ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস, ভাষা আন্দোলনের মাস। এ মাসে আমরা আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে নানারকম আয়োজন করে থাকি। সবচেয়ে বড় আয়োজন হলো বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলা। এই মেলার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রকাশনা অর্থাৎ বই প্রকাশকে অতি গতিশীল করি। একইসাথে ভাষা উন্নয়নের জন্য কাজ করি। বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করি। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় সারা মাসজুড়ে প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকি। এতে সবার মনে মাতৃভাষার জন্য একটি মমতা তৈরি হয়। একটু ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
আমাদের এই বাংলাদেশে নানারকম মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। আমরাও অনেকেই মেলা দেখতে যাই খুব তোড়জোড় করে। মেলায় ঘুরে ঘুরে দেখি কত কি আয়োজন। কত কি দেখা যায় মেলায়। মাটির বানানো হাতের কাজে কত কিছু পেয়ে যাই। পছন্দ হলে কিনে নিতে কেউ দেরি করি না। শিশু-কিশোরদের জন্যেও থাকে অনেক কিছু। খেলাধুলার বিষয় তো থাকেই। সাথে থাকে রাইডার জাতীয় বিভিন্ন বিষয়। খেলনার কতরকম জিনিস থাকে। আরও থাকে খাওয়া দাওয়ার হরেকরকম ব্যবস্থা। এসব ভেবে শিশু-কিশোরেরা মেলায় যাওয়ার জন্য পাগলপারা থাকে। অনেক সময় অভিভাবকরা বাধ্য হয় ছেলেমেয়ে নিয়ে মেলায় যেতে।
কিন্তু বইমেলা সেরকম কোনো মেলা নয়।
এসব মেলার একদম বাইরে হলো বইমেলা। অন্য মেলাগুলোতে শতরকম জিনিসের সমাহার থাকে। কিন্তু বইমেলায় থাকে শুধু বই আর বই। ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে শুধুমাত্র বইয়ের স্টল আর বইয়ের উপস্থিতি। ছোট বড় মাঝারি স্টল আর প্যাভিলিয়ন থাকে বইমেলায় বই প্রদর্শনের জন্য। দেশের বিভিন্ন জেলা, দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে নানারকম পাঠক পাঠিকা। ঢাকা থেকে তো আসেই এবং আসবেই। ঢাকার বাইরে থেকেও আসে বিপুল পাঠক। ঢাকার বাইরে বলতে ঢাকার আসপাশের দু চারটি জেলার লোকেরা শুধু নয়। বরং চৌষট্টিটি জেলার প্রায় সকল জেলা থেকেই আসে পাঠক গোষ্ঠী। মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখে তারা। দেখতে দেখতে এক সময় পছন্দের লেখকের বই পেয়ে যায়। পছন্দের বই পেলেই কেনার চেষ্টা করে তারা।
আবার অনেকেই শুধু পছন্দের লেখকের বই খুঁজতে থাকে। অথবা আগে থেকে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত খবর থেকে জেনে যায় কোন স্টলে প্রিয় লেখকের বই পাওয়া যাবে। মেলায় এসে সেই স্টলটি খুঁজে বের করে। ঠিক সেই স্টলে গিয়ে বলে- পছন্দের লেখকের বই কিনে নেয় খুব মজা করে। এভাবে বই সংগ্রহ করে পাঠকেরা। এভাবেই তারা তাদের স্বপ্নের লেখকের বইয়ের নতুন গন্ধ পেয়ে যায়।
২০১৪ থেকে বইমেলা ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। এ জায়গাটি অনেক বড় পরিসরে রয়েছে। এর আগে বইমেলা হতো বাংলা একাডেমির ভেতরে। ওখানে জায়গাটি হলো খুব ছোট। ছোট জায়গায় ছোট ছোট স্টল হতো। স্টনের সামনের জায়গা হতো চিপা গলির মতো। মেলায় লোক বেশি হলে কি যে ঠেলাঠেলি হতো না দেখলে বিশ্বাস করা দায়! মানুষের সাথে মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি হতো রীতিমতো। বড়রা শক্তি দিয়ে চলতে পারলেও শিশু-কিশোরদের অনেক কষ্ট হয়ে যেতো। পছন্দের বই দেখা, প্রিয় লেখকের সঙ্গে একটু মতবিনিময় করা এবং টুস করে একটি ছবি তুলে ফেলা খুব সহজ ছিলো না। ফলে অনেকের মনে মেলা দেখার সাধ মিটতো না। একটি আফসোস থেকে যেতো মনের ভেতর। আবার অনেক প্রকাশনা জায়গার অভাবে মেলায় স্টল নেয়ার সুযোগও পেতো না।
কিন্তু এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা হওয়ার কারণে জায়গার আর অভাব নেই মোটেই। এখন একটি দুটি তিনটি স্টলের পাশাপাশি বিশাল আয়তনের প্যাভিলিয়নও থাকে। প্যাভিলিয়নে চারিদিকে সাজানো থাকে বই। চারিদিকে থাকে খোলা। সাজানো গোছানো প্যাভিলিয়ন দেখতে অনেক সুন্দর এবং মন ভরানো। অনেক প্যাভিলিয়নের চারদিকে উপরে জনপ্রিয় লেখকদের ছবি টাঙানো থাকে। দূর থেকে দেখা যায় কবি উপন্যাসিক ও গল্পকারদের ছবি। ফলে পাঠকগণ সহজে পছন্দের লেখক এবং লেখকের বই খুঁজে নিতে পারে।
