নয়টি দেশে লাখ লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত আমাজন বন। এই বনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই রেইন ফরেস্ট নিয়ে যতই দিন যাচ্ছে, না জানার বিষয়গুলো যেন ততই বেরিয়ে আসছে। এই বনের উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাজন এতই বিশাল যে এর ভিতরের বহু জায়গা দেখা হয়নি আজো। মনে হবে আমাজনের প্রায় কিছুই আমরা জানি না। প্রতি বছর বহু পর্যটক সেখানে যান। তবে আমাজনের রহস্য বের করে নিতে যেসব প্রাণিবিজ্ঞানী, উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী সেখানে যান তারা একেবারেই নতুন নতুন সব প্রজাতির সন্ধান নিয়ে আসেন। এমন সব জায়গায় অ্যাডভেঞ্চার করা হয় যেখানে এর আগে কেউ কোনো দিন যায়নি। এ জন্যই আমাজনকে বলা যায় চেনা এবং জানার মধ্যে অচেনা ও অজানার সম্ভার।
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীবিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত বিশাল বনভূমি এ আমাজন । ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাটি মূলত আর্দ্র জলবায়ু বেষ্টিত। আমাজন অরণ্যের ৬০ ভাগ রয়েছে ব্রাজিলে, ১৩ ভাগ রয়েছে পেরুতে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানায়। পৃথিবীজুড়ে যে রেইন ফরেস্ট তার অর্ধেকটাই এই অরণ্য নিজেই। নানারকম প্রজাতির বাসস্থান হিসেবে সমাদৃত এ আমাজন। আগেই বলেছি দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশজুড়ে আমাজন ফরেস্ট বিস্তৃত।
আরো কিছু তথ্য অবাক হওয়ার মতো। প্রতিদিন পৃথিবীর মোট ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপন্ন হয় আমাজনের বিস্তীর্ণ গাছপালার জগৎ থেকে, তাই আমাজন ফরেস্টকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে ডাকা হয়। তবে আসল সত্যিটা হলো প্রতিদিন আমরা বেঁচে থাকার জন্য বেশির ভাগ অক্সিজেন পাই পৃথিবীর সব সাগর -মহাসাগরের মাইক্রো অর্গানিজম থেকে। যদি এই রেইন ফরেস্টটি একটি দেশ হতো, তাহলে বিশালতার দিক থেকে বিশ্বের নবম বড় দেশ হতো। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডকে ১৭ বার এই ফরেস্টে রাখার মতো জায়গা আছে। আমাজনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে এখনো পুরোপুরি জানা না গেলেও বিজ্ঞানীদের জরিপে জানা গেছে, সেখানে কমপক্ষে ৪০ হাজার প্রজাতির গাছ, ৩ হাজার প্রজাতির মাছ, ১,৩০০ প্রজাতির পাখি ও ২৫ লাখ প্রজাতির কীটপতঙ্গ আছে। আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি দ্রুত বিলীন হচ্ছে আমাজনের জীববৈচিত্র্য। প্রতি সেকেন্ডে সেখানকার ১.৫ একর জমি ও প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ প্রজাতির প্রাণী বিলীন হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাজনে অন্তত ৫০টি গোত্রের ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বসবাস করছে। আধুনিক সভ্যতার সাথে এদের কোনো যোগাযোগ নেই। আমাজন জঙ্গল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঘন গাছপালা ও পাতায় আবৃত থাকায় সূর্যের আলোর মাত্র ১ শতাংশ পৌঁছায় সেখানে। এছাড়া বৃষ্টির পানি জঙ্গলের মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে কতো সময় নেয় জানেন? ১০ মিনিট। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী হিসেবে নীল নদকে ধরা হলেও কয়েকজন বিজ্ঞানী জটিল এক জরিপের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন আমাজনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আমাজন নদীটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী। এর দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৮০০ কিলোমিটার, যা নীল নদের চেয়ে ১০৫ কিলোমিটার বড়। এছাড়া আয়তনের দিক থেকেও আমাজন সবচেয়ে বড়। প্রতি সেকেন্ডে ৫৫ মিলিয়ন গ্যালন পানি আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবাহিত করে এই নদী। প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা সাঁতরে ২০০৭ সালে ৬৬ দিনে মার্টিন স্ট্রেল নামের এক ব্রিটিশ নাগরিক আমাজন নদী পাড়ি দেন। বিশ্বে খাবারের যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তার ৮০ শতাংশই আসে আমাজন জঙ্গল থেকে। এছাড়া বর্তমানে যেসব ওষুধ তৈরি হয়, তার প্রায় ২৫ শতাংশ উপাদান আসে আমাজন থেকে। আমাজন জঙ্গল টিকে থাকার জন্য অনেকটাই নির্ভর করে সাহারা মরুভূমির ওপর। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাহারা মরুভূমির বালু ও ফসফরাস আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে গিয়ে জমা হয় আমাজন জঙ্গলে। আর এর মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকে আমাজনে।
