বর্তমান জগতের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ^বাসী সংশয় প্রকাশ করছে। জগৎ কি রাজনৈতিক দাপটে ধ্বংস হবে। আবার জগৎ ধ্বংস হলে এর পর কী রূপ ধারণ করবে? মানুষের জীবন কি এখানেই শেষ না তার মৃত্যু পরবর্তী জীবন আছে। বিজ্ঞানের জ্ঞান পদার্থের ভিতর সীমাবদ্ধ। তারা physics এর জ্ঞানে সীমাবদ্ধ। Metaphysics-এর জ্ঞান তার কাছে অজ্ঞাত। বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন শক্তির কোনো ধ্বংস নেই। এক শক্তি আর এক শক্তিতে রূপান্তর হয়। জগৎ ধ্বংস হওয়ার পর বিশ্ব চরাচর শেষ হবে না আবার তার যাত্রা শুরু হবে ভিন্ন ভাবে। এটা মানবীয় জ্ঞানে অতীত, মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণী ও পৃথিবীতে বিচরণশীল। প্রাণী জগতের সাথে মানুষের আচরণ সংযত হতে হবে। কারণ যে অতিথি পাখি হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসে তাকে হত্যা করে রসনার চাহিদা বৃদ্ধি করা শোভনীয় নয়। যে পশুটি তার বহন করতে অপারগ তার উপর বোঝা চাপিয়ে নির্যাতন ও অত্যাচার এটা মানবতাবিরোধী কাজ। বঙ্গোপসাগরে যদি কোনো তিমি মানব সৃষ্ট কারণে মৃত্যুর পর ভেসে ওঠে। এমনকি যদি প্রশান্ত মহাসাগরে কোনো সিল মাছ শিকার করা হয় তাহলে তা অনৈতিক বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। এগুলো মানবেতর প্রাণীর অধিকারকে খর্ব করে। এমনকি যদি মানব সৃষ্ট গ্যাস ওজন স্তর ছিদ্র হয়। এবং প্রাণিজগতে হুমকির সৃষ্টি হয় তাহলে প্রাণিজগতের বাসিন্দারা যদি মানুষের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ আনে তাহলে মানুষকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। প্রাণিজগতের সাথে শোভনীয় আচরণই কাম্য। পশু পাখির সাথে ভালো আচরণ করতে হবে। স্বগোত্রীয় জীবকে হত্যার পথ বন্ধ করতে হবে। মানুষের আচরণ এমন হচ্ছে যে বোমার আঘাতে রক্তের স্রােত বইয়ে দেয়া হচ্ছে। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের ভিতর কী শিক্ষার দৈন্যের সৃষ্টি হয়েছে না মানবচিত্ত কলুষিত হয়ে গেছে। চিত্তকে সৌন্দর্যময় করে তুলতে হবে। আত্মার উৎকর্ষ সাধন করে মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে নইলে মানব নামক শ্রেষ্ঠ জীব একে উপরের সাথে কোন্দলে ও হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে যাবে। মানুষের যাত্রা আজ অন্ধকার গলিপথে। মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করা না যায় তাহলে জগৎ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। মানুষকে মানবিকতার চর্চার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং নির্দয় আচরণ তাকে অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পৃথিবীর সমগ্র জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ ধনী দেশগুলোর জনসংখ্যা হলেও শতকরা ৮৬ ভাগ সম্পদ ভোগ করেন তারা। তাই জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগই মানবাধিকারের মৌলিক অধিকার থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের যখন ভোগের পেয়ালা উপচে পড়তে দেখা যায় তখন উন্নয়নশীল দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ লোক বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত। তারা যখন অত্যাধুনিক রকমারি আলোক সজ্জায় উল্লাসের নৃত্যে মত্ত তখন উন্নয়নশীল দেশের অর্ধেকের বেশি লোক বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকারে। এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মানুষকে সত্য জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। কারণ সত্যই সুন্দর সত্যই মুক্তি। সমাজ যদি মুক্তি না পায় তাহলে ধরে নিতে হবে জ্ঞানটা সত্যের হয়নি। এই সত্য নিয়ে দার্শনিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হতে দেখা যায়। হেগেল, ব্রাডলি, বোসাঙ্কো প্রমুখ ভাববাদীরা মনে করেন যে সত্তা হলো পরম সমগ্র। পরম সমগ্র হতে বিচ্ছিন্ন অংশ কেবল অবভাস। পরম সত্তাই একমাত্র সত্য। যেহেতু সমগ্র হলো সত্য সেহেতু যে অবধারণ এই সমগ্রের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলে তাও সত্য। প্রয়োগবাদ অনুসারে যে ধারণা বা অবধারণের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা আছে তাই সত্য। যে ধারণা বা অবধারণের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা নেই তাই মিথ্যা। তাই এটাকে ‘Bread and butter philosophy’ বলে।
