‘এই সুন্দর ফুল,
এই সুন্দর ফল,
মিঠা নদীর পানি,
খোদা তোমার মেহেরবানি।’
এত সুন্দর গানের পর যে গান ছাড়া এখন ঈদ জমে না সেই বিখ্যাত গান, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ সহ অসংখ্য গান অসাধারণ সব কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখে যিনি আমাদের মন প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছেন। তিনিই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ ই জ্যৈষ্ঠ ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ। মাতা জাহেদা খাতুন। কবি নজরুল ইসলামের জন্মের পর তাই বাবা-মা সহ সকল আত্মীয় স্বজনরা তাঁকে দুখু মিয়া বলে ডাকতে থাকেন। সেই থেকেই তার নাম হয়ে যায় দুখু মিয়া। দুখু মিয়া খুব অল্প বয়সেই গ্রামের মক্তবে এক মৌলভীর কাছ থেকে আরবির তালিম নিতে থাকেন। দুখু মিয়ার বয়স যখন আট বছর তখন তার বাবা মারা যায়। চাচা বজলে করিমের কাছেই তার লেখাপড়ার শুরু। চাচা ছিলেন একজন কবি। চাচার ছায়া পড়লো তার উপর। চাচার সাথে সাথে আরবি ফার্সি মিশিয়ে কবিতা লেখা শুরু করলো দুখু মিয়া। বাড়ির খুব অভাব অনটন দুঃখ ভুলতে কবিতার পাশাপাশি গানও লেখা শুরু করলো। নিজের গানে নিজেই সুর দিত। গ্রামে তখন ‘লেটো’ নামে একটা গানের দল ছিল। সেই দল যাত্রা ও পালাগান করতো। দুখু মিয়া লেটো দলে যোগ দিয়ে গান লেখার সাথে সুর দেয়া এবং একই সাথে গাওয়াও শুরু করলো। দুখু নাম বাদ দিয়ে নিজের আসল নাম কাজী নজরুল ইসলাম নামেই লিখতে লাগলো। তার গানে শ্রোতারা অবাক হয়ে যেতে লাগলো। ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে মজা করে লেখা তার কবিতা শুনে সবাই বেশ মজা পেত।
ইংলিশ ফ্যাশন সবি তার
মরি কি সুন্দর বাহার-
দেখলে বন্ধু দেয় চেয়ার
কাম অন ডিয়ার গুড মর্নিং
তারপর বন্ধু মিলে
ড্রিং কিং হয় কৌতূহলে
খেয়েছে সব জাতিকুলে
নজরুল ইসলাম ইজ টেলিং…।
লেটোর দলে এসব মজার মজার কবিতা ও গান লিখে যে দু’চার পয়সা পেত সবই তার মাকে দিয়ে দিত। হঠাৎ করেই লেটোর দল ভেঙে গেলে নিরুপায় হয়ে নজরুল চলে গেলো আসানসোলে। অপরিচিত শহর আসানসোলে খেয়ে না খেয়ে অনেক ঘোরাঘুরির পর কয়লাখনির পাশে একটা রুটির দোকানে কাজ পেল। বেতন পাঁচ টাকা। কাজ রুটি বানানো। তাতেই রাজি হয়ে গেল। খুশি মনে দিনে কাজ আর রাতে সুর করে আলিফ লায়লার পুথি পাঠ। ব্যস তার পুথির সুরে রাত বিরেতে শুধু কয়লাখনির শ্রমিকরাই না অন্যান্য লোকজনও ভিড় জমাতে শুরু করলো। পুথির সাথে নিজের লেখা সুর করা গানও গাইতে লাগলো। আসানসোলের ছোট্ট শহরটা যেখানে সন্ধ্যা হলেই সব অন্ধকারে ডুবে যেত। এখনকার মত তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না, রাস্তাঘাট ছিল মাটির। রুটি বানানো শেষে নজরুল আপন মনে সুর করে পুথি পাঠ আর গানে সুরু করলে আস্তে আস্তে লোকজন জমা শুরু হতো। রাতের অন্ধকার শহরটা যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠতো। সবাই যেন রাতের অপেক্ষায় থাকত। কখন রাত হবে আর নজরুলের গলায় গান আর পুথিপাঠ শুনবে। নজরুল গাইতো
নজরুল ইসলাম বলে কর ভাই বন্দেগি
খোয়াইওনা আজন্ম গোনাতে জিন্দেগি
সরমেন্দেগি হবে হাসরের মাঠে…॥