আমাজন নদী বেশির ভাগ নদীর উৎস। এই নদী বিশ্বে প্রচুর পানির জোগান দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও আমাজনে ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। আমাজন জঙ্গলে ৪০০ এরও বেশি উপজাতি বাস করে। মোট ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। তারা বেশির ভাগই ব্রাজিলিয়ান। এ ছাড়াও পর্তুগিজ, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় তারা কথা বলে। যদিও তাদের নিজস্ব ভাষা আছে। এদের মধ্যে কিছু যাযাবর। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই।
আমাজন বন অজগর জাতীয় বিশাল সাপ অ্যানাকোন্ডাসহ শ্লথ, জাগুয়ার প্রভৃতির জন্য বিখ্যাত। সম্প্রতি বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যে নির্বাচনে প্রথম স্থান পাওয়া আমাজন বন প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে কার্বনডাই অক্সাইডকে অক্সিজনে রূপান্তর করে বলে এর পরিবেশগত গুরুত্বও কম নয়। আমাজনের গহিনে এমন জায়গাও রয়েছে যেখানে আজ পর্যন্ত মানুষের পা পড়েনি একটিবারের জন্যও। ফ্রান্সিস দে ওরেলানা নামের স্প্যানিশ পর্যটকই প্রথম মানুষ যিনি আমাজন নদী ধরে পৌঁছে যান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই রেইন ফরেস্টে। এই বনের বুক চিরে বয়ে গেছে আমাজন নদী। যে নদী প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘন ফুট পানি ফেলে সাগরে।
সোনার খোঁজে শত শত বছর ধরে এ বনেই ছুটে এসেছেন অভিযাত্রীরা। নানা রহস্য আর রোমাঞ্চ আমাজনের আসল সৌন্দর্য। বলা যেতে পারে, মানুষ চাঁদে পা ফেলেছে কিন্তু আমাজনের গোপনীয়তা ভাঙতে পারেনি সবটুকু।
আমাজন নাম এলো কী করে?
আমাজন নামটি ফ্রান্সিসকো ডি ওরেলানা তাপুয়া এবং অন্যান্য উপজাতিদের সাথে লড়াই করা একদল যোদ্ধা নারী আমাজন-এর নাম থেকে উদ্ভূত বলে জানা যায় । গ্রিক পুরাণ অনুসারে সেইসব নারী যোদ্ধারা ছিল পুরুষদের চাইতেও অত্যধিক শক্তিশালী এবং দক্ষ। হেরোডোটাস এবং ডিওডোরাস দ্বারা বর্ণিত গ্রিক পুরাণের আমাজন থেকে ওরেলানা অ্যামাজনাস নামটি গ্রহণ করেছেন। শুরুতে ইউরোপীয়দের কাছে আমাজন মারানিয়োন নামে পরিচিত ছিল এবং নদীর পেরুর অংশ আজও সেই নামেই পরিচিত। এটি পরে স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ ভাষায় রিও অ্যামাজোনাস নামে পরিচিতি পায়। ফ্রান্সিসকো ডি ওরেলানা কর্তৃক ১৬ শতকের একটি অভিযানে স্থানীয় যোদ্ধাদের আক্রমণ করার পরে রিও অ্যামাজোনাস নামটি দেয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন মহিলারা এবং এই বিষয়টি আমাদেরকে ডি ওরেলানা নামক একজন আমাজন নারী যোদ্ধার কথা মনে করিয়ে দেয়। গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত রয়েছে এরা ইরানি সিথিয়ান এবং সারমাটিয়ানদের সাথে সম্পর্কিত নারী যোদ্ধাদের একটি উপজাতি।
আমাজনের বাসিন্দারা
আমাজন জঙ্গলে বিরল প্রজাতির প্রাণী রয়েছে যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। আমাজনে ৮৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। অনিন্দ্য সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিপজ্জনক অনেক প্রাণীই আমাজনে বসবাস করে। আমাজনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং ভয়ঙ্কর সাপ অ্যানাকোন্ডা। এছাড়া রয়েছে লাল চোখা ব্যাঙ, বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়, জাগুয়ার, বানর, বৈদ্যুতিক ইল, পিরানহা, বিষাক্ত ডার্ট ফ্রগসহ অসংখ্য বিষাক্ত জাতের সাপ ও বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপ প্রাণী।