দার্শনিক সি এস পার্স, উইলিয়াম জেমস, এফসিএস শিলার ও জন ডিউঈ সত্যের প্রকৃতি পরীক্ষা হিসেবে প্রয়োগবাদের কথা প্রচার করেছেন। সত্যতা নিয়ে শুধু দার্শনিক মহলে আলোচনা হয় না। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এগুলো আলোচ্য বিষয়। বিজ্ঞান, ধর্ম, সাহিত্য ও সাধারণ জীবনযাপনে জ্ঞান ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। বিজ্ঞানের জ্ঞান পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানীদের ভিতর মতপার্থক্য থাকার কারণে ধ্রুব সত্য আবিষ্কার করতে যেয়ে অনেক সময় মিথ্যার আলখাল্লা পরে আপন বিশ্বাসকে উঁচিয়ে তোলা হয় । তখন শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের, বও অবশিষ্ট থাকে না। বিজ্ঞানী নিউটন মনে করতেন জড় হলো নিশ্চল কিন্তু বর্তমানে জড়গতিও শক্তির আধার এবং সদা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের কথা বলতে যেয়ে গ্রিক দার্শনিক হিরাক্রিটাস বলেন- “একই নদীতে দুই বার অবগাহন করা যায় না।” সফিস্টরা বলত- “মানুষ সব কিছুর মাপকাঠি।” মানুষের দৈনন্দিন জগতের সত্য ও মিথ্যা, অনেক সময় আংশিক সংশয়পূর্ণ ও অনিশ্চিত বলে প্রমাণিত হয়। তাহলে চূড়ান্ত ও ধ্রুব সত্য কি আমরা জানতে পারি। বস্তুজগৎ ধ্বংসশীল অর্থাৎ যার সৃষ্টি আছে তার ধ্বংস আছে। যার সৃষ্টি নেই তার ধ্বংস নেই। পরমসত্তা সৃষ্ট নয় অথচ অস্তিত্বশীল তিনি কোথাও থেকে জন্ম নেননি আর কাউকে জন্ম দেননি। তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। তার কোনো ধ্বংস নেই। সূর্য পূর্বদিকে উঠে পশ্চিম গগনে অস্ত যায়। আসলে সূর্য উঠেও না আবার ডুবেও না। আমাদের এটা একটা ভ্রান্ত নিরীক্ষণ। এমনকি অন্ধকারে মোটা রশি দেখে সাপ বলে যদি হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠি তাহলে সেটা হবে ইন্দ্রিয় জগতের ভ্রান্ত নিরীক্ষণ। সৌরজগৎ সম্পর্কে আমাদের জানার শেষ নেই। টলেমি ভূ-কেন্দ্রিক মতামত প্রচার করেছিল।
তখন মানুষ ভূ-কেন্দ্রিক মতামতকে সত্য বলে মনে করেছিল। কিন্তু কোপার্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক মতামত প্রচার করলে সেটা সত্য রূপে প্রমাণিত হয়। কিন্তু কোনো কিছু স্থির নয়। মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে সাঁতার কাটছে। জড়বস্তুর ক্ষুদ্র কণাকে অণু বলা হতো। কিন্তু অণু ভাঙলে পরমাণু পাওয়া যায়। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে পরমাণু মোটেই অবিভাজ্য নয়, স্থিরও নয়। অতি আধুনিককালের গবেষণায় জড় পদার্থের ভিতর ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ও পজিট্রন নামক বৈদ্যুতিক পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে বস্তুর আরও ক্ষুদ্র অংশের সন্ধান পাওয়া গেছে সেটা হলো কোয়ার্ক। কোয়ার্ক ভাঙলে গতি, শক্তি ও আলো (force, energy and light) পাওয়া যায়। তাই বৈজ্ঞানিক দার্শনিকরা বলেন Nothing to existence and existence to nothing পরম সত্তা তার শক্তিবলে বস্তু থেকে অবস্তু এবং অবস্তু থেকে বস্তুর সৃষ্টি করেন।
স্থানকাল সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণার মধ্যে মতপার্থক্য আছে। বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের জনক হলেও তাদের ভিতর মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির উপস্থিতির কারণে বিশ^াস চলে আসা খুবই সঙ্গত। তাই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যার কারণে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মুখে শোনা যায়- “মহাবিশ্বের বহুবিধ লীলাখেলা দেখে নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানকর্মীকে এটা মানতেই হবে অকল্পনীয় সেই শক্তি যা মানুষের থেকে সীমাহীন রূপে বড় এবং তার সামনে নত হতেই হবে।” মহাকালের কবির মুখে শোনা যায়- “সীমার মাসে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর” মহাকালের চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করগণ যে শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেন সেটা পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল। যে ভাস্কর্যটি দৃষ্টিনন্দন সেটা হাজার বছর অথবা তারও পরে অব্যয় অক্ষয় থাকে না। তখন তার চেহারাটা চেনা দুষ্কর হয়ে ওঠে। এগুলো পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল। এগুলো চিরস্থায়ী রূপে আবিষ্কৃত হয়নি, হবেও না। মানুষের দেহ নশ্বর কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর। আত্মার উৎকর্ষতার ফলে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমরা আংশিক, অমৌলিক, ধ্বংসশীল ও বাহ্যিক সত্তাকে নয় বরং শাশ্বত ও মৌলিক সত্যের সন্ধান চাই যা আমাদের মুক্তির পথ দেখাবে।
Share.