শহরের লোকজনের কাছে নজরুলের গানের প্রশংসা শুনে থানার দারোগা রফিজউল্লাহ ছুটে এলেন। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। শুনলেন পুথিপাঠও। ভাবতে থাকলেন এই ছোট্ট ছেলেটির প্রতিভা নিয়ে। ভাবতে ভাবতেই নজরুলকে নিয়ে একদিন রওয়ানা হলেন তার নিজ গ্রাম ময়মনসিংহের কাজীর শিমলায়। নজরুলকে ভর্তি করিয়ে দিলেন দরিরামপুর হাইস্কুলে। সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠেন ফার্সিতে সর্বোচ্চ ৯৮ নাম্বার পেয়ে। এখানে এসে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠে রাখালদের সাথে বাঁশি বাজানো, গল্প করা, বর্ষায় ছিপ ফেলে মাছ ধরা, ঘুরে বেড়ানোয় বেশ সুন্দর জীবন কাটছিল। সুন্দর চেহারা, গানের গলা, ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে কিছু দুষ্টু ছেলে তাকে নিয়ে হিংসা করতে শুরু করল। যখন তখন তাকে বিরক্ত করতো খেপাতো। একদিন হঠাৎ নজরুল ক্ষেপে গিয়ে এদের একজনকে পানিতে ফেলে দিয়ে, অন্যদেরকে শায়েস্তা করে পালিয়ে চলে গেল নিজ গ্রাম চুরুলিয়ায়। সেখানে স্কুলে ভর্তি হতে চাইলেন। কিন্তু ততদিনে সেখানে ভর্তি শেষ হয়ে গেছে। কেউ তাকে স্কুলে ভর্তি করবে না। মনের দুঃখে নজরুল তার এক বন্ধুকে তার স্কুলে ভর্তি হতে না পারার কষ্ট নিয়ে একটা চিঠি লিখলো। বন্ধুটি নজরুলের চিঠিটা পেয়ে শিয়ারসোল স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দেখালো। প্রধান শিক্ষক চিঠিটার অসাধারণ ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি দেখে এতোটাই মুগ্ধ হলেন যে, সাথে সাথে নজরুলকে ডেকে শিয়ারসোল স্কুলে ভর্তি করে নিলেন। শুধু তাই না স্কুল থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা ও মোহামেডান বোর্ডিংয়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানে নজরুলের সাথে পরিচয় হয় কোরআনে হাফেজ নুরুন্নবি যিনি নজরুলকে ব্যাকরণসহ ফার্সি ভাসা শিক্ষা দেন এবং পরিচয় ঘটে তার সারা জীবনের প্রিয় এক বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের। শৈলজানন্দ তখন লিখতো কবিতা আর নজরুলের তখন গল্প লেখা শুরু। প্রায়ই দুই বন্ধু রাস্তার পাশে নির্জনে একজন আরেকজনের লেখা পড়ে শোনান। ততদিনে সবাই এই দু’জনকে মানিকজোড় বলতে শুরু করেছে। শিয়ারসোল স্কুলের একটু দূরেই ছিল খ্রিষ্টানদের কবরখানা। এই কবরখানায় একদিন নজরুল শৈলজানন্দ গল্প করছিল, এই সময়ে ওদের আরেক বন্ধু পাঞ্চু একটা নকল বন্দুক ও একটা এয়ারগান নিয়ে আসে। আচমকা নজরুল পাঞ্চুর হাত থেকে এয়ারগানটা নিয়ে ট্রিগার টিপতে থাকে আর বলতে থাকে ইংরেজদের খতম করতে হবে, বড় লাট খতম, ছোট লাট খতম, এবার পঞ্চম জর্জকে মারতে হবে। পাশ দিয়ে তখন স্কুল শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটক যাচ্ছিল। তার কানে কথাটা যেতেই তিনি জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন কথাটা নজরুল বলেছে। নজরুলকে দেখে তার মনে হলো সত্যিই একদিন এই ছেলে ইংরেজদের এদেশ থেকে তাড়াবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি চলতে থাকলো সাহিত্যচর্চা। পাখিদের প্রতি দরদ নিয়ে লিখে ফেলল, ‘চড়ুই পাখির ছানা।’ কবিতাটি শুনে বন্ধু শৈলজানন্দর চোখে পানি এসে গেল, আবেগে নজরুলকে সাথে সাথেই বলল, ‘একদিন তুই অনেক বড় কবি হবি।’ কবিতাটির কয়েকটি লাইন-
“মস্ত বড় দালান বাড়ীর উইলাগা ঐ কড়ির ফাঁকে
ছোট্ট একটা চড়ুই ছানা কেঁদে কেঁদে ডাকছে মাকে
চু চা রবের আকুল কাঁদন যাচ্ছিল নে বসন বায়ে
মায়ের পরান ভাবলে বুঝি দুষ্টু ছেলে নিচ্ছে ছায়ে…।”
