়ী। সত্যকে আকড়ে ধরতে হবে। সত্য ও সুন্দরে এগিয়ে নিতে হবে আগামীর পথ। আজকের দিনটিও চিরদিন থাকবে না। এটিও তার সবটুকু নিয়ে হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। তবুও বেঁচে থাকার আনন্দ নিতে হবে। যতক্ষণ শ^াস ততক্ষণ আশ। পরিকল্পিত একটি জীবনের প্রত্যাশা হোক সবার। আগামীর ভোর সবার জীবন কুসুমাস্তীর্ণ করে তুলুক।

Share.

মন্তব্য করুন