প্রতিবারই সাকরাইনে প্রথম দিকেই রাতুলের ঘুড়ি কাটা পড়ে। প্রতিবারই হারার পর তার মন খারাপ হয়। তখন তার স্কুল শিক্ষক বাবা তাকে সান্ত¡না দেয়। কিন্তু রাতুলের বাবা মিরাজ সাহেব প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। স্কুল থেকে ফিরে এসে ব্যাচের পর ব্যাচ প্রাইভেট টিউশন করেন। তিনি খুব একটা অবসর পান না। অথচ তার একমাত্র ছেলের আবদার খুব বেশি কিছু না। একটি ঘুড়ি বানিয়ে দেওয়া। দিবো দিবো করে আজ তিন বছর! তাই রাতুলের মন খুব খারাপ। সে পণ করেছে এবারের সাকরাইন উৎসবে সে লাটাই ঘুড়ি হাতে নিবে না। ঘরের কোণে বসে থাকবে।
সকালে মিরাজ সাহেব বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রাতুলকে বারান্দায় দেখেছেন। রাতুল মন খারাপ করে বসে আছে। অথচ মিরাজ সাহেবেরও ইচ্ছে করে ছেলের সাথে ঘুড়ি উড়াতে। কাটাকুটি খেলতে। কৈশোর ও যৌবনে এই মহল্লায় মিরাজ সাহেবের মতো কেউ লাটাই চালাতে পারতো না। তার পঙ্খিরাজ ঘুড়িটা আগে সব ইশারা বুঝতে পারতো। লাটাইয়ের সুতা ছিল ব্লেডের মতো ধারালো। কাটাকাটির খেলায় মিরাজ ছিল পূর্ব ঘোষিত সম্রাট।
রাতুল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আবার মিরাজ সাহেবের ঘরে লাটাই ঘুড়ি ঢুকে। তাও তিন বছর আগে! সাকরাইনের দিন মিরাজ সাহেব একটু আগেভাগেই বাসায় ফিরে এসেছেন। ব্যাগ হাতে নিয়ে তিনি সরাসরি তার রুমে ঢুকে গেলেন। সচরাচর তিনি বাজার থেকে বাসায় ঢুকে রাতুলের মায়ের হাতে সদাই-পাতি বুঝিয়ে দেন। হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে চা খান। আজই এমন তাজ্জব ঘটনা ঘটলো। নিজের ঘরে ঢুকেই তিনি দরজা আটকে দিয়েছেন।
বাজার থেকে আসার সময় মহল্লার দোকান ঘুরে ঘুরে ঘুড়ি তৈরির মাল মসলা তিনি কিনেছেন। একমনে তিনি সেই পঙ্খিরাজের মতো ঘুড়ি বানাচ্ছেন। সাকরাইনে ঘুড়ি উৎসবের জন্য মিরাজ সাহেব তেজি ঘোড়ার মতো ঘুড়ি বানাতে চেষ্টা করছেন। ঘরে বসেই তিনি সুতায় কাচের গুঁড়ো ও কাঁচা গাবের কষ দিয়েছেন। তারপর ছাদে লাটাই-সুতা শুকানোর জন্য তিনি মেলে দিয়েছেন। আগামীকাল মহল্লায় সাকরাইন। চারিদিকে সাজ সাজ রব। লাল নীল ঘুড়ি ওড়ছে। মহল্লার মোড়ে কিশোর তরুণদের জটলা। পটকার দোকানে লম্বা লাইন। বাতাসে রঙিলা উৎসবের একটা মিষ্টি গন্ধ হেঁটে বেড়াচ্ছে পুরান ঢাকায়।
সকাল সকাল মিরাজ সাহেব ঘুম থেকে উঠেছেন। রাতুল এখনো ঘুমাচ্ছে। উৎসবের গান বাজনা তার কানে যাচ্ছে না। বুঝা যাচ্ছে- ছেলেটা বাপের ওপর খুব বেশি অভিমান করেছে। মিরাজ সাহেব বেড়ালের মতো চুপিচুপি রাতুলের ঘরে ঢুকেছেন। রাতুলের মাথার পাশে বসে ছেলের ঘুমন্ত মুখখানা দেখছে। একদম রোজ পুত্তুরের মতো লাগছে রাতুলকে। ভারী মিষ্টি একটা চেহারা! মিরাজ সাহেব আলতো করে রাতুলকে ডাকলেন। প্রথম ডাকে রাতুল সাড়া দেয় না। তিনি আবার ডাকলেন। এবার একটু নড়েচড়ে রাতুল ঘুমের ভেতর ঢুকে যায়। এবার মিরাজ সাহেব ছেলের হাত টেনে বললেন, চল্, ছাদে যাবো। ওঠ্। ঘুড়ির কাটাকুটি দেখবো।’
ঘুম ঘুম চোখে বাবার সাথে ছাদে ওঠে রাতুল। ছাদের ওপর টেবিলে রাখা ঘুড়ি, লাটাই-সুতা দেখে রাতুলের চক্ষু কপালে ওঠে গেল। মিরাজ সাহেব পঙ্খিরাজকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। পঙ্খিরাজ বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে ওপরে ওঠে গেল। আকাশকে ছুঁয়ে দিতে পঙ্খিরাজ ওড়ছে। এমন শত শত ঘুড়ি পুরান ঢাকার আকাশে ওড়ছে। এই ছাদ থেকে ঐ ছাদ। শত শত মানুষ। উৎসুক জনতা। হই হুল্লোড়। জয় পরাজয়। হাসি ও মন খারাপ। সবই চলছে। মিরাজ সাহেবের হাতে লাটাই। তার চমৎকার নিয়ন্ত্রণ লাটাইয়ে। রাতুলের হাতে লাটাই দিয়ে বললেন- ‘নে, বাপ। এবার কাট্ সব ঘুড়ি।’ রাতুল সামনে যেই ঘুড়ি পাচ্ছে তাই কাটছে। এই কাটাকুটির খেলায় সন্ধ্যার আকাশে কেবল একটা ঘুড়িই অবশিষ্ট ছিল। রাতুলের পঙ্খিরাজ ঘুড়ি। রাতুল চ্যাম্পিয়ন। পূর্ব ঘোষণা অনুসারে রাতেই মহল্লার গলিতে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান হবে। রাতুল আজ ভীষণ খুশি। আগামী এক বছর সে-ই পঙ্খিরাজের রাজা।

Share.

মন্তব্য করুন