পাশাপাশি আমাজন নদীতে ৩০০০ প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী আছে। এই বনে বড় ৩০০শ এর বেশি আদিবাসী গোষ্ঠী বাস করে। মোট আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়। এছাড়া তারা পর্তুগিজ, স্প্যানিস ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে। এছাড়াও এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু যাযাবর। এদের বহিঃবিশ্বের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।
আমাজনের বৃক্ষ প্রজাতি
আমাজনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে যা প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতিতে বিভক্ত। হরেক রকমের গাছপালা দিয়ে আবৃত এ বনে বেশির ভাগই চিরহরিৎ বৃক্ষ। তাই এ বনকে চিরহরিৎ বনও বলা হয়। পৃথিবী জুড়ে যেসব রেইনফরেস্ট রয়েছে তার অর্ধেকটাই এ অরণ্য। তাই একে রেইন ফরেস্টও বলা হয়। আমাজনকে রেইনফরেস্ট বলা হলেও এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয় বরং রেইনফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে। প্রচণ্ড গরমের কারণে বাষ্পীভবনের হার অনেক বেশি যার কারণে আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হয়।
আমাজন নদীর কথা
আমাজন নদী দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত এবং এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। এর উৎসস্থল পেরুর আন্দিজ পর্বতের নেভাদো মিস্মি নামক চূড়া হতে। আমাজন নদী দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৩০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে তিনটি দেশ বিধৌত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে। এই নদী যে পরিমাণ পানি ধারণ করে তা বিশ্বের যেকোনো নদীর তুলনায় বেশি। আমাজন নদী যেখানে সাগরে গিয়ে মিশেছে সেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৪২ লাখ ঘন ফুট পানি সাগরে গিয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে এই পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭০ লাখ ঘন ফুট। এটি গড়ে প্রায় ২,০৯,০০০ ঘনমিটার পানি প্রতি সেকেন্ড (৭৪,০০,০০০ ঘনফুট/সে.) বহন করে সাগরের দিকে নিয়ে যায়, যা এর পরবর্তী সাতটি সম্পূর্ণ ভিন্ন নদীর পানির সমান। আমাজন মোট বৈশ্বিক পানির প্রায় ২০ ভাগ জল সমুদ্রে বহন করে। আমাজনের অববাহিকা হলো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পানি নিষ্কাশনকারী অববাহিকা, যার প্রায় ৭০,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার শুধুমাত্র ব্রাজিলে অবস্থিত। অববাহিকাটি অন্য যে কোন অববাহিকার তুলনায় বড়। আমাজন ব্রাজিলে শুধুমাত্র তার পুরো প্রবাহের পাঁচ ভাগের একভাগ নিয়ে প্রবেশ করে এবং সবশেষে আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে মেশে। তবুও সেখানেই সবথেকে বড় প্রবাহ রয়েছে, যা অন্যান্য নদীর চেয়ে বেশি।
আমাজন বন পুড়ছে : সমাধান কী?
আমাজনে বিশ্বের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি গাছপালা আছে। আনুমানিক ৩৯০ বিলিয়ন স্বতন্ত্র গাছ আছে যা ১৬ হাজার প্রজাতির মধ্যে বিভক্ত। অন্যদিকে পুড়ছে আমাজন। সম্প্রতি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন অ্যামাজন ফরেস্টে দাবানলের কারণে আগুন ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে এই বনে আগুন জ্বলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। হাজার হাজার হেক্টর এলাকার বন পুড়ে যাচ্ছে। মূলত আমাজনের ব্রাজিল অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় ধনী রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা জি সেভেন এই সমস্যা থেকে উত্তরণে ব্রাজিলকে ২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। গবেষকরা বলছেন ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হচ্ছে, তা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে আরো নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাজনকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এ কারণে আমাজন রক্ষায় কাজ করছে অনেক দেশ। এ কাজ চালিয়ে যেতে হবে।