নজরুল আর শৈলজানন্দ একদিন বর্ধমান রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, একটা ট্রেনের কামরায় ওদেরই বয়সী একদল বাঙালি সৈনিক স্লোগান দিচ্ছে, ‘বাঙ্গালী পল্টন জিন্দাবাদ।’ স্লোগানটা নজরুলের কানে যেতেই নজরুল শৈলকে বলল, যুদ্ধে যাবি শৈল? উত্তরে শৈল বলল, জার্মানির সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধ, সেখানে গিয়ে আমাদের কী লাভ? নজরুল বলল, আমরা যুদ্ধবিদ্যা শিখব, এদেশ থেকে ইংরেজদের তাড়াবো। কথাটা শৈলজানন্দের ভালো লেগে গেল। নজরুলসহ শৈলজানন্দ যুদ্ধে নাম লেখাতে আসানসোল গেলো। সেখানে তাদের কথা শুনে এক ইংরেজ সৈনিক তাদেরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিল। কলকাতায় স্বাস্থ্য পরীক্ষায় শৈলকে আনফিট করা হলো। নজরুল তখন একাই চলল। দুই বন্ধুর বিদায়ে দু’জনের চোখেই পানি এলো।
৪৯ নং বাঙ্গালী পল্টনে শুরু হলো নজরুলের সৈনিক জীবন। চলে যেতে হলো করাচি। নতুন পরিবেশ, নতুন জীবন। কাঁধে রাইফেল, পায়ে বুট, শরীরে সৈনিকের পোশাক, তাতে কী? ভেতরে যে নজরুল একজন উদ্যম উচ্ছল এক কবি। গান কবিতা আর হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখলেন কঠোর কঠিন সামরিক জীবন। হাবিলদার পদে উন্নতি হলো। হাবিলদার কবি সৈনিক জীবনের কুচকাওয়াজ আর রুটিন মাফিক সামরিক জীবনের পাশাপাশি পড়াশোনা করতে থাকেন, হাফিজ, রুমী, শেখ সাদী, ফেরদৌসী, রবীন্দ্রনাথ, ওমর খৈয়ামের বই। একজন মৌলভীর কাছে ফার্সি শিক্ষার পাশাপাশি গানের চর্চাও চলতে থাকলো সমানতালে। এখান থেকেই গল্প কবিতা, প্রবন্ধ লিখে পাঠাতে লাগলেন কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকা’ ও ‘সওগাত’ পত্রিকায়। এই সময়ে ‘বাউণ্ডুলের আত্মকথা’ লিখে কলকাতার পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলে দেন। তখনও নজরুল কবি হিসেবে অপরিচিত। সবাই তখন তাকে এক সৈনিক কবি হিসেবেই চেনে। ব্রিটিশ সরকার ৪৯ নং বাঙ্গালী পল্টন ভেঙে দিলে নজরুলের সৈনিক জীবনের ইতি ঘটে।
মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, বড় বড় মায়াবী চোখ আর মুখভরা হাসি নিয়ে নজরুল কলকাতায় এসে উঠেন প্রথমে শৈলজানন্দ পরে ঢাকা ঘুরে কলকাতার বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে। ইতোমধ্যে নজরুলের লেখা নিয়ে সাহিত্যমহলে বেশ প্রশংসা হতে থাকে। নজরুলের কামরাটা হয়ে উঠে জ্ঞানী-গুণীদের মিলনস্থল। শৈলজানন্দ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি শাহাদত হোসেন, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখের মধ্যমণি হিসেবে নজরুল রোজ আড্ডা দিতেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মাধ্যমে ‘নবযুগ’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পত্রিকায় নজরুল তার একের পর এক জ্বালাময়ী কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। ইংরেজ বিরোধী লেখার অভিযোগে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ‘নবযুগ’ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। কলেজ স্ট্রিটে বসেই নজরুল লিখে ফেললেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ‘বিজলী’ পত্রিকায় কবিতাটি ছাপানোর সাথে সাথে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেল। ‘বিজলী’র পাশাপাশি ‘মোসলেম ভারত’ ‘প্রবাসী’ ও ‘দৈনিক বসুমতি’ পত্রিকায় বিদ্রোহী কবিতাটি ছাপা হলো। মুহূর্তেই কবিতাটি কলকাতা থেকে শুরু করে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়লো। এই একটি কবিতা সারা ভারতে যে আলোড়ন তুললো তা ভারতবর্ষ কখনও দেখেনি।
বল বীর
চির উন্নত মম শির!