ফেব্রুয়ারির বইমেলা ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকেই শুরু হয়ে যায়। চলে সারা মাস ধরে। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের, মেলাও চলে ২৮ দিন। লিপইয়ার হলে একদিন বেড় ২৯ দিন হয়ে যায়। এর ব্যতিক্রম হয়েছে করোনার সময়। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ থেকে শুরু হয়েছিল মেলা। প্রথমে বলা হয়েছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেলা চলবে। কিন্তু প্রকাশকেরা এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হননি। তারা মেলার সময় বাড়িয়ে একমাস করার দাবী জানালেন। প্রকাশকদের জোর দাবীর কারণে মার্চের ১৭ তারিখ পর্যন্ত মেলার সময় বাড়ানো হয়েছিলো।
বইমেলায় বড়দের জন্য বেশি আয়োজন থাকে। কিন্তু ছোটদের জন্যও থাকে আলাদা আয়োজন। শিশু কর্নার থাকে মেলার ভেতর। শিশু কর্নারে শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইপত্র সাজানো থাকে। মজার মজার গল্পের বই। রূপকথার বই। কার্টুন বই। ভূতের বই, পরীর বই উপন্যাসের বই। ছড়া-কবিতার বই। কতরকম বইয়ের সমাহার থাকে বইমেলায়। শিশু-কিশোরেরা বাবা মা বড় ভাই বোন বা কাছের কোনো আত্নীয় স্বজনের হাত ধরে আসে বইমেলায়।
পছন্দের লেখকের বই অথবা দেখে ভালো লাগা বই কিনে নেয় তারা। যদি বইয়ের লেখকের সাথে দেখা হয়ে যায় তো আর কথাই নেই। প্রথমতঃ অটোগ্রাফ নেবেই। তারপর ছবি এবং সেলফি তুলবে। কারণ ফেসবুকে দিতেই হবে এসব ছবি এবং কেনা বইয়ের কাহিনি। মজার বিষয় হলো অনেক শিশু-কিশোর এবং বড়রাও আসে শুধু ছবি আর সেলফি তোলার উদ্দেশ্যে। এরা তেমন করে বই কেনে না।
আমরা সবাই জানি একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস। কেনো? কারণ এ মাসে ভাষার জন্য শহীদ হয়েছে অনেকেই। আমাদের মাতৃভাষা বা মায়ের মুখের ভাষা হলো বাংলা ভাষা। সেই বাংলা ভাষায় যখন কথা বলতে এবং লেখাপড়া করতে অসুবিধা হতে লাগলো। পাকিস্তানি শাসকেরা অকারণ বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা করলো। বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষা করতে পারলো না। তখন প্রতিবাদ হলো এখানে এই বাংলাদেশে। তখন এর নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার দাবীতে মিছিল বের করে। তখন পাকিস্তানি শাসকেরা ১৪৪ ধারা জারি করে। বাংলার তরুণ যুবকেরা মিছিল নিয়ে ভেঙে ফেলে ১৪৪ ধারা। ঠিক ওই মিছিলে গুলি বর্ষন করে পুলিশ। এতে বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম ও শফিউর এই পাঁচজন শহীদ হন। ফলে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি জাতীয় ভাবে স্মরণীয় হয়ে গেলো। এখন কিন্তু শুধু জাতীয় ভাবে নয় বরং আন্তর্জাতিক ভাবে সারা বিশ্ব আমাদের এই একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। বিশ্বের সকলেই জানে বাংলা ভাষার নাম। কি মজার বিষয় এটি। আরও মজার বিষয় হলো সারা পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজারের উপরে। এই বিশাল সংখ্যক ভাষার মধ্যে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা হলো পাঁচ নম্বরে। আহা কি যে আনন্দের কথা। কি যে উৎসাহের বিষয়টি।
এখন আমরা আমাদের ভাষার মান রক্ষা করার শপথ নিতে হবে। ভাষার মান রাখার জন্য আমাদেরকে ভাষার বিষয়ে আরও ভালো করে শিখতে হবে। শুদ্ধ করে বলতে লিখতে এবং প্রকাশ করতে শিখতে হবে। তাহলেই শুধু ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা আরও এগিয়ে যাবে। উন্নত হবে আরও।
বইমেলার আয়োজনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের মান বাড়াতে পারবো। বইমেলার মতো এমন জ্ঞানের মেলা আর কোনো বিষয়ের মেলায় নেই। বই মানেই আনন্দ আর সুন্দরের এক মিলমিশ। এখানে লেখক পাঠক দর্শক আর প্রকাশকের সমাবেশ। সবার মুখ কেমন হাসিহাসি থাকে। একটি উৎসব উৎসব ভাব থাকে। মনে হয় সবার মন খোলা। দিল খোলা। আর প্রাণ খুলে এগিয়ে চলার একটি আয়োজন। সুতরাং বইমেলা মানেই হলো আমাদের প্রাণের মেলা। বইমেলা মানে হলো জীবনের মেলা। একে স্বপ্নের মেলাও বলা যায়। এই মেলায় যে আসবে সে বই না কিনলেও নতুন বইয়ের গন্ধ পাবে। বইয়ের প্রতি একটি কৌতুহল জেগে উঠবে। একমেলায় না কিনলেও পরের মেলায় কিনবে হয়তো। প্রিয় বন্ধুরা তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের পছন্দের বইগুলো মেলা থেকে সংগ্রহ করবে। তারপর সারা বছর ধরে পড়বে। পড়লে তুমি জানবে অনেক কিছু। আর জানলেই তুমি মানতে পারবে। জেনে মেনে তুমি হবে বড় মানুষ!

Share.

মন্তব্য করুন