শির নেহারী আমারি নত শির
ওই শিখর হিমাদ্রীর! ….
প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে নজরুল তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পড়ে শোনালে রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ে নজরুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ সত্যি তুমি আমায় হত্যা করবে। তোমার মধ্যে জগৎ আলো করার জ্যোতি দেখতে পাচ্ছি। তোমায় আমি আশীর্বাদ করি, কবি’ বলে বুকে টেনে নিলেন।
নজরুল তখন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত। ধূমকেতু পত্রিকার মধ্য দিয়ে নজরুল তখন একের পর এক আগুন ঝরা লেখা লিখে চলছেন। ইংরেজ সরকার এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ধূমকেতু পত্রিকার মধ্য দিয়ে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়ার অপরাধে নজরুলকে গ্রেফতার করা হলো। রাজদ্রোহের অপরাধে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। জেলে বসে নজরুল রচনা করতে থাকলেন অসাধারণ সব লেখা
শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল…॥
জেলে থাকা অবস্থায় নজরুল জানতে পেলেন রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নাটিকাটি নজরুলকে উৎসর্গ করেছেন। জেলের ভেতর অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল লেখেন
কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
শিকল পূজার পাষাণ বেদী
ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস-নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদী…।
শুধু লিখেই ক্ষান্ত থাকলেন না তীব্র প্রতিবাদ জানাতে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। দেশবরেণ্য নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ, আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীরা নজরুলকে অনশন ভাঙতে অনুরোধ করেন। ৪৯ দিন ধর্মঘট শেষে সকলের প্রচণ্ড অনুরোধের কারণে নজরুল অনশন ভাঙ্গেন। ১৯২৩ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর নজরুল কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ও মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু। এই সময়ে নজরুল ছোটদের জন্য লেখেন অসাধারণ সব কবিতা-
থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে…।
কিংবা
বাবুদের তাল পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস! করলো তাড়া
বলি থাম একটু দাঁড়া…॥
কিংবা
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডেকে ঐ জাগলো জোয়ার দুয়ার ভাঙ্গা কল্লোলে!….।
এরকম অসংখ্য মজার মজার রচনা নিয়ে ঝিঙ্গেফুল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। কবিতার পাশাপাশি লিখলেন ছোটদের জন্য নাটক, ‘ঝিলমিল’। হঠাৎ করেই ১৯৩০ সালে নজরুলের পুত্র বুলবুল মারা যায়। নজরুল এতে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। একই সাথে অর্থকষ্টেও ভুগতে থাকেন। আর অন্যদিকে শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তখন তার লেখা খুবই জনপ্রিয় হতে থাকে। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ছায়ানট, সাম্যবাদী, সিন্দু হিন্দোল, চক্রবাক, জিঞ্জির, প্রলয়শিখা, ব্যথার দান, শিউলি মালা, রিক্তের বেদনসহ প্রবন্ধের বই যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী, অসংখ্য গ্রন্থ তখন পাঠক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত সমাদৃত। শুধু লিখেই ক্ষান্ত থাকেননি এসময় আটটির মতো চলচ্চিত্রে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। নিদারুণ অর্থ ও মানসিক কষ্ট নিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি নজরুল মস্তিষ্করোগে আক্রান্ত হন। দুরারোগ্য এই ব্যাধি ধীরে ধীরে তার স্মৃতিশক্তি কেড়ে নিতে থাকে। এই সময় তার বন্ধুমহলের উদ্যোগে নজরুলকে চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠানো হয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৯৬২ সালের ৩০ শে জুন নজরুলের স্ত্রী মারা যান। এই সময় নজরুলের স্মৃতিশক্তি ছিল একেবারেই ক্ষীণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে তাঁকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সম্মানসুচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেন। জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয় কাজী নজরুল ইসলামের নাম। ঢাকার পিজি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট, বাংলা ১৩৮৩ সালের ২২ শে ভাদ্র রোববার সকাল এগারোটায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়। তার লেখা গান
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই…।
এই ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সাথে তাঁকে কবর দেয়া হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমন বর্ণাঢ্য জীবনের কখনো দুখু কবি, কখনও হাবিলদার কবি, কখনও প্রেমিক কবি, কখনও বিদ্রোহী কবি, সর্বশেষে আমাদের জাতীয় কবির নিজের লেখা গানের মত আমরাও চাই,
রোজ হাসরে আল্লাহ আমার করোনা বিচার।
বিচার চাহি না, তোমার দয়া চাহে এ গুনাহগার ….॥
Share.